শনিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

সবাইকে কাঁদিয়ে নুসরাতের শেষ যাত্রা

তহুরা আলী

চলে গেল নুসরাত জাহান রাফি। এ সমাজ, সমাজের বিবেক, মনুষ্যত্ব এবং মানবতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ঝলসে যাওয়া শরীর ও ততধিক ঝলসে যাওয়া হৃদয় নিয়ে এ নষ্ট পৃথিবী ছেড়ে। বাবা-মায়ের একমাত্র কন্যাসন্তান রাফিরও তো স্বপ্ন ছিল এ পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বাঁচার, সুন্দর সুখের নীড় গড়ার, হয়তো আরও অনেক কিছু। বাবা-মা তাকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য পাঠিয়েছিলেন একটি প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে, যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান একজন অধ্যক্ষ। যার দায়িত্ব একজন অভিভাবকের, দায়িত্ব ছিল প্রতিষ্ঠানে সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখা, যেখানে যেন কন্যাসম অথবা ভগ্নিসম ছাত্রীরা নিরাপদে-নির্ভয়ে তাদের শিক্ষা চালিয়ে যেতে পারে। যেখানে তারা প্রতিষ্ঠানের ভিতরে এমনকি বাইরেও সুরক্ষিত থাকে, কারও দ্বারা নিগৃহীত না হয়। সেখানে কী হলো- রক্ষকই ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো। অধ্যক্ষের বিকৃত লালসার শিকার হলো ফুলের মতো নিষ্পাপ মেয়েটি। প্রতিবাদ করায় অধ্যক্ষের ছত্রছায়ায় পালিত দুর্বৃত্তদের দ্বারা তাকে আগুনে পুড়িয়ে নৃশংসভাবে নিস্তব্ধ করে দেওয়া হলো, থামিয়ে দেওয়া হলো তার প্রতিবাদের ভাষা। এর আগেও এই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শিশু ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল। মাদ্রাসার বহু ছাত্রী তার যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিল। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, মাদ্রাসার গভর্নিং বডির কি কোনো দায়িত্ব ছিল না এর প্রতিকার করার? এলাকার সচেতন, হৃদয়বান মানুষ কি পারত না এই অনাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে? তাহলে আজ হয়তো রাফিকে অকালে চলে যেতে হতো না। ছোটবেলায় মা-বাবার কাছে শোনতাম, শিক্ষককে শ্রদ্ধা কর, ভক্তি কর, কারণ মা-বাবার পরেই শিক্ষকের স্থান। আজ আমরা কী দেখছি। এ কোন সামাজিক ব্যাধি, যা সংক্রামক রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও এ ধরনের নিষ্ঠুর অপকর্ম ঘটে চলেছে। আমরা কি প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছি? আমাদের বিবেক কি ভোঁতা হয়ে গেছে? এ কোন দেশে আমরা বসবাস করছি, যেখানে প্রধানমন্ত্রীকে সব বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্য অঙ্গগুলোর কি কোনো দায়িত্বই নেই? যেখানে নারী উন্নয়নের মহান ব্রত নিয়ে তিনি প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছেন। পৃথিবীতে আজ বাংলাদেশে নারী উন্নয়নের জয়জয়কার, সেখানে কিছু সংখ্যক দুর্বৃত্তের লোভ-লালসা ও হিংস্রতার জন্য এ দেশের সুনামে কলঙ্কের ছাপ পড়বে? লজ্জায় মাথা নত হয়ে যায়, যখন শুনি রাফিকে পুড়িয়ে দেওয়ার এই নৃশংসতায় দুজন নারীও যুক্ত ছিল। বিকৃত মানসিকতার এই আসামিকে নির্দোষ প্রমাণ করতেও নাকি অনেকে সহযোগিতা করছে। এমনকি একজন আইনের লোকও মৃত্যুপথযাত্রী, অসহায় মেয়েটির কাছ থেকে আত্মহত্যার স্বীকারোক্তি নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিল। সম্মান জানাই রাফির মা-বাবাকে, যারা শত হুমকির মধ্যেও কোনো প্রলোভনে আপস করেননি।

আহ্বান জানাই দেশের সমগ্র নারী-পুরুষকে, আসুন আমরা রুখে দাঁড়াই এই নিষ্ঠুর অমানবিক কর্মকান্ডে র হোতাদের বিরুদ্ধে। রক্ষা করি আপনার-আমার সন্তানদের। নতুবা বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো এই দুষ্টচক্র ভাসিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের সততা, মানবতা, মূল্যবোধের অস্তিত্বকে। লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর