বুধবার, ৮ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

সিরিয়া-ফেরত মুতাজের কী পরিকল্পনা ছিল

সাখাওয়াত কাওসার

জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির সদস্যদের সংগঠিত করতে কাজ করছিল সিরিয়া-ফেরত মুতাজ আবদুল মজিদ কফিল উদ্দীন বেপারী ওরফে মুতাজ (৩৩)। একই সঙ্গে আঁকা হয়েছিল ভয়ঙ্কর ছক। ধরা পড়ার আগেও মুতাজসহ পাঁচ-ছয়জনের একটি দল নাশকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে রবিবার বিকালে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ১০ নম্বর রোডের বায়তুন নূর জামে মসজিদের উত্তর পাশে যাওয়ার পাকা রাস্তার ওপর অবস্থান করছিল। তবে মুতাজ গ্রেফতার হয়ে যাওয়ায় ওই দিনের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। গ্রেফতারের পর সোমবার থেকে চার দিনের রিমান্ডে থাকা মুতাজের দেওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে এসব জানিয়েছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। তবে মুতাজের কাছ থেকে এরই মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদায় করা হয়েছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। জানা গেছে, সিরিয়া থেকে পালিয়ে এসে অবৈধভাবে তুরস্কে অবস্থানের কারণে সে দেশের পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। ১ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক সরকার মুতাজকে বাংলাদেশগামী বিমানে তুলে দেয়। দেশে ফিরে মুতাজ বসবাস করে আসছিল উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর সড়কের একটি ভবনের চতুর্থ তলার একটি ফ্ল্যাটে। ওই ফ্ল্যাটটি ঠিক করে দিয়েছিল মুতাজেরই মতাদর্শের লোকজন। সৌদিতে জন্ম নেওয়া মুতাজ এবারই প্রথম বাংলাদেশে আসে। ২০১৪ সালে সৌদিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করে সে। তবে জন্মের পর এবারই প্রথম বাংলাদেশে আসে মুতাজ। বাবা আবদুল মজিদ বেপারীর গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের সখীপুর থানার রশিদ বেপারীকান্দিতে। বাবা বাংলাদেশি হলেও মুতাজের মা হালিমা পাকিস্তানি। সিটিটিসির অতিরিক্ত উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, রিমান্ডে মুতাজকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তবে সে অনেক কিছুই এড়িয়ে যাচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে তার কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদায় করা সম্ভব হবে। মুতাজের সঙ্গে কাদের যোগাযোগ হয়েছিল এ ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ২০১৮ সালে সৌদি আরব থেকে মুতাজ সিরিয়ায় গিয়ে আইএসের হয়ে যুদ্ধে অংশ নেয়। তবে ২০১৬ সাল থেকে সে কয়েক দফায় তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করছিল। সিরিয়ায় আইএসের পতন হলে সে পুনরায় তুরস্কে আসে। সেখান থেকে ইউরোপের কোনো দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছিল সে। তবে তুরস্ক পুলিশের নজর এড়াতে ব্যর্থ হয় মুতাজ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, শ্রীলঙ্কার ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় যারা অংশ নিয়েছিল, তাদের অনেকেই আইএসের হয়ে ইরাক ও সিরিয়ায় যুদ্ধ করতে গিয়েছিল। আইএসের পতন শুরু হলে তারা নামে-বেনামে নিজ দেশ শ্রীলঙ্কায় ফিরে যায়। শ্রীলঙ্কায় হামলার পর থেকে বাংলাদেশের নাগরিক ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাগরিক, যারা ইরাক-সিরিয়ায় আইএসের হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল, তারাও দেশে ফিরে নাশকতা করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল। ২০১৬ সালে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরীর পরিকল্পনায় গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়ে দেশি-বিদেশি ২২ জন নাগরিককে হত্যা করা হয়। তামিমও ২০১৩ সালের অক্টোবরে ঢাকায় আসার আগে কানাডা থেকে বিভিন্ন সময় ইরাক-সিরিয়ায় গিয়েছিল। উত্তরা পশ্চিম থানায় করা মামলার এজাহার ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতারের পর মুতাজের কাছ থেকে একটি পাসপোর্ট (বিই-০০৪৯৬৯৬), সৌদি আরবের একটি আইডি কার্ড, সৌদি আরবের ড্রাইভিং লাইসেন্স, একটি আইফোন, ‘কাফিরের জন্য রক্ত আপনার জন্য লাল’ শিরোনামে আইএসের ম্যাগাজিন রুমিয়াহর চার পাতার একটি রচনার বাংলা অনুবাদ, ‘খিলাফত ঘোষণা ও বাংলাদেশ’ শিরোনামের ছয় পাতার একটি আর্টিকেল, আরবিতে লেখা ৫০ পাতার নথিপত্র এবং স্ম্যাসিং বর্ডারস ব্ল্যাক ফ্ল্যাগ ফর্ম সিরিয়া রেভ্যুলেশন ২০১১ থেকে ২০২০ লেখা ১০৭ পাতার একটি বই উদ্ধার করা হয়। জানা গেছে, মুতাজ বাংলা বলতে পারে না। সে ইংরেজি ও আরবিতে কথা বলে। দেশে ফিরে খিলাফত সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য ভয়ংকর পরিকল্পনা করতে থাকে মুতাজসহ তার সহযোগীরা। বিদেশি একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে ঢাকায় মুতাজের অবস্থান সম্পর্কে প্রথমে তথ্য পায় সিটিটিসি। এর পর থেকেই তাকে খুঁজতে সব ধরনের চেষ্টা চালায় সংস্থাটি। ২০১৪ সালের ৩০ জুন ইরাক ও সিরিয়ায় জঙ্গি সংগঠন আইএস খিলাফত ঘোষণা করলে বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশ থেকে সরাসরি এবং বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকেই আইএসের হয়ে যুদ্ধ করতে ইরাক ও সিরিয়ায় যায়। সিটিটিসির কাছে এমন অন্তত ৪০ জনের একটি তালিকা রয়েছে। তবে তাদের অনেকে এরই মধ্যে বিভিন্ন অভিযানে মারা গেছে। বাকিরা সেখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছে বলে সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম।

সর্বশেষ খবর