শনিবার, ১ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

মে দিবস নেই তাদের জীবনে

শামীম আহমেদ

আজ মহান মে দিবস। খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে রক্তঝরা সংগ্রামের এক গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টির দিন। সারা বিশ্বের পাশাপাশি দ্বিতীয়বারের মতো করোনা মহামারীকে সঙ্গে নিয়ে দিনটি পালন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ক্ষুদ্র অণুজীবটির কারণে মানুষ আজ ঘরবন্দী। দেশজুড়ে চলছে লকডাউন। ক্ষুধায় কাতর কর্মহীন মানুষ। চারদিকে শুধু মৃত্যুর খবর। এর মাঝে সেই বিশেষ দিনটিতে এবার তাগিদ উঠেছে জীবন ও জীবিকা একসঙ্গে বাঁচানোর। শ্রমজীবী মানুষকে জরুরি ভিত্তিতে টিকা কার্যক্রমের আওতায় আনার দাবি তুলেছে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন।

এদিকে সারা বছর কঠোর পরিশ্রমের পর এই একটি দিন সব শ্রমজীবী মানুষের কাজকে ছুটি জানানোর দিন। তবে করোনার কারণে ছুটি নয়, অনেকে কর্মহীন হয়ে বসে আছেন ঘরে। আবার কারও জীবনে আজকের সূর্যও উঠেছে অন্যান্য দিনের মতো ব্যস্ততা নিয়ে। কারণ কাজ না করলে মিলবে না খাবার। মে দিবস উপলক্ষে সব সরকারি, আধাসরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হলেও সমাজের বৃহদাংশকেই সাতসকালে বেরিয়ে পড়তে হয়েছে রুটি-রুজির সন্ধানে। কারও আবার মেলেনি ছুটি। ছুটির দিনে কাজের জন্যও মেলে না তাদের বাড়তি অর্থ। অনেককেই আট ঘণ্টার স্থলে কাজ করতে হচ্ছে ১৪-১৫ ঘণ্টা। পান না ওভারটাইম। কেউ আবার মে দিবস কী জানেনই না। অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রম খাতের পাশাপাশি কিছু প্রাতিষ্ঠানিক খাতেও স্থান পায়নি মে দিবসের মর্মবাণী। শ্রমিক আন্দোলনের ১৩৫ বছরেও মে দিবস তাদের জীবনে বয়ে আনেনি কোনো তাৎপর্য। বেশ কয়েকজন শ্রমজীবী ও পেশাজীবীর সঙ্গে কথা বলে মে দিবস নিয়ে তাঁদের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হলো-

নির্মাণশ্রমিক : ‘বইয়া থাকলে কেউ ট্যাকা দিয়া যাইব? আমাগো কোনো মে দিবস নাই। মে দিবসে বড় বড় কোম্পানির কাম (নির্মাণকাজ) বন্ধ থাকে। অন্যগুলা চলে। আমার কাম আছে। তয় লকডাউনের কারণে কাম কইমা গেছে। অহন এক দিন কাম থাকলে দুই দিন থাহে না।’ কথাগুলো রাজধানীর ভাটারা এলাকার নির্মাণশ্রমিক নজরুল ইসলামের। গতকাল তিনি বলেন, ‘আগে কাম না থাকলে আখের রস বিক্রি করতাম। করোনার কারণে হেইডাও বন্ধ। অহন যে কাম পাই হেইডাই করি।’

পুলিশ : ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের খিলগাঁও থানায় সহকারী পুলিশ পরিদর্শক মো. ইলিয়াস হোসেন। ২০০১ সালে পুলিশে যোগদান করেন। তিনি বলেন, ‘মে দিবসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। পুলিশের ছুটি কাটানোর সুযোগ কোথায়? এদিন বিভিন্ন সভা-সেমিনার, র‌্যালি, মানববন্ধন থাকে। অন্য দিনের চেয়ে বেশি তৎপর থাকতে হয়। আবার লকডাউন বাস্তবায়নে মাঠে তৎপর থাকতে হচ্ছে। রোস্টার অনুযায়ী আমাদের দৈনিক আট ঘণ্টা ডিউটি। তবে মাঝেমধ্যেই নানা কর্মসূচি বা ভিআইপি ডিউটি করতে গিয়ে ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। পয়লা বৈশাখ, মে দিবস এসব পুলিশের জন্য আলাদা কোনো দিন নয়। ঈদের সময়ও তো আমরা মাঠে থাকি। এসব দিনে আরও বেশি কষ্ট করতে হয়। মানুষ বেড়ায়, আনন্দ করে। আমরা তাদের যাত্রা নিরাপদে কাজ করি।’

গৃহকর্মী : ‘মে দিবস কিতা? কামের বেডিগো ছুটি আছে? কন কী? কাম না করলে কেউ ভাত দিব? যাগো (যাদের) বাসায় রান্দি, আমি না গেলে হেরা খাইব কিতা? থালা-বাসন কেডা ধুইব? ছুটি কাটাইলে চাকরি থাকত না। বছরের হক্কল দিনই আমগো লাইগা সমান।’ রাজধানীর ভাটারার গৃহকর্মী ফরিদা আক্তার এভাবেই বলছিলেন মে দিবস নিয়ে তাঁর ভাবনার কথা। বন্যায় সম্পদ হারিয়ে চার বছর আগে স্বামীর হাত ধরে নেত্রকোনার বারহাট্টা থেকে রাজধানীতে এসে গৃহকর্মীর কাজ নেন তিনি। প্রতিদিন ১৫-১৬ ঘণ্টা কাজ করেন। তার পরও স্বামী ও তিন সন্তানকে নিয়ে একটি কক্ষে গাদাগাদি করে থাকেন। তাঁর কথায়, গৃহকর্মীর কাজে টাকা কম। সাপ্তাহিক ছুটি নেই। ওভারটাইম নেই। বছরের প্রতিটি দিনই তাঁদের জন্য সমান। এ ছাড়া যখন তখন কাজ চলে যায়। গত বছর লকডাউনে কয়েক মাস কাজ ছিল না। অনেক কষ্টে দিন কেটেছে। এ ছাড়া রিকশাচালক, পরিবহনশ্রমিক, হোটেল কর্মচারীসহ অসংখ্য পেশার মানুষের জীবনে নেই কোনো মে দিবস। নেই শ্রম অধিকার। নেই ওভারটাইম বা নির্ধারিত কর্মঘণ্টা। ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে থাকলেও দিনটিতে আজও বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শেষ হয়নি।

ইতিহাসে মে দিবস : দিনটি শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক সংহতির দিন। আট ঘণ্টা শ্রম অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ১৮৮৬ সালের ১ মে আন্দোলন চলাকালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তরতাজা ও কর্মোদ্যমী ১১ শ্রমিক। তিন বছরের মাথায় ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে শিকাগো ট্র্যাজেডিকে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই থেকে আজ অবধি শ্রমিকদের ন্যায়সংগত অধিকার আদায়ের সংগ্রামী চেতনার দিন হিসেবে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও মে দিবস উপলক্ষে নানান কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও শ্রমিক সংগঠন। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে পালিত হচ্ছে এবারের মে দিবসের কর্মসূচি। দিবসটি উপলক্ষে আজ দেশে সরকারি ছুটি। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি করোনায় জান ও কাজ বাঁচাতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্‌বান জানিয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পোশাকশ্রমিকদের করোনা টিকা ও পরীক্ষার ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছে। সংগঠনটি আজ সকাল ১০টায় আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের জামগড়া ফ্যান্টাসি কিংডমের সামনে, নারায়ণগঞ্জ শহরের ২ নম্বর রেলগেট এলাকায়, মিরপুর মিল্কভিটা মোড়ে, চট্টগ্রাম নিউমার্কেট মোড় দোস্ত বিল্ডিংয়ের পঞ্চম তলায় মওলানা ভাসানী মিলনায়তনে আলোচনা সভা এবং র‌্যালির আয়োজন করেছে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর