মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর দেশটির সামরিক বাহিনীর অমানবিক নির্যাতন এবং নির্মমতা অব্যাহত থাকায় শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে ছুটে আসছে। বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিকে ফাঁকি দিয়ে রাতের আঁধারে তারা সীমান্ত অতিক্রম করে প্রবেশ করছে। দালালদের সহায়তায় এসব অনুপ্রবেশকারী কুতুপালংসহ কয়েকটি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
গত শুক্রবার আরও ১০টি রোহিঙ্গা পরিবার এই শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়। ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার জানিয়েছেন, শুক্রবার বিকালে ৩৪ জন মিয়ানমার নাগরিককে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর লোমহর্ষক নির্যাতনের কথা জানিয়েছেন দেশটি থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন মিয়ানমারের নাগরিক আবদুল মজিদ (৪৭)। তিনি জানান, সে দেশে রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের মাত্রা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ কেউই রেহাই পাচ্ছেন না তাদের হাত থেকে। চোখের সামনে স্বজনদের ক্ষতবিক্ষত লাশের সাক্ষী হয়েছেন অনেকে। ধর্ষণের শিকার হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারীর আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে উঠেছে সে দেশের আকাশ-বাতাস। সামরিক বাহিনী তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে সম্পদ লুট করেও ক্ষান্ত হচ্ছে না। তারা হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তাদের বর্বরতা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির নিষ্ঠুরতা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশ সীমান্তে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকেই স্বামীহারা, কেউবা মা-ছেলে-সন্তানহারা। এদের মধ্যে শুক্রবার ভোরে কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তিতে আশ্রয় নেওয়া মংডুর জামবুনিয়া রাঙ্গাবালি গ্রামের স্বামীহারা জরিনা খাতুন (৫৫) জানান, রাতের আঁধারে সেনাসদস্যরা অতর্কিতভাবে তাদের গ্রামে এসে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। এ সময় প্রাণ বাঁচাতে কে কোথায় গেছে তার জানা নেই। এ পরিস্থিতিতে কোনোক্রমে নূর ফাতেমা (৭), সাহেনা (৬) ও হাসিনা (৫) নামে তিন নাতনি নিয়ে পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের জঙ্গলে তিনি আশ্রয় নেন। পরে ঝিম্মংখালী সীমান্ত পথ ধরে তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। তিনি আরও জানান, মোহাম্মদ শাহ আলম (১৭), নূর সালাম (১৫), হামিদ হোসেন (১২) ও আমান উল্লাহ (১০) নামে তার চার ছেলের ভাগ্যে কী ঘটেছে তিনি জানেন না। শুক্রবার সকালে কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তি ঘুরে দেখা যায়, ১০টি রোহিঙ্গা পরিবারের অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। মংডু পোয়াখারী নয়াপাড়া থেকে আসা মোহাম্মদ ইউনুছ (২৫) জানান, তারা রাতে ভাত খাওয়ার সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা গ্রামে ঢুকে গুলিবর্ষণ করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় বাড়ির বাইরে এসে তিনি দেখেন, মানুষ ছোটাছুটি করে পালাচ্ছে। সে ও তার স্ত্রী তসলিমা (২২) এবং দুই সন্তান মোহাম্মদ ইদ্রিস (৪) ও হাবিবা (৩)-কে নিয়ে পার্শ্ববর্তী ধান ক্ষেতে লুকিয়ে থাকেন। পরদিন রাতের আঁধারে টেকনাফ উপজেলার নয়াপাড়া ঘাট দিয়ে তারা বাংলাদেশে আসেন। তিনি জানান, নাফ নদ পার হওয়ার সময় নৌকাওয়ালারা জনপ্রতি ৩০ হাজার টাকা ভাড়া আদায় করেছে।মিয়ানমারের মংডু খেয়ারীপাড়া গ্রামের বয়োবৃদ্ধ আলি আহমদ (৬০) জানান, তাদের পাড়াটি জ্বালিয়ে দেওয়ার কারণে তারা পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানেও সেনাবাহিনী বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়। তিনি কোনোমতে পালিয়ে আসতে সক্ষম হলেও তার পরিবারের সাত সদস্যের কোনো খোঁজ নেই। একই এলাকার আবদুল হামিদ (২৬) জানান, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বিজিপির সদস্যরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরুষদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আর যুবতী নারীদের ধর্ষণ করছে। তিনি কোনো রকমে প্রাণ বাঁচিয়ে হেঁটে হোয়াইক্যং সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। তবে তার পরিবারের ছোট ছোট ছেলেমেয়েসহ স্ত্রী ছেনুয়ারা কোথায় আছে তিনি জানেন না।
এদিকে সীমান্তে কড়াকড়ি থাকলেও টেকনাফের কিছু চিহ্নিত দালাল রোহিঙ্গা মাথাপিছু ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে সহায়তা করছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার জানান, সীমান্ত এলাকায় অনুপ্রবেশ রোধে চেষ্টা করা হচ্ছে। বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে যেসব রোহিঙ্গা রাতের আঁধারে অনুপ্রবেশ করেছে তাদের আটক করে পুশব্যাক করা হচ্ছে। উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আবুল খায়ের জানান, অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্পে ঢুকতে না পারে সে জন্য ক্যাম্পের বাইরে সার্বক্ষণিক পুলিশের সতর্ক নজরদারি রয়েছে। গত ২৫ নভেম্বর কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত পরিদর্শনে আসেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন। টেকনাফে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, মিয়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতি বিশ্ববাসী দেখছে। বিজিবির দায়িত্ব সীমান্ত পাহারা দেওয়া। বিজিবি অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরপরও বিজিবি সীমান্ত থেকে যেসব রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠাচ্ছে তাদের মানবিক সহযোগিতা দিয়ে থাকে।
টেকনাফে রোহিঙ্গা শিশুর মৃত্যু : টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গতকাল মায়ের কোলে মারা গেছে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা শিশু জানে আলম। নিকটস্থ গোরস্থানে শিশুটিকে দাফন করা হয়। অসহায় মা নূর বেগম জানান, মিয়ানমার আরাকান রাজ্যের উত্তর জামবইন্যা গ্রামের অধিবাসী এই নারীর সাড়ে পাঁচ মাস বয়সী শিশু পুত্র জানে আলম। মিয়ানমার বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রাণ বাঁচাতে একমাত্র শিশুপুত্র ও অবিবাহিত এক বোনকে নিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে বন-জঙ্গল পাড়ি দিয়ে ২০ জনের দলটি টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উঞ্চিপ্রাং ঘাট দিয়ে গভীর রাতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। নূর বেগমের স্বামী জামাল হোসেনকে মিয়ানমার বাহিনী ২০ দিন আগে ধরে নিয়ে গেছে। তিনি আর ফিরে আসেননি। অপর দুই শিশুপুত্র মো. হাশিম (৫) এবং জাফর আলমকে (৩) মায়ের চোখের সামনে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে হত্যা করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান হাফেজ মো. আয়ুব জানান, গতকাল পর্যন্ত শুধু লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই দুই হাজারেরও বেশি অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা নারী-শিশু এবং স্বল্প সংখ্যক পুরুষ নিজ নিজ আত্মীয়স্বজনের বাসায় আশ্রয় নিয়েছে। প্রতিদিনই বাড়ছে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা। তারা নয়াপাড়া নিবন্ধিত ক্যাম্প, উখিয়ার কুতুপালং নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প, কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছাড়াও কক্সবাজার, মহেশখালী, নাইখ্যংছড়িসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে।