শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
পদ্মা সেতু

স্বপ্ন নয়, বাস্তবেই দৃশ্যমান

কাজ শেষ হয়েছে তিন কিলোমিটারেরও বেশি, শেষ হবে ২১ সালের জুনে

নিজামুল হক বিপুল, জাজিরা থেকে ফিরে

স্বপ্ন নয়, বাস্তবেই দৃশ্যমান

জাজিরা প্রান্ত থেকে তিন কিলোমিটার দৃশ্যমান পদ্মা সেতুর। ড্রোন ক্যামেরায় তোলা ছবি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটারের একটা স্বপ্ন। একটু একটু করে যাচ্ছে সামনের দিকে। দেখতে দেখতে এখন মাঝ বরাবর চলে এসেছে। দিন যত গড়াচ্ছে স্বপ্নটাও তত বাস্তব হয়ে উঠছে। আর কয়েক মাস অপেক্ষা। তারপর পুরোপুরি ডানা মেলবে এই স্বপ্ন। উল্লাস আর উচ্ছ্বাসে মেতে উঠবে গোটা জাতি। দূরত্ব কমে যাবে এক অঞ্চলের সঙ্গে আরেক অঞ্চলের। অর্থনীতির চাকা ঘুরবে দ্রুত বেগে। বাড়বে জীবনযাত্রার মান। এই স্বপ্নের নাম ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু’। পদ্মার বুক চিরে যার একপ্রান্ত ছুঁয়ে থাকবে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া। অন্যপ্রান্ত শরীয়তপুরের জাজিরা। 

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পদ্মায় সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেতু নির্মাণের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত জাপানি অর্থ সহায়ক সংস্থা (জাইকা) সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করে। ওই সময়েই ২০০১ সালের ৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর ওপর সেতু নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। যার মধ্য দিয়ে সেতু নির্মাণের বীজ বপন করা হয়। মাঝখানের ৮ বছর খুব একটা অগ্রগতি না হলেও ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত হয় নকশা চূড়ান্তকরণের কাজ। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ২০১৪ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতু নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে নিজস্ব অর্থায়নে পুরোদমে শুরু হয় সোয়া ছয় কিলোমিটারের স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ। সরেজমিন গত বুধবার দেখা যায়, পদ¥ার বুকে যে স্বপ্ন যাত্রা শুরু হয়েছিল তার বাস্তব রূপ দিতে কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। প্রতিদিন প্রায় ছয় হাজার শ্রমিক এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে ঘাম ঝরাচ্ছেন। পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের মূল সেতুর অর্ধেক কাজ শেষ হয়ে গেছে। পদ্মা সেতুতে থাকছে ৪২ পিয়ার (পিলার)। যার মধ্যে ৩৬টির নির্মাণ হয়ে গেছে। বাকি আছে মাত্র ছয়টি পিয়ারের কাজ। এগুলো হলো- ৮, ১০, ১১, ২৬, ২৭ ও ২৯ নম্বর পিয়ার। ৮, ১০, ১১ ও ২৯ নম্বর পিয়ারের কাজ এক মাসের মধ্যেই শেষ হবে। বাকি দুটির কাজ সম্পন্ন হবে এপ্রিল মাসের মধ্যে। প্রকল্প সূত্র জানায়, ৪১টি স্প্যানের মধ্যে ২১টি স্প্যান বসানো হয়েছে। ফলত নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর তিন কিলোমিটারেরও বেশি দৃশ্যমান। স্প্যান বসানো বাকি আছে ২১টি। এর মধ্যে ১৪টি স্প্যান দেশে এসেছে এবং রেডি। বাকি পাঁচটি মার্চের মধ্যে দেশে চলে আসবে। জুলাই মাসের মধ্যেই পিয়ারের ওপর সব স্প্যান বসিয়ে দেওয়া হবে।

শুধু পিয়ার তুলে আর স্প্যান বসিয়েই সেতুর কাজ অর্ধেক হয়ে গেছে, এমন নয়। সেতুর একটা অংশে রেল স্ল্যাব ও সড়ক স্ল্যাব বসানোর কাজও চলছে পুরোদমে। জাজিরা প্রান্তে সেতুর ওপরে উঠে দেখা গেছে, ভূমি থেকে প্রায় ১৩ তলার সমান উচ্চতায় সেতুর ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন। আর নিচ দিয়ে চলবে দোতলা ট্রেন। সেই দুই স্তরেই স্ল্যাব বসানোর কাজ চলছে। দেশি-বিদেশি শ্রমিকরা ভারী যন্ত্রপাতির মাধ্যমে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সমানে স্ল্যাব বসানোর কাজ করছেন।

সেতুর রেলপথে বসবে মোট দুই হাজার ৯৫৯টি স্ল্যাব। যার সবগুলো এরই মধ্যে প্রস্তুত করা হয়ে গেছে। এর মধ্যে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত জাজিরা প্রান্তে বসানো হয়েছে ৪৯৫টি। এই স্ল্যাবের ওপর বসবে রেলের পাটাতন ও রেললাইন। অপর দিকে সেতুর ওপরে সড়কভাগে স্ল্যাব বসবে মোট দুই হাজার ৯১৭টি। এর মধ্যে দুই হাজার ১১৭টি স্ল্যাব প্রস্তুত হয়ে গেছে। বাকি ৮০০ স্ল্যাব তৈরির কাজ চলছে। ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত জাজিরা প্রান্তে সড়কপথের স্ল্যাব বসেছে ১৮৭টি। কর্মরত শ্রমিকরা জানান, প্রথম দিকে এসব স্ল্যাব বসাতে একটু সময় লাগলেও এখন প্রতিদিন গড়ে ছয় থেকে সাতটি স্ল্যাব বসানো যাচ্ছে। প্রকল্প সূত্র জানায়, খুব শিগগির একসঙ্গে চারটি টিম স্ল্যাব বসানোর কাজ শুরু করবে। তখন অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৩২টি স্ল্যাব বসানো যাবে। এতে করে কাজের গতি বেড়ে যাবে। প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, ২০২১ সালের ৩০ জুনের মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পের সড়ক অংশের কাজ পুরোপুরি শেষ করে যানচলাচলের জন্য খুলে দেওয়া যাবে। এখন পর্যন্ত এটি হচ্ছে কাজ শেষ করার সময়সীমা। তবে প্রকল্পের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, যদি কিছুটা সময় বেশি লাগে তাহলে তারা সেটা ব্যয় করবেন। কোনোভাবেই কাজের মানের প্রশ্নে আপস করবেন না। কারণ এটি হচ্ছে একটি স্থায়ী অবকাঠামো। হেলাফেলা বা তাড়াহুড়ো করা যাবে না।

সর্বশেষ খবর