দেশের করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যর্থতার দায়ে সংসদে বিরোধী দলের তোপের মুখে পড়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা) ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মধ্যে সমন্বয়হীনতার পাশাপাশি অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম-দুর্নীতি অভিযোগ তুলে ধরে সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেককে সরিয়ে দেওয়ারও দাবি করেছেন। একই সঙ্গে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীকে দেওয়ার দাবিও উঠেছে। এ ছাড়া সরকারের মন্ত্রী-এমপি-সরকারি কর্মচারী সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার দাবি জানান তারা।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ বাজেট অধিবেশনে গতকাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কার্যনির্বাহের জন্য সংযুক্ত তহবিল হতে অর্থ প্রদান ও নির্দিষ্টকরণের কর্তৃত্ব দানের জন্য আনীত দাবির ওপর ছাঁটাই প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা এসব দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এ সময় সংসদে উপস্থিত ছিলেন।
পরে জবাব দিতে দাঁড়িয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমন্বয়হীনতাসহ সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। এ সময় তিনি বিগত তিন মাসে করোনা মহামারী মোকাবিলায় তার মন্ত্রণালয়ের সফলতার দিকগুলো তুলে ধরেন। সবাই মিলে কাজ করেছে বলেই ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের চেয়ে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুহার কম বলেও দাবি করেন তিনি। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেলের দুর্নীতির অভিযোগও অস্বীকার করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
এর আগে মঞ্জুরি দাবির ওপর ছাঁটাই প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘আমাদের সবই করতে হয় প্রধানমন্ত্রীকে। প্রধানমন্ত্রীকে যদি সব করতে হয় তাহলে মন্ত্রণালয়-অধিদফতর এত কিছু রাখার দরকার নেই। রোজার মাসে দেখেছি চার ঘণ্টা প্রধানমন্ত্রী জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। করোনাকালে কীভাবে হাঁচি দিতে হবে তাও তিনি শেখাচ্ছেন। দূরত্ব রেখে কীভাবে থাকতে হবে, কী খেতে হবে তাও শেখাচ্ছেন। অথচ আমাদের স্বাস্থ্য অধিদফতর যদি হেলিকপ্টার দিয়ে লিফলেট গ্রামেগঞ্জে ছিটিয়ে দিত, তাতেও কিন্তু মানুষ সচেতন হতো। আমাদের অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। সমন্বয়হীনতার জন্য দেখেছি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন, তিনি জানেন না কোথায় কী হচ্ছে।’ বর্তমান সংকট মোকাবিলায় দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলো অধিগ্রহণ করার প্রস্তাবও দেন এই সিনিয়র পার্লামেন্টারিয়ান।
জাতীয় পার্টির আরেক সিনিয়র এমপি মুজিবুল হক চুন্নু করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সময়মতো পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাসের ২২ তারিখে পয়েন্ট অব অর্ডারে বলেছিলাম করোনার বিষয়ে। বলেছিলাম, এটা কী জিনিস? খায়, নাকি পরতে হয়? স্বাস্থ্যমন্ত্রী যেন প্রেস কনফারেন্স বা অন্য কোনোভাবে জানান, কী পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা তখন নেওয়া হয়নি। নেওয়া হলে এত গুরুতর অবস্থা হতো না।
প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনার স্বাস্থ্যমন্ত্রীর তো একবার ঢাকা মেডিকেলে, একবার সোহরাওয়ার্দীতে, হৃদরোগ হাসপাতালে, পিজিতে ভিজিট করা উচিত ছিল। আমি যখন নিজ উদ্যোগে হাসপাতালে গেলাম, আমাকে ডাক্তাররা বলেছেন, মন্ত্রী যদি আসতেন আমরা অনুপ্রাণিত হতাম।’ এ সময় তিনি সরকারের মন্ত্রী-এমপি-সরকারি কর্মচারী সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার দাবি জানান। মুজিবুর রহমান চুন্নু বলেন, যে-ই স্বাস্থ্যমন্ত্রী হোক, সাবেক বা বর্তমান, যারই যখন অসুখ করে তিনি যান সিএমএইচে। সরকারি হাসপাতালে যান না। আমার মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেওয়া উচিত এমপি, মন্ত্রী, সরকারি কর্মকর্তারা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেবেন। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বিদেশে যাবেন না।’ এ সময় যেসব বেসরকারি হাসপাতালগুলো এখনো রোগী ভর্তি করছে না, সেগুলোকে জবাবদিহির মধ্যে আনার দাবি জানান তিনি।
সুনামগঞ্জ-৪ আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় পার্টির এমপি পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ বলেন, ‘আগে থেকেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিয়ে কথা বলছিলাম। ৩৭ লাখ টাকার পর্দা। আগে থেকেই বলছিলাম। সর্বশেষ গতকাল প্রধানমন্ত্রী সংসদে বক্তব্য রেখেছেন। ডাক্তারদের ২০ কোটি টাকা থাকা-খাওয়ার বিল। সেখানে একটা কলার দাম ২ হাজার টাকা, একটা ডিমের দাম ১ হাজার টাকা এবং এক স্লাইস পাউরুটির দাম ৩ হাজার টাকা। করোনাকালেও এই অবস্থা!’
তিনি বলেন, এখন এই করোনা কালে এসে মন্ত্রণালয়ের দুরবস্থা দেখে সাধারণ মানুষ বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নাকি মিনা কার্টুনে পরিণত হয়েছে। আমাদের টিভিতে বাচ্চাদের জন্য মিনা কার্টুন নামে একটা কার্টুন দেখায়। মিনা কার্টুনে একটা টিয়াপাখি থাকে। এই টিয়াপাখি ঘুরে ঘুরে বেড়ায় আর কার্টুন চলতে থাকে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নাকি মিনা কার্টুনে পরিণত হয়েছে। এখন নাকি এই টিয়াপাখি দ্বারা চলছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নাকি তাই এখন এই খারাপ অবস্থা। পীর মিসবাহ বলেন, ‘আমরা কয়েক দিন আগে দেখেছি, জিম্বাবুয়েতে পিপিই ও কিট কেনার দুর্নীতির দায়ে দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’
এই সংসদ সদস্য বলেন, ‘আমি মফস্বলের মানুষ। সংসদ থাকলে এখানে ন্যাম ভবনে থাকি, না থাকলে আমি সুনামগঞ্জেই আমার এলাকায় থাকি। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নাই। সম্পর্কও নাই, খরাপ সম্পর্কও নাই। আমি গ্রামে থাকি, বাজারে বাজারে যাই, মানুষের সঙ্গে কথা বলি। সেখানে অনেক সাধারণ মানুষ বলেছেন, জেলা সদরে আইসিইউ নাই, অক্সিজেন নাই, আপনি প্রধানমন্ত্রীকে বলেন। আমি আপনার (স্পিকার) মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই, স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও দিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সাবেক মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর কাছে হস্তান্তর করার জন্য। এটা সাধারণ মানুষ, আমার এলাকার মানুষ বলেছেন প্রধানমন্ত্রীকে বলার জন্য। আমি শুধু প্রধানমন্ত্রীকে মানুষের এই কথাটি জানালাম।’
জাতীয় পার্টির রওশন আরা মান্নান স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি, করোনাভাইরাস মহামারী নিয়ে মন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করেন।
জাতীয় পার্টির আরেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য খারাপ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। স্বাস্থ্যমন্ত্রীরও চিকিৎসা প্রয়োজন।
বিএনপির এমপি হারুনুর রশীদ বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য। সুচিকিৎসার পূর্বশর্ত সঠিক রোগ নির্ণয়। টেকনোলজিস্টদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এরা সঠিক রোগ নির্ণয় করে ডাক্তারের কাছে রোগী পাঠায়। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অবকাঠামো আছে। কিন্তু টেকনোলজিস্টদের সংখ্যা এত সীমিত! ১২টার পর পরীক্ষার সুযোগ থাকে না। এটা ভাবতে হবে। ২৪ ঘণ্টা পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে গরিব-সাধারণ মানুষ সেবা পাবে। মন্ত্রণালয়েরও আয় বাড়বে।
তিনি আবারও অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাদের সম্পূর্ণ চিকিৎসা ব্যবস্থা ভারতনির্ভর হয়ে গেছে। এক কোটির ওপর মানুষ ভারতে চিকিৎসার জন্য যায়। এই চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। সংকটগুলো ঠিক করতে হবে। করোনায় মানুষ মারা যাচ্ছে। কিন্তু আক্রান্ত মানুষদের জন্য কতটুকু ব্যবস্থা করতে পারছি, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। আজকে এত সমালোচনা সে জন্যই। ছয় মাস হয়ে গেল বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি। ২৩% পজিটিভ আসছে। ফলাফল আসছে ৫-৭ দিন পর। প্রতিদিন সকালে দুঃসংবাদ শুনি। যথাসময়ে ফলাফল পেলে আক্রান্ত কম হতো।’ এ সময় তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতরের সমন্বয়হীনতা দ্রুত সংস্কার করার দাবি জানান।
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        