দেশ ভাগের সময় কোচবিহারে বসবাসকারীরা ভারতে, আর রংপুরে বসবাসকারীরা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে। কোচবিহারের মহারাজা নরায়ন ভুগ বাহাদুরের কিছু জমি রংপুর মহারাজার জমিদারী অঞ্চলে ছিল। একইভাবে রংপুরের মহারাজা গোপাল লাল রায়ের কিছু জমি ছিল কোচবিহার রাজার অঞ্চলে। কথিত আছে এই ছোট ছোট ভূখন্ডগুলি নিয়ে দুই মহারাজা দাবা বা পাশা খেলার দান হিসেবে ব্যবহার করতো। দুর্ভাগ্যক্রমে ১৯৪৭ সালে বৃটিশ আইনজীবী রেড ক্লিফের মানচিত্র বিভাজনে দুই মহারাজার এই জমি খন্ডগুলি বাদ পড়ে যায়। সৃষ্টি হয় ছিট মহল। সেই সাথে শুরু ১৬২ টি ছিটমহলের মানুষের অনিশ্চিত জীবন।
এরপর ১৯৭৪ সালের মুজিব ইন্দিরার স্থল সীমান্ত চুক্তির আলোকে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে প্রটোকল স্বাক্ষর। তারই ফলশ্রুতিতে ভারতের লোক ও রাজ্যসভায় সীমান্ত বিল পাশ হওয়ায় বাংলাদেশ অংশের ১১১ এবং ভারতীয় অংশের ৫১ টি ছিটমলে শুরু হয়েছে আনন্দ উৎসব। নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছে। ভূখণ্ড হবে নিজেদের- এমন স্বপ্নে বিভোর হাজারো মানুষ।
তাদের দাবি সবছিুর আগে নাগরিকত্ব কার্ড। গারাতী ছিট মহলের ঝিচু পাড়া গ্রামের ১১১ বছর বয়সী আবু বক্কর ছিদ্দিক বলেন, 'হামাক সবাই ছিটের লোক কহে। মুই এলা বাংলাদেশি হয়ে মরবা পারিম এটাই শান্তি।' পুটিমারি ছিটমহলের আফাজউদ্দিন (৮৫) বলেন, 'মুই এলা ছিটের লোক নাহায়।' একই ছিটমহলের ঝাকুয়া পাড়া গ্রামের বৃদ্ধা শরিফা খাতুন (৭৫) বলেন, 'মুই আর কয়দিন বাচিম। মোর নাতি পুতিলা স্কুল যাবে, লেখাপড়া করবে এই শুনেই মোর শান্তি।' ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির উদ্যোগে জনগণনা ও সমিকরনের কাজ। আইন শৃংখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য টহল দিচ্ছে পুলিশ।
ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির পঞ্চগড় জেলার সভাপতি মফিজার রহমান বলেন, সর্ব প্রথমে দরকার নাগরিকত্বের কার্ড। ভারতীয় ছিটমহলের মানুষের জন্য ইতোমধ্যে ভারত সরকার অনুদানের ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও দ্রুত ঘোষণা দেবে আশা করছি। ছিট মহলে কোটা ব্যবস্থার মাধ্যমে উন্নয়ন করা জুরুরি। না হলে ছিটের মানুষ পিছিয়েই থাকবে।'
ভারতের রাজ্যসভায় সীমান্ত বিল পাসের পর ছিটমহলগুলোতে বইছে আনন্দের বন্যা। যদিও এরইমধ্যে সময়ের স্রোতে ভেসে গেছে অনিশ্চয়তা আর অবহেলার ৬৮ বছর। নাগরিকত্বের দাবি নিয়ে অনেকেই পরোলোকগত হয়েছেন। তারা পাননি, তবে তাদের রেখে যাওয়া প্রজন্ম আজ একটি দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচিতি পেতে যাচ্ছে।
প্রায় ১১ হাজার একর জমি আর ২৫ হাজার লোকসংখ্যা নিয়ে পঞ্চগড়ের ৩৬ টি ছিটমহল বাংলাদেশের সাথে যুক্ত হতে যাচ্ছে। দেশের অন্যান্য জেলার ছিমহলগুলো থেকে জমি এবং জনসংখ্যা বেশি পঞ্চগড়ের ছিটমহলগুলোতে। এই ৩৬ টি ছিটমহল এতদিন শান্তি কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হতো। ৭ টি ভাগে ৭ জন নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিটমহলের নানা কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। বর্তমান চেয়ারম্যনরা হলেন মফিজার রহমান, তছলিম উদ্দিন, আব্দুল খালেকত, সিরাজুল ইসলাম, আলতাফুর রহমান, শফিকুল ইসলাম কাজল, রাব্বুল আলম। বাংলাদেশ হয়ে গেলে শান্তিকমিটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
ছিটমহলের বাসিন্দারা দুর্বল আর পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠি। ৩৬ সিটমহলে প্রায় ৬ হাজার শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। নেই খাবার, নেই চিকিৎসা, নেই নাগরিক সুযোগ-সুবিধা। প্রসুতি মায়েরাও ঠিকমতো খাবার বা চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত। দেওয়া হয় না কোন টিকা। মাতৃ সুরক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই।
প্রতিবন্ধীদের সুস্পষ্ট কোন হিসেব নেই। নেই হাসপাতাল, নেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নাগরিকত্বের অভাবে চাকরি-বাকরির সুযোগ হয়নি কোথাও। গড়ে ওঠেনি কলকারখানা। ভাঙ্গাচোরা রাস্তা। নেই বিদ্যুৎ। প্রার্থনালয়গুলো কোনোমতে বাসের খুঁটি ও বেড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকে বলেছেন নামাজ পড়তে পড়তে বৃষ্টি শুরু হলে ভিজে ভিজেই নামাজ শেষ করতে হয়।
অনেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতোই বাস করছে ছিটমহলবাসী। প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে তারা ছুটে যায় ক্ষেতের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে। তাদের বিয়েতে হয় না কোনো নিবন্ধন। রাষ্ট্রীয় কোন প্রশাসনিক কাঠামো না থাকায় ছিটমহলগুলো হয়ে উঠেছিল অপরাধের অভয়াশ্রম। হতাশা আর শিক্ষার অভাবে অনেকেই নানা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন। আইনি জটিলতার কারনে প্রশাসনের লোকজনও ছিটমহলগুলোতে ঢুকতে পারতো না। ফলে বাংলাদেশের অনেক সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামিও নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিত ছিটমহলে। দীর্ঘদিনের এই সমস্যা সমাধান হতে যাচ্ছে। যদিও সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পর্যায় এখনও শুরু হয়নি, তবে ঘোষণাতেই খুশির চাঁদ উঠেছে নানা সমস্যায় জর্জরিত পঞ্চগড়ের ৩৬ ছিটমহলে। মানুষজন ঢোল-তবলা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় আনন্দমিছিল করছে।
বিডি-প্রতিদিন/১০ মে ২০১৫/ এস আহমেদ