মঙ্গলবার, ১২ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

হামলা বর্জন বিতর্কের ডাকসু

কুয়েত মৈত্রী হলে বস্তাভর্তি ব্যালট, লিটন নন্দী ও নুরুকে লাঞ্ছিতের অভিযোগ

জুলকার নাইন, আকতারুজ্জামান ও নাসিমুল হুদা

হামলা বর্জন বিতর্কের ডাকসু

হাতে হাতে ব্যালট পেপার নিয়ে ছাত্রীদের বিক্ষোভ। শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের মুখে প্রো-ভিসি মুহাম্মদ সামাদ -রোহেত রাজীব

প্রার্থীর ওপর হামলা, জালভোট, দফায় দফায় ভোট গ্রহণ স্থগিত আর ছাত্রলীগের প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রসংগঠনগুলোর নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে গতকাল অনুষ্ঠিত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন।  গতকাল সকালে ভোট শুরুর আধাঘণ্টার মধ্যেই ধরা পড়ে যায় আগের রাতে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দ্বারা সিল মারা ব্যালট পেপার। পরে একে একে বিভিন্ন হলে ব্যালট পেপার তসরুপের অভিযোগ ওঠে।

এ ছাড়া হল শাখার ছাত্রলীগের নেতাদের বাধার মুখে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও ভোট দিতে পারেননি অনেক অনাবাসিক ছাত্রছাত্রী। কেন্দ্র পরিদর্শনে এসে হামলায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ প্যানেলের সহ-সভাপতি (ভিপি) পদপ্রার্থী নুরুল হক নুরু। এ ছাড়া হামলার শিকার হয়েছেন বামজোটের ভিপি প্রার্থী লিটন নন্দী ও স্বতন্ত্র জোটের ভিপি প্রার্থী অরণি সেমন্তি খান। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল দুপুরের পর রোকেয়া হলের সামনে বিক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীদের ধাওয়ার মুখে পড়েন প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক এস এম মাহফুজুর রহমান। তাকে ছাত্রছাত্রীরা তাড়া করতে করতে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ পর্যন্ত নিয়ে যান। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও প্রার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ তুলে দুপুরের দিকে একযোগে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, বামপন্থি জোট, স্বাধিকার স্বতন্ত্র জোট, স্বতন্ত্র জোটসহ নির্বাচনে অংশ নেওয়া বিভিন্ন প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এ ছাড়া স্বতন্ত্রভাবে সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী এ আর এম আসিফুর রহমানও নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে আজ ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দিয়ে সব পরীক্ষা ও ক্লাস বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন তারা। সংবাদ সম্মেলনে বামজোটের ভিপি প্রার্থী লিটন নন্দী বলেন, ‘এই জালিয়াতি ও প্রহসনের নির্বাচন বাতিল করে পুনঃতফসিল ঘোষণা করতে হবে। নতুনভাবে ভোট হতে হবে একাডেমিক ভবনে। সেই নির্বাচনে ব্যালট বাক্স হতে হবে স্বচ্ছ।’ পরে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে ভোট জালিয়াতির প্রতিবাদে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস বর্জন কর্মসূচির ডাক দেন এ আর এম আসিফুর রহমান। গতকাল সকালেই কুয়েত-মৈত্রী হলে পাওয়া যায় বস্তাভর্তি সিল মারা ব্যালট পেপার। হল সংসদের বিভিন্ন প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অভিযোগ, আগের রাতে এসব ব্যালটে সিল মারা হয়েছে। এই ঘটনায় হলে বিক্ষোভ শুরু করে সাধারণ ছাত্রীরা। খবর পেয়ে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ড. মুহাম্মদ সামাদ এবং প্রক্টর এ কে এম গোলাম রাব্বানী হলে গেলে তাদের অবরুদ্ধ করে রাখেন তারা। একপর্যায়ে ওই হলের ভোটগ্রহণ সাময়িক স্থগিত করেন প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা। কুয়েত-মৈত্রী হল সংসদের জি এস প্রার্থী আরশিয়া তাবাসসুম কাব্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ভোটগ্রহণ শুরুর আগে ব্যালট বাক্স দেখতে চাচ্ছিলেন তারা। কিন্তু হল কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই দেখাতে রাজি হচ্ছিলেন না। পরে সকাল ৯টার দিকে হলের রিডিং রুমের পাশের একটি কক্ষ থেকে একবস্তা সিল মারা ব্যালট পেপার উদ্ধার করেন তারা। সেগুলোর সবই ছিল ছাত্রলীগের প্রার্থীদের পক্ষে ভোট দেওয়া ব্যালট। এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রাব্বানী। পরে হল প্রাধ্যক্ষ ড. শবনম জাহানকে সাময়িক অব্যাহতি দিয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রাধ্যক্ষ হিসেবে মাহবুবা নাসরীনকে  নিয়োগ দেওয়া হয়। ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। প্রায় তিন ঘণ্টা বিরতির পর আবারও ভোটগ্রহণ শুরু হয়। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ শুনে ভোটকেন্দ্রের পেছনের প্রবেশদ্বার দিয়ে হল প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করতে যান বাম জোটের ভিপি প্রার্থী লিটন নন্দী। এই খবর পেয়ে হল শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হলগেটে তার ওপর হামলা করে। এ সময় তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। পরে হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়ার হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। একই সময় রোকেয়া হলে তিনটি ব্যালট বাক্স উধাওয়ের খবর পাওয়া যায়। ওই হলের আবাসিক ছাত্রী সমাজসেবা সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী ইয়াসমিন আক্তার অভিযোগ করেন, মোট নয়টি ব্যালট বাক্সে ভোট গ্রহণ হওয়ার কথা থাকলেও ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার সময় ছয়টি ব্যালট বাক্স দেখানো হয়। বাকি তিনটি ব্যালট বাক্স খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে জানা যায়, ভোটকেন্দ্রের পাশের একটি কক্ষে ওই তিনটি ব্যালট বাক্স রাখা হয়েছে। পরে ছাত্রীরা কক্ষটির দরজা ভেঙে ওই তিনটি ব্যালট বাক্স বের করে বাইরে নিয়ে আসেন। তারা ওই ব্যালট বাক্সগুলোর তালা ভেঙে কয়েক বান্ডিল ব্যালট পেপার ভরা অবস্থায় দেখতে পান। তবে সেগুলোয় ভোট দেওয়া ছিল না। কেন এত ব্যালট পেপার ‘লুকিয়ে’ রাখা হয়েছিল দায়িত্বশীলদের কেউ এর সদুত্তর দিতে পারেননি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেলা সাড়ে ১১টার পর থেকে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে হলে আসেন ছাত্রলীগ, কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া সাধারণ শিক্ষার্থী অধিকার আন্দোলনের প্রার্থীসহ আরও বেশ কয়েকজন প্রার্থী। পরে সেখানে সাধারণ শিক্ষার্থী অধিকার আন্দোলনের ভিপি প্রার্থী নুরুল হক নুরুকে মারধর করেন রোকেয়া হলের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। পরে তাকে ল্যাবএইড হাসপাতালে নেওয়া হয়। সকাল ৮টা থেকে সব হলে একসঙ্গে ভোট শুরুর কথা থাকলেও ব্যালট বাক্স সিলগালা করা নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও প্রভোস্টের বাদানুবাদে রোকেয়া হলে ভোটগ্রহণ শুরু হতে এক ঘণ্টা দেরি হয়। পরে ‘লুকিয়ে রাখা’ তিন ব্যালট বাক্স উদ্ধারের পর উ™ভূত পরিস্থিতিতে দুপুরে স্থগিত হয়ে যায় ভোটগ্রহণ। বিকাল সাড়ে তিনটায় পুনরায় শুরু হওয়া ভোটগ্রহণ চলে পাঁচটা পর্যন্ত। ততক্ষণে অন্য হলগুলোতে ভোট গণনাও ছিল শেষের পথে।

সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের তাড়া খেলেন প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা : রোকেয়া হল থেকে বের হওয়ার পর গেটে জড়ো হওয়া সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীসহ সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের তাড়ার মুখে পড়েন প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. এস এম মাহফুজুর রহমান। এ সময় বিক্ষুব্ধরা তাকে ঘিরে ‘ভোট চোর, ভুয়া ভুয়া, জোচ্চোর ও দালাল’ বলে স্লোগান দিতে থাকে। রোকেয়া হল গেট থেকে কলাভবন পর্যন্ত তাড়া করে নিয়ে যায় তারা। পরে সেখান থেকে অন্য সহকর্মীরা অধ্যাপক মাহফুজকে রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ে নিয়ে যান। আর বিক্ষুব্ধরা ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান নেয়। 

মামলার হুমকি ছাত্রলীগের : ডাকসু নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করতে রোকেয়া হলে ‘নাটক’ হয়েছে দাবি করে বাম সংগঠনগুলোর প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ছাত্র ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী, কোটা আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ভিপি প্রার্থী নুরুল হক নুরের নামে মামলা করেছে ছাত্রলীগ। গতকাল রাতে শাহবাগ থানায় মামলাটি দায়ের করা হয়।

পুলিশ ছিল সহায়কের ভূমিকায় :  সকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ পুলিশের উপস্থিতি থাকলেও কোথাও সরাসরি হস্তক্ষেপ করেনি তারা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্দেশনায় সহায়কের ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে পুলিশকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশমুখগুলো থেকে শুরু করে রাতের ফলাফল ঘোষণাস্থল সিনেট ভবন পর্যন্ত সবখানে প্রক্টরিয়াল বডি ও স্কাউট সদস্যরাই ছিলের মুখ্য ভূমিকায়। 

সাংবাদিক লাঞ্ছিত : ডাকসু নির্বাচনে এস এম হলের ভোট গ্রহণের সংবাদ সংগ্রহের সময় লাঞ্ছিত হয়েছেন দৈনিক আমাদের সময়ের প্রতিবেদক হাবিব রহমান। জানা গেছে, ভোট না দিতে পেরে সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের সামনে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করছিলেন। এ সময় ভিডিও করতে গেলে এই সাংবাদিককে বাধা দেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পরও ক্যামেরা বন্ধ করতে বাধ্য করেন তারা। এ সময় অকথ্য ভাষায় গালাগালও করেন ছাত্রলীগের কর্মীরা। এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)। হামলাকারীদের দ্রুত শনাক্ত করে বিচারের মুখোমুখি করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের উদ্বেগ : কলঙ্কিত নির্বাচন বাতিল ও পুনঃতফসিল ঘোষণা করে নতুন করে ডাকসু  ও হল সংসদ নির্বাচনের দাবিতে বিবৃতি দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের প্যানেল সাদা দল। বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘ভোটের আগের রাতে একটি সংগঠনের প্রার্থীদের পক্ষে ভোট দিয়ে বস্তা ও ব্যালট বাক্স ভরে রাখার মতো নির্লজ্জ জালিয়াতি ও নানা গুরুতর অনিয়মের মাধ্যমে ডাকসু নির্বাচনকে কলঙ্কিত করা এবং গোটা জাতি ও বিশে^র সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় ভূমিকাকে ভূলুণ্ঠিত করার ঘটনার আমরা তীব্র নিন্দা ও জোর প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা এ কলঙ্কিত ও প্রহসনের নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করছি। সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম প্রচারিত বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন অর্ধ শতাধিক শিক্ষক।

সর্বশেষ খবর