রবিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

ব্যবসা সহজীকরণ সংস্কার কত দূর

সব সেবা মিলছে না ওয়ানস্টপ সার্ভিসে, বিনিয়োগের শুরুতেই দৌড়াতে হয় নানা সংস্থায়

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার বিনিয়োগ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিদ্ধান্ত ছিল, ব্যবসা শুরুর জন্য বিভিন্ন দফতরের সেবা দেওয়া হবে একই ছাতার নিচ থেকে। এ জন্য গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ওয়ানস্টপ সার্ভিস পোর্টাল (ওএসএস) চালু করে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। লক্ষ্য ছিল দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সব সেবা দেওয়া হবে একই স্থান থেকে। এরই মাঝে প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে গেছে, ওএসএস এখনো পরিপূর্ণ সেবা দিতে পারছে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত ছিলÑ মন্ত্রণালয়গুলোর অধীনস্থ যেসব সংস্থার কার্যক্রম ওয়ানস্টপ সার্ভিসের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাদের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করবে বিডা। যাতে একই ছাতার নিচ থেকে সেবাটি দেওয়া যায়। সমঝোতা করতে করতে বছর ঘুরে, আলোচনা হয়, ব্যবসা সহজীকরণ কার্যক্রমের সংস্কার হয় না।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যবসা শুরুর প্রাথমিক ধাপে পাঁচটি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে এখনো ভিন্ন ভিন্ন চারটি প্রতিষ্ঠানে ঘুরতে হয় উদ্যোক্তাদের। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে এ সমস্যাটি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,  ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপানের উদ্যোক্তারাও সরকারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক আলোচনায় ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রে বিভিন্ন দফতরে আবেদনের বিষয়টি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকেও এই সেবাগুলো একই ছাতার নিচে নিতে বারবার তাগাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে কিছু কিছু সেবা অনলাইনে পাওয়া গেলেও এখনো এসব সেবা ওয়ানস্টপ সার্ভিসে মেলে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে ব্যবসা বা বিনিয়োগ কার্যক্রম শুরু করতে যে পাঁচটি কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয় সেগুলো হচ্ছেÑ ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ, টিন নম্বর গ্রহণ, কোম্পানির নামের অনাপত্তি, কোম্পানি নিবন্ধন এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা। এই পাঁচটি ধাপের কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য উদ্যোক্তাদের যথাক্রমে স্থানীয় সরকার বিভাগ (সিটি করপোরেশন), এনবিআর, আরজেএসসিঅ্যান্ডএফ এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এই চারটি সংস্থার দ্বারস্থ হতে হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী এসব সেবা বিডার ওয়ানস্টপ সার্ভিস থেকে একবার ফি প্রদানের মাধ্যমে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও এখনো তা কার্যকর হয়নি। বিডার কর্মকর্তারা জানান, এগুলো হচ্ছে ব্যবসা শুরুর প্রাথমিক কার্যক্রম। শুরুতেই যখন উদ্যোক্তাদের চার থেকে পাঁচটি দফতরে দৌড়াতে হয়, তখন তারা নিরুৎসাহিত হয়ে যান। এরপর রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ, গ্যাস সংযোগ, জমি রেজিস্ট্রেশনসহ আরও জটিল বিষয়গুলো। জানা গেছে, গত ১৩ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ব্যবসা সহজীকরণ সূচক সংক্রান্ত জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটির অনলাইন সভায় এসব বিষয়ে অসন্তোষ উঠে আসে। সেখানে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যবসা শুরুর জন্য চারটি ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার প্রয়োজন হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে পৃথকভাবে আবেদন করতে গিয়ে বিনিয়োগকারীদের সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এ কারণে বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হন। একটি স্থান থেকে একবার ফি প্রদানের মাধ্যমে ব্যবসা শুরুর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ব্যবস্থা নেওয়া হলে দেশি-বিদেশি সকল বিনিয়োগকারী বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন।’ কর্মকর্তারা বলছেন, ধীরে ধীরে হলেও তারা কিছু কিছু কার্যক্রম বিডার ওয়ানস্টপ সার্ভিসে যুক্ত করছেন। গত আগস্টে নতুন ৩টি সেবা ওএসএস সেন্টারে যুক্ত হয়েছে। এর ফলে ওএসএস পোর্টালের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সার্ভার থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই, সুরক্ষা সেবা বিভাগ থেকে বিদেশি নাগরিকদের অনুকূলে সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র সেবা পাওয়া যাবে। অনলাইন ওয়ানস্টপ সার্ভিসের আওতায় বিডার নিজস্ব ১৪ সেবা এবং অন্যান্য ছয়টি প্রতিষ্ঠানের সাতটি সেবাসহ মোট ২১টি সেবা প্রদান করা হবে। আগামী বছরের মধ্যেই ৩৫টি সেবা প্রদানকারী সংস্থার ১৫০টি সেবা দেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদফতর, রাজউকসহ ১২টি সংস্থার সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। আরও ১০টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই নিয়ে আলোচনা চলছে। যত দ্রুত এসব কার্যক্রম সম্পন্ন হবে তত দ্রুত বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত হবে।

সংস্কারে বাধা কোথায় : সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিশ্বব্যাংকের ইজি অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮তম। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান বাদে বাকি সব দেশের অবস্থান একশর নিচে। অর্থাৎ তারা ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশে অনেক এগিয়ে আছে। প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দুই অঙ্কে নিয়ে আসার লক্ষ্যে সূচকভিত্তিক একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কোন মন্ত্রণালয় কী ধরনের সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে সেটি উল্লেখ করার জন্য মন্ত্রণালয়গুলোতে একটি ছকও পাঠানো হয়েছে বিডা থেকে। কিন্তু সেই ছক পূরণ করে ফেরত পাঠায়নি অধিকাংশ সংস্থা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন দফতরের সেবা কার্যক্রম ওয়ানস্টপ সার্ভিসে সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়গুলোর আগ্রহ থাকলেও দফতর বা সংস্থাগুলো কর্তৃত্ব হারানোর আশঙ্কা করছে। ফলে তারা সংস্কারের বিষয়ে জাতীয় কমিটির সভায় ইতিবাচক মতামত দিলেও ফিরে গিয়ে সে বিষয়ে আর আগ্রহ দেখায় না। আর এতেই ঝুলে যায় যাবতীয় সংস্কার। উদাহরণ দিয়ে কর্মকর্তারা জানান, ব্যবসা শুরুর আগে ট্রেড লাইসেন্সের জন্য প্রথমে আবেদন করতে হয় স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনস্থ সংস্থা সিটি করপোরেশনে। এসব সংস্থায় এখনো পুরোপুরি ই-ট্রেড লাইসেন্স কার্যক্রম শুরু হয়নি। গত মাসে জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটির সভায় এ বিষয়ে অগ্রগতি জানতে চাওয়া হলে স্থানীয় সরকার বিভাগ জানায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন অনলাইনে ই-ট্রেড লাইসেন্স কার্যক্রম শুরু করলেও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এখনো এ কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। চট্টগ্রামে অনলাইন কার্যক্রম শুরু করতে সময় লাগবে। এ ছাড়া আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় এবং যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদফতরের (আরজেএসসিঅ্যান্ডএফ) সেবা বিডার ওএসএসের সঙ্গে সংযুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও এটি আটকে আছে ভেন্ডর নিয়োগ প্রক্রিয়ায়। বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন সভায় জানিয়েছেন, আরজেএসসিঅ্যান্ডএফের ছাড়পত্র, কোম্পানি নিবন্ধন এবং ফি প্রদান কার্যক্রম এই তিনটি সেবা অনলাইনের মাধ্যমে পৃথক পৃথক আবেদনের মাধ্যমে করা হচ্ছে। এসব সেবা একটি আবেদনের মাধ্যমে নিষ্পন্ন করতে আরও দুই মাস সময় লাগবে। মিউনিসিপ্যালিটি এলাকায় স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে ধার্যকৃত ট্যাক্স ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। স্থানীয় সরকার বলছে, এটি পরিবর্তন করতে হলে সারা দেশের জন্যই করতে হবে। ভ্যাট ফেরত প্রদান প্রক্রিয়ার সময় হ্রাসকরণ এবং অর্থনৈতিকভাবে বিপদগ্রস্ত কোম্পানির ভ্যাট কমানো বিষয়ে এনবিআর বলেছে এতে রাজস্ব আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মন্ত্রণালয় সংস্থাগুলোকে ধরে বেঁধে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করলেই ওয়ানস্টপ সার্ভিস কার্যকর করা যাবে না। এখানে নানা ধরনের কায়েমি স্বার্থ জড়িত, যারা তাদের নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে চায় না। তিনি বলেন, অটোমেশনে ধীরগতি আছে। কিন্তু এটিও অনেকে করতে চায় না। এর পেছনে আর্থিক অনিয়ম জড়িত। সিটি করপোরেশনে ট্রেড লাইসেন্স আর বিআরটিএ থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স যাই বলা হোক না কেন প্রতিটি ক্ষেত্রে টাকা ছাড়া দ্রুত কাজ করা অসম্ভব। এই আর্থিক লেনেদেনে প্রথম সারির কর্মচারী জড়িত থাকলেও এর ভাগ যায় পেছনের সারিতে। যতদিন এই ভাগ-বাটোয়ারা বন্ধ করা না যাবে, ততদিন একই ছাতার নিচ থেকে সব সেবা মিলবে না।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর