শুক্রবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ফের কেন আলোচনায় বিচারপতি সিনহা

মনগড়া কথা ক্ষমতা হারানোর অন্তর্জ্বালা থেকে : কাদের

প্রতিদিন ডেস্ক

ফের কেন আলোচনায় বিচারপতি সিনহা

এস কে সিনহার বইয়ের প্রচ্ছদ

হঠাৎ করেই আবার বিতর্কে জড়ালেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। ‘অ্যা ব্রোকেন ড্রিম : রুল অব ল, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’ (একটি স্বপ্ন ভঙ্গ : আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র) নামে একটি আত্মজীবনীমূলক বই হঠাৎ প্রকাশ করে তিনি নতুন বিতর্কের জন্ম দিলেন। কারও প্ররোচনায় তিনি এই মুহূর্তে বই প্রকাশ করলেন কি না তা খতিয়ে দেখছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার বইয়ে সরকারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করেছেন, সেগুলো ‘মনগড়া কথা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। গতকাল বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বিচারপতি সিনহা কেন আগে এসব বলেননি। দেশে ফিরে তিনি কেন জনগণের মুখোমুখি হচ্ছেন না। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘তিনি (বিচারপতি সিনহা) সাবেক হয়ে গেছেন। সাবেক হওয়ার অন্তর্জ্বালা আছে। কী পরিস্থিতিতে সাবেক হয়েছেন তা সবাই জানে।

বইটি গত ১৮ সেপ্টেম্বর আমাজনের কিন্ডেল ভার্সন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। মুদ্রিত আঙ্গিকে ৬১০ পৃষ্ঠার গ্রন্থটি আগামী ২৩   সেপ্টেম্বর বাজারে আসবে বলে জানা গেছে। গ্রন্থটির প্রকাশনা উপলক্ষে নিউইয়র্কে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজনও করা হতে পারে শিগগিরই। বইয়ে সিনহার করা অভিযোগ অস্বীকার করে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, ‘এখন বইতে যা লিখেছেন, তখন তা বলার সৎ সাহস একজন বিচারপতির কেন ছিল না? এখন বিদায় নিয়ে কেন পুরনো কথা নতুন করে বলছেন, যা খুশি তাই বলছেন।’ ক্ষমতা হারালে অনেক রকম ‘অন্তর্জ্বালা’ তৈরি হয় মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘তিনি যদি সত্যই বলতেন, তাহলে যখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন তখন বললেন না কেন? সত্য কথা দেশের জনগণের মাঝে এসে বললেন না কেন? এখন বিদেশে বসে আপন মনে ভুতুড়ে কথা ছাপছেন। এটা আমাদের ও দেশের মানুষের বিশ্বাস করতে হবে?’ বিচারপতি সিনহা তার বইয়ে দাবি করেন, বাংলাদেশের একটি সংস্থার হুমকি ও ভীতি প্রদর্শনের মুখে তিনি দেশ ছেড়েছেন। মি. সিনহার পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছিল ২০১৭ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত একটি মামলার আপিলের রায়কে কেন্দ্র করে। এ রায় নিয়ে সৃষ্ট প্রেক্ষাপটে একই বছরের ১৩ অক্টোবর তিনি রীতিমতো বোমা ফাটিয়ে বিদেশে চলে যান। দেশত্যাগের সময় সাংবাদিকদের দেওয়া বিবৃতিতে সিনহা বলেছিলেন যে, তিনি অসুস্থ নন। তবে সরকারের তরফ থেকে তখন বলা হয়েছিল, বিচারপতি সিনহা অসুস্থ। তাই তিনি চিকিৎসার জন্য ছুটি নিয়ে বিদেশে যাচ্ছেন। সিনহার ছুটির মেয়াদ শেষ হলে গত বছরের ১১ নভেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিচারপতি সিনহা পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। পদত্যাগ করার পর বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ ওঠার কথা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ওইসব অভিযোগের কারণে আপিল বিভাগের অন্য বিচারকরা আর প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বসে মামলা নিষ্পত্তিতে রাজি নন। সেসব অভিযোগ নিয়ে দুদক পরে অনুসন্ধানও শুরু করে। বিচারকদের নিয়ন্ত্রণে সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে যে ক্ষমতা দিয়েছে, শৃঙ্খলা বিধির নামে বিচারপতি সিনহা তা কেড়ে নিতে চেয়েছিলেন বলে অভিযোগ করে আসছিলেন সরকারের মন্ত্রী আর আওয়ামী লীগের নেতারা। সেই সময়ের কথা তুলে ধরে বিচারপতি সিনহা তার বইয়ে লিখেছেন, ‘পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী, তার দলের লোকজন এবং সরকারের মন্ত্রীরা আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। আইনমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সদস্যরা আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ আনতে থাকেন।’ ওই সময় তাকে বাসভবনে আটকে রাখা হয় এবং আইনজীবী ও বিচারপতিদের তার সঙ্গে দেখা করতে বাধা দেওয়া হয় বলেও বইয়ে অভিযোগ করেন এস কে সিনহা। এস কে সিনহা বলেন, ‘আমাকে যখন কমপ্লিটলি হাউস অ্যারেস্ট করা হলো, তখন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিদিন একজন করে ডাক্তার আমার কাছে পাঠানো হতো। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না।’ ‘এর মধ্যে একটি সংস্থার প্রধান এলে বললেন, হ্যাঁ, আপনাকে বলা হলো আপনি বিদেশ যাবেন, আপনি যাচ্ছেন না।’

‘আমি বললাম : কেন যাব আমি বিদেশে ?’

‘আপনি চলে যান, আপনার টাকা পয়সার আমরা ব্যবস্থা করছি।’

‘আমি বললাম, এটা হয় না, আমি আপনাদের টাকা নেব না। আর আপনারা বললেই আমি ইয়ে করব না। আমি চাই সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমি আলাপ করি। ব্যাপারটা কি হয়েছে আমি জানতে চাই। তিনি বলেন যে প্রধানমন্ত্রী আপনার সঙ্গে কথা বলবেন না।’

সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ছিলেন বাংলাদেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রথম প্রধান বিচারপতি। প্রধান বিচারপতি হিসেবে তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি এবং পদত্যাগ করেন ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর। তার স্বাভাবিক অবসরে যাওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি। ১৯৭৪ সালে তিনি সিলেট জেলা আদালতে আইনজীবী হিসেবে পেশা শুরু করেন এবং এক পর্যায়ে ঢাকা হাই কোর্টে প্র্যাকটিস করতে সিলেট ত্যাগ করেন। তিনি মূলত ফৌজদারি অপরাধ মামলা লড়তেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৯৯ সালের ২৪ অক্টোবর তাকে হাই কোর্ট ডিভিশনের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর ওই বছরের ১৬ জুলাই তাকে আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ করা হয়। প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক অবসরে গেলে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে প্রধান বিচারপতি করা হয়। বিচারপতি এসকে সিনহা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির প্যাটারসন সিটিতে বাস করছেন। তার সঙ্গে রয়েছেন তার স্ত্রী সুষমা সিনহা ও ছোট ভাই ডা. অনন্ত কুমার সিনহা। তার দুই কন্যার মধ্যে জ্যেষ্ঠ সূচনা সিনহা অস্ট্রেলিয়ায় এবং ছোট কন্যা ডা. আশা সিনহা কানাডায় বসবাস করেন। দুজনই বিবাহিতা। এস কে সিনহা যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেন এবং গত ১৯ মে নিউইয়র্ক এসাইলাম অফিসে তার সাক্ষাৎকার  নেওয়া হয়। তার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন ডিপার্টমেন্ট অব  হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে বলে জানা যায়।

সর্বশেষ খবর