আজ থেকে ১০৩ বছর আগে ১৯১২ সালের ১১ এপ্রিল নিউইয়র্কের উদ্দেশে ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন বন্দর ত্যাগ করে টাইটানিক। যাত্রার চতুর্থ দিনের মাথায় ১৪ এপ্রিল রাত ১১টা ৪০ মিনিটে আটলান্টিক মহাসাগরের অতল গহ্বরে তলিয়ে যায় বিশালাকার এ জাহাজটি। সমুদ্রযাত্রার ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক এ জাহাজ দুর্ঘটনা নিয়ে এ পর্যন্ত অসংখ্য কাহিনী রচিত হয়েছে, লেখা হয়েছে শত শত বই। তৈরি হয়েছে বিগ বাজেটের চলচ্চিত্র। আটলান্টিকের শীতল পানিতে বিশালায়তন বরফের ভাসমান পাহাড়ের ধাক্কায় ডুবে যায় টাইটানিক। যদিও টাইটানিক ডোবার কারণ হিসেবে বরফ খণ্ডের সঙ্গে ধাক্কা লাগাকে কেউ অস্বীকার করেন না, কিন্তু এই ধাক্কার ফলে টাইটানিক কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তা নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়ে গেছে।
টাইটান গ্রিক পুরাণের বিশ্বকর্মা। কারিগরি দক্ষতা, স্থাপত্য-সৃষ্টির আরাধ্য দেবতা। তার নামে উৎসর্গ করতেই বিশ শতকের গোড়ায় তৈরি এ জাহাজের নাম রাখা হয়েছিল টাইটানিক। জাহাজটির পুরো নাম ছিল 'আরএমএস টাইটানিক', অর্থাৎ 'রয়্যাল মেল স্টিমার টাইটানিক'। প্রস্তুতকারক উত্তর আয়ারল্যান্ডের নামি কোম্পানি হারল্যান্ড অ্যান্ড উলফ। নির্মাতা সংস্থাটির নাম ছিল 'হোয়াইট স্টার লাইন'। এ টাইটানিক তৈরি করতে তখনকার দিনে খরচ পড়েছিল প্রায় ৭৫ লাখ ডলার। টাইটানিকের সাময়িক সাফল্যে তাদের মাথায় একটি নয়, ওই মাপের তিনটি যাত্রীবাহী জাহাজ তৈরির পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু 'টাইটানিকে'র সলিল সমাধির সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু ঘটে তাদের যাবতীয় স্বপ্ন কল্পনার ও পরবর্তী আবিষ্কারের।
১৯১২ সালের ১১ এপ্রিল। ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন থেকে টাইটানিক প্রথম সমুদ্র যাত্রা শুরু করেছিল। সেদিন পৃথিবীজুড়ে উঠেছিল এক আলোড়ন। কারণ সে সময় এতবড় এক জাহাজ যে তৈরি করা যায়, তা মানুষের কাছে ছিল অকল্পনীয়। ১৯০৭ সাল থেকে এ জাহাজটি তৈরি শুরু হয়েছিল। তৈরি হতে সময় লেগেছিল মাত্র ছয় বছর। যখন থেকে এ টাইটানিক তৈরি হতে শুরু হয় তখন থেকেই এ বিশালাকার জাহাজটির পরিকল্পনার কথা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। আর তখন থেকেই এটি নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ ছিল না। ১৯০৭ থেকে ১৯১২_ এ ৬ বছরে প্রযুক্তিবিদ ও কারিগরদের অক্লান্ত পরিশ্রমে বেলফাস্টে 'টাইটানিকে'র জন্ম হয়। বিশালাকার এ জাহাজটির দৈর্ঘ্য ছিল ২৭৫ মিটার। আসন সংখ্যা ছিল প্রায় দুই হাজারের মতো।
জাহাজ ছাড়ার বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছিল, 'দ্য বিগেস্ট এভার ক্রিয়েশন অব ম্যান ইস অন দ্য মুভ'। শুধু আকার-আয়তনে নয়, ওজনেও 'টাইটানিক' ছিল বিশাল। ৬০ হাজার টন ওজনের একটি ছোটখাটো শহরের মতো জাহাজ পানিতে ভাসবে_ এটা শুনেই তখনকার অনেক মানুষ অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। জাহাজটি এত সুন্দর করে সাজানো হয়েছিল, এত সুব্যবস্থা ছিল যে, সে সময়কার অন্য যে কোনো বিলাসবহুল জাহাজকে টেক্কা দিয়েছিল টাইটানিক। অন্যসব জাহাজের তুলনায় এ জাহাজের টিকিট মূল্য ছিল অনেক বেশি। এ ছাড়া সব শ্রেণীর যাত্রীর কথা চিন্তা করে জাহাজে তিনটি পৃথক শ্রেণীর ব্যবস্থা ছিল।
টাইটানিকের প্রথম শ্রেণীর কেবিনের ভাড়া ছিল তখনকার হিসাবে ৩ হাজার ১০০ ডলার। আজকের দিনে ১ লাখ ৫০ হাজার ডলারের সমান! আর ডেক টিকিট অর্থাৎ তৃতীয় শ্রেণীর ভাড়া ছিল ৩২ ডলার। আজকের হিসাবে তাও খুব একটা কম নয়। প্রায় ১ হাজার ৭০০ ডলারের কাছাকাছি।
তবে সাউদাম্পটন থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে নিউইয়র্ক পেঁৗছানোর এই বিশাল যাত্রাপথটা ছিল এত দুস্তর ও বিপদসঙ্কুল যে, ভাড়া নিয়ে কোনো যাত্রীই তখনকার দিনে খুব একটা মাথা ঘামাননি। ২২০০ যাত্রী ও কয়েকশ জাহাজের কর্মী নিয়ে নিউইয়র্কের অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছিল টাইটানিক। সারা বিশ্বের সংবাদপত্রে সেদিন টাইটানিক ছিল প্রধান শিরোনাম। কৌতূহলের শেষ ছিল না। যাত্রীরা এই ঐতিহাসিক যাত্রাপথের সঙ্গী হতে পেরে তাদের মধ্যে রোমাঞ্চের শেষ ছিল না।
নিয়তির অভিশাপ, নিষ্ঠুর পরিহাস। কারণ ১১ এপ্রিল যাত্রা শুরুর দিনই দেখা দিয়েছিল অশনিসংকেত। 'ডক' থেকে জাহাজ ছাড়া মাত্রই 'নিউইয়র্ক' নামে এক যাত্রীবাহী জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা লাগতে লাগতে সামান্যের জন্য বেঁচে যায় টাইটানিক। তারপর নাচ-গান, বিশ্রাম সবই চুটিয়ে উপভোগ করছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিরা। চারটি দিন তাদের খুব ভালোই কেটেছিল। কিন্তু সমস্যা হলো চতুর্থ দিন রাতে। ১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিল রাতে উত্তর আটলান্টিকে নিউফাউন্ডল্যান্ডের কাছে পেঁৗছতে না পেঁৗছতেই পানির নিচে লুকিয়ে থাকা এক আইসবার্গের সঙ্গে সজোরে ধাক্কা লাগে টাইটানিকের।
প্রকৃতির খেয়ালের কাছে হার মানতে বাধ্য হলো আধুনিক প্রযুক্তি। ধীরে ধীরে সমুদ্রের নীল হিমশীতল পানিতে ডুবে যায় ৮৮৩ ফুট লম্বা ও ৯২ ফুট ৫ ইঞ্চি চওড়া ৬০ হাজার টনের গর্বের জাহাজ 'টাইটানিক'। এই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৫১৩ জন যাত্রী সমুদ্রগর্ভে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যান।
আজ ১০০ বছর পরও সেই কালরাতের কথা ভাবলে শিউরে ওঠেন পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের মানুষ। অভিশপ্ত সেই দিন থেকে আজও আটলান্টিকের আড়াই মাইল গভীরে প্রকৃতির পরিহাসের মূর্তিমান সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে টাইটানিকের ধ্বংসস্তূপ।
আর ঘটনাটি আজও এক 'মিথ' হয়ে গেছে। মানুষের বিজ্ঞান, বিশালত্ব, ঐশ্বর্য_ এসব কিছু যে প্রকৃতির একটা ছোট্ট ইশারায় কি অবলীলায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে, তারই প্রতীক টাইটানিক। আধুনিক নৌ-স্থপতি বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীদের মতে, টাইটানিকের কারিগরি কৌশল এতই দুর্বল ছিল, প্রকাণ্ড হিমশৈল কেন, যে কোনো জোর আঘাতেই নাকি ভেঙে পড়তে পারত 'টাইটানিকে'র বিস্তর ত্রুটিযুক্ত রিভেট। জাহাজে যথেষ্ট সংখ্যক লাইফবোট থাকলে যে আরও অনেক যাত্রীর প্রাণ বাঁচত সে বিষয় নিয়েও অনেক দোষারোপ করা হয়েছিল। ব্রিটেনের পাবলিক রেকর্ডস অফিসের নথিপত্র থেকে পরে জানা যায়, টাইটানিকের প্রথম শ্রেণীর যাত্রীরাই একমাত্র লাইফবোটের কাছাকাছি ছিলেন। তাদের অধিকাংশই ইংরেজিভাষী হওয়ায় তারা জাহাজের কর্মীদের নির্দেশ বুঝতে পেরেছিলেন। এর ফলে প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের মধ্যে ৯৭ শতাংশ মহিলা ও ৩৪ শতাংশ পুরুষ লাইফবোটের সাহায্যে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে সমর্থ হন। দ্বিতীয় শ্রেণীর যাত্রীদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ মহিলা ও মাত্র ৮ শতাংশ পুরুষ এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে কোনোরকমে লাইফবোটে উঠতে পারেন। আর তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রীদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ মহিলা ও ১২ শতাংশ পুরুষ নিজেদের প্রাণ রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যন্ত্রচালিত অনুসন্ধান যান সমুদ্রতলে ১৩ হাজার ফুট গভীরে নেমে খুঁজে পায় টাইটানিকের রাজকীয় অথচ করুণ ভগ্নাবশেষ। ৪১০ু ৪র্৪ উত্তর অক্ষাংশ ও ৫০০ ১র্৪ পশ্চিম দ্রাঘিমায় পানির ১৩ হাজার ফুট নিচে সমুদ্রের পলি ও কাদায় প্রোথিত টাইটানিকের অবশেষ যেন কোনো ট্র্যাজেডির অন্তিম দৃশ্য। শেলির কবিতার ওজিম্যানডিয়াসের মতো সমুদ্রের পানির নিচে বালি, পলি আর প্রবালের মৃতদেহের পাশে ছড়িয়ে আছে গত শতকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অহমিকার শেষ চিহ্ন।