সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিশ্ব দেখছে বাংলাদেশ ম্যাজিক

টাইগার ইকোনমির অগ্রযাত্রা নিয়ে বিস্ময়, আগ্রহের কেন্দ্রে সোনার বাংলার সামাজিক অগ্রগতি

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

আধুনিক বিশ্বের অন্যতম কারিগর জাপানে মে মাসে সফরে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টোকিওতে শীর্ষ বৈঠকে উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। একেবারে প্রথম দেখায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবে জানতে চান, ‘বাংলাদেশের সাফল্যের ম্যাজিকটা কী?’ প্রধানমন্ত্রী জবাবে খানিকটা রসিকতার সুরে বলেন, ‘ম্যাজিক তো সবার সামনে বলা যাবে না। পরে কোনো একান্ত বৈঠকে জানাব।’ দেড় মাসের মাথায় প্রায় একই পরিস্থিতির উদ্ভব হয় চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সোনার বাংলাদেশের বিস্ময়কর অগ্রযাত্রার রহস্য জানতে চেয়ে প্রশ্ন করেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।

শুধু এই দুই বিশ্বনেতাই নন, ‘টাইগার ইকোনমি’র পেছনের ম্যাজিক নিয়ে একাধারে বিস্ময় ও উচ্ছ্বাস শোনা যায় অর্থনীতির বিশ্লেষকদের কণ্ঠেও। কারণ পাকিস্তানি দুঃশাসনের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করার পর মাত্র কয়েক কোটি টাকার বাজেট নিয়ে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশ আজ পাঁচ লাখ কোটিকেও ছাড়িয়ে গেছে। অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার কমে অর্ধেক হয়ে গেছে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে মেয়েদের অবদানের হার দ্রুত বেড়েছে। জনসংখ্যা, গড় আয়ু, শিশুমৃত্যুর হার, মেয়েদের স্কুলে পড়ার হার, সক্ষম দম্পতিদের জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের হার ইত্যাদি সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ সমপর্যায়ের উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশ, এমনকি প্রতিবেশী ভারতকেও পেছনে ফেলতে সমর্থ হয়েছে। পাকিস্তানিরা আজ বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা।

হংকং সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন- এইচএসবিসির সর্বশেষ গ্লোবাল রিসার্চে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) নিরিখে বিশ্বের ২৬তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান যেখানে ৪২তম। ‘দি ওয়ার্ল্ড ইন ২০৩০ : আওয়ার লং টার্ম প্রজেকশনস ফর ৭৫ কান্ট্রিজ’ শিরোনামের এই রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, ২০১৮ সাল থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ১৬ ধাপে উন্নীত হবে, যা অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় অধিক। অর্থনৈতিক উন্নয়নের এ তালিকায় বাংলাদেশের পরই ফিলিপাইন, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ার নাম এসেছে। প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিক থেকে উন্নত দেশ নরওয়ের চেয়েও বাংলাদেশের অধিক সম্ভাবনা রয়েছে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকলে বর্তমান বাংলাদেশের ৩০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি ২০৩০ সালে পৌঁছে যাবে ৭০০ বিলিয়ন ডলারে। জিডিপির হিসাবে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। ক্রয়ক্ষমতার বিবেচনায় ৩৩তম। আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয় অবস্থানে।

অর্থনীতি ও আর্থ-সামাজিক, বেশির ভাগ সূচকে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে গেছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশকে। নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে ছাড়িয়েছে তো অনেক আগেই। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, একটি জনবহুল ও নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যেভাবে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও বৈষম্য কমানোকে সংযুক্ত করেছে, তা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন উদাহরণ দেওয়ার মতো একটি দেশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, ২০০৯ সালে বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত। তাদের মধ্যে প্রায় তিন কোটি মানুষ ছিল চরম দরিদ্র অবস্থায়। এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে সোয়া তিন কোটিরও কম মানুষ। গত শতকের নব্বইয়ের দশকেও বাংলাদেশে ৫৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। এখন করছে মাত্র ২১.৩ শতাংশ। অতি দারিদ্র্যের হার কমে নেমেছে ১১.৩ শতাংশে। ২০১৭ সালে দেশের সার্বিক দারিদ্র্যের হার ছিল ২৩.১ শতাংশ, আর অতি দারিদ্র্যের হার ছিল ১২.২ শতাংশ। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি যে হারে হচ্ছে, তাতে ২০২৩ সালের আগেই দারিদ্র্য হার শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। অতি দারিদ্র্যের হার ৫ শতাংশের কম হলেই তা শূন্য দারিদ্র্য হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১০ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুযায়ী, তখন দেশের সার্বিক দারিদ্র্যের হার ছিল সাড়ে ৩১ শতাংশ। ২০১৬ সালের জরিপে তা কমে নেমে আসে ২৪.৩ শতাংশে। বিগত এক দশকে দারিদ্র্য হার কমেছে ব্যাপকভাবে। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিই মূলত মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে এর পেছনে।

সর্বশেষ খবর