বুধবার, ৭ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা
বাংলাদেশি পরিবারের ছয় লাশ উদ্ধার, মা বাবা বোন নানিকে হত্যার পর দুই ভাইয়ের আত্মহত্যা ধারণা পুলিশের

অজানা হতাশায় রক্তাক্ত টেক্সাসের বাড়ি

লাবলু আনসার, যুক্তরাষ্ট্র

অজানা হতাশায় রক্তাক্ত টেক্সাসের বাড়ি

ছবির কেউই এখন আর বেঁচে নেই। বাংলাদেশি পরিবারটির সদস্যদের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার তদন্তে নেমেছে পুলিশ -ফাইল ছবি

যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে বাংলাদেশি একটি পরিবারের ছয় সদস্যের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধারণা করছে, দুই ভাই মিলে তাদের মা-বাবা, নানি এবং একমাত্র বোনকে হত্যার পর নিজেরাও আত্মহত্যা করেছেন। কারণ দুই ভাই একটি ‘সুইসাইড নোট’ রেখে গেছেন। এই নোট থেকে মনে করা হচ্ছে, তারা হতাশায় ভুগছিলেন। পরিবারকে লজ্জা ও কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য দুই ভাই সবাইকে হত্যা করে নিজেরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। সম্ভবত, গত শনিবার এই নৃশংসতার                  ঘটনা ঘটেছে। তবে পুরো ঘটনা উদ্ধারে তদন্ত করছে পুলিশ।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব নর্থ টেক্সাসের সচিব নাহিদা আলী বলেন, ঘটনার সময় ওই বাড়িতে তৌহিদুল ইসলাম (৫৬), তার স্ত্রী আইরিন ইসলাম নীলা (৫৫), দুই ছেলে তানভীর তৌহিদ (২১) ও ফারহান তৌহিদ (১৯), মেয়ে পারভীন তৌহিদ (১৯) ও তৌহিদের শাশুড়ি আলতাফুন্নেসা (৭৭) ছিলেন। তারা সবাই মারা গেছেন। এর মধ্যে পারভীন পড়তেন নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে। সপ্তাহখানেক আগে তাকে নিউইয়র্ক থেকে বাসায় নেওয়া হয়। ফারহান গত বছর ভর্তি হয়েছিলেন অস্টিনের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসে। তানভীরও পড়তেন ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের অস্টিনে। তার এবারই গ্র্যাজুয়েশনের কথা। ফারহান আর পারভীন ছিলেন যমজ। আর আলতাফুন্নেসার গত সপ্তাহে বাংলাদেশে ফেরার কথা ছিল। করোনাভাইরাস জটিলতায় তা স্থগিত হয়ে যায়। স্থানীয় গণমাধ্যমের খবর, ওই পরিবারের এক বন্ধু তাদের ফোন করে পাচ্ছিলেন না। এরপর তারা পুলিশে খবর দেন। যুক্তরাষ্ট্রের সময় রবিবার দিবাগত রাত ১টার দিকে নগরীর পাইন ব্লাফ ড্রাইভ এলাকার বাড়িটির দরজায় কড়া নাড়ে পুলিশ। পুলিশ ওই ঘরে ছয়জনের লাশ দেখতে পায়। বন্দুকের গুলিতে ছয়জন মারা গেছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। বাড়িটি থেকে বন্দুকও উদ্ধার করেছে পুলিশ। তবে প্রতিবেশীরা এ বিষয়ে জানতে পারেনি কিছুই। প্রতিবেশী ক্যারেন ফেল্লা বলেন, যথারীতি আমরা রবিবার কাজে গেছি। কিছুই বুঝিনি যে, ওরা কেউ আর বেঁচে নেই। ফেল্লা নিহত পরিবারের একমাত্র তরুণীর ব্যাপারে বলেন, সে খুবই মেধাবী ছাত্রী ছিল। আমার মেয়ের স্কুলেই পড়ত। কেভিন প্যাটেল (২৮) নামে আরেক প্রতিবেশী জানান, তারা সুখী পরিবার ছিল বলেই মনে হতো। সোমবার সকাল সাড়ে ৭টায় কাজ থেকে ফিরেই দেখি পুলিশের উপস্থিতি। অবাক হয়েছি ঘটনা জেনে। এলেন সিটি পুলিশের সার্জেন্ট জন ফেলি জানান, সম্ভবত শনিবার নৃশংস ঘটনাটি ঘটেছে। ১৯ বছর বয়সী একজনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস থেকে হত্যার পর আত্মহত্যার ঘটনা বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেখানে ঘটনার সঙ্গে রয়েছে হতাশার ধারাবিবরণী।

পরিবারের সন্তান ফারহান সেই সুইসাইড নোটে উল্লেখ করেছে, ২০১৬ সালে নবম গ্রেডে পড়াবস্থায় আমি বিষণœতায় আক্রান্ত হয়েছি বলে চিকিৎসক জানায়। এ জন্য আমি পরীক্ষায় ফেল করেছি। আজ আমি নিজের শরীরে দুবার কেটেছি। খুবই কষ্ট পেয়েছি। আমার মনে আছে, ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট, কাঁচির মতো ধারালো অস্ত্র দিয়ে শরীরে কেটেছিলাম। অনুভব করেছি কতটা অসহনীয় যন্ত্রণা। এরপর প্রায় দিনই শরীরে রান্নাঘরের চাকু দিয়ে কেটেছি। বিষণœতার দুঃখবোধ লাঘবের পথ খুঁজেছি। এ অবস্থায় আমার ঘনিষ্ঠ তিন বন্ধু আমাকে ত্যাগ করেছে। এমনি হতাশার মধ্যেই আমাকে ভর্তি করা হয় ইউনিভার্সিটি অব অস্টিনে কম্পিউটার সায়েন্স ডিপার্টমেন্টে। এরপর ভেবেছি যে, এবার জীবনটা সঠিক ট্র্যাকে উঠেছে। বাস্তবে তা ঘটেনি। বিষণœতায় জর্জরিত হয়ে পুনরায় আমি নিজের শরীর রক্তাক্ত করি এবং কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় ঘুমাতে যাই। এক পর্যায়ে সে লিখেছে, আমি যদি আত্মহত্যা করি তাহলে গোটা পরিবার সারাটি জীবন কষ্ট পাবে। সেটি চাই না। সে জন্য পরিবারের সবাইকে নিয়ে মারা যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে বড়ভাইকে শামিল করলাম। দুই ভাই গেলাম বন্দুক ক্রয় করতে। আমি হত্যা করব ছোট বোন আর নানিকে। আমার ভাই করবে মা-বাবাকে। এরপর উভয়ে আত্মহত্যা করব। কেউ থাকবে না কষ্ট পাওয়ার। আত্মহত্যার প্রাক্কালে লেখা ওই নোটে সে আরও উল্লেখ করেছে যে, বন্দুক ক্রয়ের ব্যাপারটি খুবই মামুলি। বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইনের নামে তামাশা চলছে সর্বত্র। বড় ভাই গেলেন দোকানে। বললেন যে, বাড়ির নিরাপত্তার জন্য বন্দুক দরকার। দোকানি কয়েকটি ফরম ধরিয়ে দিলে সেখানে স্বাক্ষর করলেন ভাই। এরপর হাতে পেলাম কাক্সিক্ষত বস্তুটি, যা দিয়ে নিজের কষ্ট এবং পরিবারের কষ্ট সহজে লাঘব করা যাবে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব নর্থ টেক্সাসের সচিব নাহিদা আলী জানান, আমরা সবাই সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ। এরই মাঝে এমন সংবাদে সবাই হতভম্ব। শোকাচ্ছন্ন গোটা কমিউনিটি। তৌহিদুল ইসলাম খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। তার স্ত্রী আইরিন ইসলাম নীলাও আসতেন কমিউনিটির অনুষ্ঠানে। সব সময় তারা দুই পুত্র তানভীর তৌহিদ এবং ফারহান তৌহিদকে নিয়ে উচ্ছ্বাস করতেন। একইভাবে মেধাবী মেয়ে পারভীন তৌহিদকে নিয়েও তার অহংকারের শেষ ছিল না। এমন একটি পরিবারের সবাই একই সঙ্গে নিঃশেষ হয়ে যাবে-এটি কল্পনারও অতীত ছিল। জানা যায়, প্রায় ২২ বছর আগে ডিভি ভিসায় তৌহিদুল ইসলাম আমেরিকায় আসেন। তৌহিদুল ইসলামের জন্ম ও বেড়ে ওঠা পুরান ঢাকায়। পরিবার নিয়ে প্রথম দুই বছর নিউইয়র্কে ছিলেন। ২০ বছর আগে তারা টেক্সাসে স্থানান্তর হন। প্রথমে তথ্যপ্রযুক্তিতে কাজ করলেও সম্প্রতি সিটি ব্যাংকের ভালো পদে কাজ করছিলেন তৌহিদুল। কমিউনিটির নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি ওই পরিবারকে জানতেন। ঘনিষ্ঠ লোকজন তৌহিদুল ইসলামের পরিবারকে আদর্শ বাংলাদেশি পরিবার বলেই জানতেন। নিহত আইরিনের এক ভাই নিউইয়র্কে থাকেন। দুঃসংবাদ পেয়ে তিনি টেক্সাসের পথে রওনা দেন। একইভাবে মায়ামিতে বসবাসরত তৌহিদুল ইসলামের ভাইও টেক্সাসের পথে রয়েছেন।

পাবনার বাড়িতে শোকের মাতম : পাবনা প্রতিনিধি জানান, যুক্তরাষ্ট্রে নিহত পরিবারটির সন্তানদের বাবার বাড়ি পুরান ঢাকায় হলেও মা আইরিন ইসলাম ও নানি আলতাফুন্নেসার বাড়ি পাবনায়। গতকাল স্বজনদের মৃত্যুর সংবাদ পাবনার বাড়িতে পৌঁছানোর পর শুরু হয়েছে শোকের মাতম। আকস্মিক এ মৃত্যুর খবরে সকাল থেকেই বাড়িতে ভিড় জমিয়েছেন স্বজন-প্রতিবেশীরা। তাদের কান্নায় পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছে। পাবনা শহরতলীর দোহারপাড়ার মেয়ে আইরিন ইসলামের সঙ্গে প্রায় ২৫ বছর আগে বিয়ে হয় পুরান ঢাকার তৌহিদুল ইসলামের। বিয়ের পর থেকেই আমেরিকা প্রবাসী এই দম্পতির দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে ছিল সুখী পরিবার। দুই বছর আগে পাবনা থেকে আলতাফুন্নেসাকে ডালাসে নিয়ে যান আইরিন। স্বজনরা জানান, ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ফারহান ও তানভীর। পরিবারেও নেই তেমন কোনো সংকট। হতাশার কারণে পরিবারের সবাইকে হত্যা করে তারা আত্মহত্যা করেছে এমন কথা মানতে পারছেন না কেউ। নিহত আলতাফুন্নেসার বড় ছেলে আরিফুর রহমান আলফা জানান, আমার বোন কেবল তার পরিবারই নয়, আমাদেরও সবকিছু দেখভাল করত। তার নিজের সংসারে কখনই অশান্তি ছিল না। ছেলে-মেয়েরাও প্রতিভাবান, মেধাবী ও ভদ্র। তারা বাবা-মায়ের পাশাপাশি সেখানে বেড়াতে যাওয়া তাদের নানিরও (আমার মা) যত্ন নিত। এমন ছেলেরা বাড়ির সবাইকে হত্যা করেছে তা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। স্বজনরা জানান, নিউইয়র্ক থেকে নিহত আলতাফুন্নেসার বড় ছেলে টেক্সাস পৌঁছলে তাদের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর