শুক্রবার, ৯ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

জিরো টলারেন্সে থাকবে সরকার

মুন্সীগঞ্জে হেফাজতের সমাবেশ স্থগিত, ১৪৪ ধারা, হাটহাজারীতে গ্রেফতার ৪

রফিকুল ইসলাম রনি

জিরো টলারেন্সে থাকবে সরকার

সহিংসতায় জড়িত হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে এগোবে সরকার। নাশকতা, সরকারি অফিস ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াওসহ সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে যারাই জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। এত দিন ‘ধীরে চলো’ নীতিতে থাকলেও এখন কোনো নাশকতা বরদাস্ত করবে না আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। ইতিমধ্যে জেলা-উপজেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। হেফাজতের যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকসহ ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় অন্তত চারটি মামলা হয়েছে। গতকাল মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে হেফাজত বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিলেও স্থানীয় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করায় পিছু হটে তারা। সরকারের নীতিনির্ধারণী একাধিক সূত্র জানায়, হেফাজত অনেক বাড়াবাড়ি করেছে। তাদের তান্ডবলীলা, সরকারি অফিস, ভূমি অফিস, থানা, বিভিন্ন ব্যক্তির বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, রেললাইনে অগ্নিসংযোগ, বাসে আগুন, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। রাজধানীর পল্টন থানায় হত্যাচেষ্টা ও বিস্ফোরক আইনে মামলা হয়েছে। মামলায় মামুনুল হকের বিরুদ্ধে নাশকতার হুকুমদাতা, বিস্ফোরণের হুকুমদাতা এবং নিরীহ মানুষকে হত্যাচেষ্টার হুকুমদাতা বলা হয়েছে।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ২৬, ২৭ ও ২৮ মার্চ ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ সারা দেশে নাশকতার পর থেকেই হেফাজত নেতা মামুনুল হকসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। তাদের গ্রেফতারের বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে পুলিশ সদর দফতরে আলোচনা হয়েছে। বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বৈঠকে তাদের গ্রেফতার করার বিষয়টি আলোচনা করা হয়। শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেফতারের পর ঢাকা শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন হতে পারে এ নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা আলোচনা করেছেন। এসব ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত তাদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছে। আবার বুঝে হোক, আর না বুঝে যেসব আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতারা নানাভাবে হেফাজতের পক্ষ নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হচ্ছে সাংগঠনিক ব্যবস্থা। ইতিমধ্যে চারজন ছাত্রলীগ নেতা, দুজন যুবলীগ এবং একজন আওয়ামী লীগ নেতাকে বহিষ্কারও করা হয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর ঘিরে ২৩ মার্চ থেকে হেফাজতে ইসলাম তান্ডব চালানো শুরু করে। শুক্রবার ঢাকায় বিক্ষোভের সময় সংঘাতের ঘটনার প্রতিবাদে ওই দিন বিকালে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে হামলা-ভাঙচুর চালান হাটহাজারী মাদরাসার ছাত্ররা। সেখানে সংঘর্ষের ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটে। এর প্রতিবাদ জানাতে ওই দিন বিকালেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রাস্তায় নামেন হেফাজতের কর্মীরা। তারা রেলস্টেশনে আগুন ধরিয়ে দেন এবং শহরে ব্যাপক তান্ডব চালান। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন একজন। হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনার প্রতিবাদে হরতালের ডাক দেয় হেফাজত। এর আগে শনিবার বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনকালে ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা ও ভাঙচুর চালান সংগঠনটির কর্মীরা। ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরুদ্ধে বায়তুল মোকাররমে আন্দোলন ও সহিংসতার ঘটনায় হেফাজত নেতা মামুনুল হকসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। পাশাপাশি দুটি মামলা হয়েছে সোনারগাঁয়ে রিসোর্টে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায়। এসব মামলায় মামুনুল হককে গ্রেফতার করা হতে পারে বলে বুধবার খবর ছড়িয়ে পড়ে। এ খবরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মামুনুল হকের মাদরাসার সামনে অবস্থান নেন ছাত্ররা। এখন পর্যন্ত যদিও তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। দেশের বিভিন্ন জায়গায় হেফাজতে ইসলামের সহিংস বিক্ষোভের সময় মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার (গতকাল) সিরাজদিখান উপজেলায় বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিয়েছিল সংগঠনটি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৪৪ ধারা জারির পর বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে পিছু হটেছে হেফাজতে ইসলাম। অন্যদিকে ‘শিশুবক্তা’ হিসেবে পরিচিত রফিকুল ইসলাম মাদানীকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গাজীপুরে তার মাদরাসায় তালা ঝুলছে। মাদানীকে বুধবার নেত্রকোনায় নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতারের পর গতকাল গাজীপুরের গাছা থানায় হস্তান্তর করে র‌্যাব। ১০ ফেব্রুয়ারি এক ওয়াজ মাহফিলে উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়। হেফাজতকে সরকার যে আর ছাড় দিচ্ছে না এমন আভাস পাওয়া যায় রবিবার সংসদের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে। প্রধানমন্ত্রী সেদিন বলেছিলেন, হেফাজত আগুন নিয়ে খেলছে। এক ঘরে আগুন লাগলে সেই আগুন অন্য ঘরেও চলে যেতে পারে। সেটা কি আপনাদের হিসেবে নেই! কিছু লোকের জন্য এই ধর্মে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের নাম জুড়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, এসব বরদাস্ত করা হবে না। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। অপকর্মের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রবিবার সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘সোনারগাঁ উপজেলার একটি বেসরকারি হোটেলে হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা মামুনুল হক একজন নারীকে নিয়ে অবস্থান করছিলেন। ওই ঘটনার পর দেখলাম ওই রিসোর্টের ওপর আক্রমণ। কেন এই আক্রমণ আমার জানা নেই। সেখানে কয়েকজন বিদেশি ছিলেন। পুলিশ ও বিজিবি গিয়ে তাদের রক্ষা করেছে।’ হেফাজতের তান্ডব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করে এ ধরনের তান্ডব কেন? নিশ্চয়ই এর কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। আমরা তদন্ত করে দেখছি। যারাই তান্ডব করে থাকুক তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছি।’ বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক অপশক্তি দেশের স্বস্তি ও শান্তি বিনষ্টে উঠেপড়ে লেগেছে। তারা একের পর এক তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার গণতন্ত্রের স্বার্থে সহনশীলতা দেখিয়েছে। কিন্তু আর ছাড় দেওয়া হবে না। হেফাজত আগুন নিয়ে খেলতে শুরু করেছে। ওই আগুনেই তাদের হাত পুড়ে শেষ হয়ে যাবে।’ এদিকে সরকারের পাশাপাশি হেফাজতকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করবে আওয়ামী লীগ। যেখানেই হেফাজতের নেতা-কর্মীরা নাশকতামূলক কর্মকান্ডে জড়িত হবেন সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সহিংসতায় জড়িত হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। সরকার ইতিমধ্যে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রতিটি জেলা-উপজেলায় কঠোরভাবে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড দমনে প্রশাসনকে সহায়তার জন্য দলীয় নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জামায়াত-শিবির হোক আর হেফাজত বা বিএনপি, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে অপশক্তিকে রোধ করা হবে। হেফাজতের এমন তান্ডব, অরাজকতা মেনে নেওয়া যায় না। সরকারের পাশাপাশি আমরা সাংগঠনিকভাবেও তাদের মোকাবিলা করব।’

হাটহাজারীতে চারজন গ্রেফতার : এদিকে হাটহাজারী থানা ভাঙচুরের ঘটনায় চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গতকাল রাত সাড়ে ৮টার দিকে তাদের গ্রেফতার করা হয় বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) আফজারুল হক টুটুল। তিনি জানান, হাটহাজারী থানা ভাঙচুর মামলায় চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, হাটহাজারী উপজেলায় ২৬ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত হেফাজতে ইসলামের বিক্ষোভকালে বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৩০ মার্চ রাতে থানায় ৬টি মামলা দায়ের করা হয়। হাটহাজারী থানায় ও ভূমি অফিসে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনায় দুটি এবং পুলিশকে আক্রমণ এবং উপজেলা ডাকবাংলো ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার অভিযোগে চারটি মামলা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর