শনিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

মটকা আকৃতির প্রশাসন

♦ পিরামিড আকৃতিতে আনার চেষ্টা চলছে-জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ♦ জনবল কাঠামো পুনর্বিন্যাসের তাগিদ বিশেষজ্ঞদের

উবায়দুল্লাহ বাদল

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অনুমোদিত দুটি অতিরিক্ত সচিবের পদে বর্তমানে কাজ করছেন ১৪ জন কর্মকর্তা। আর ছয় যুগ্মসচিবের জায়গায় আছেন আটজন। একইভাবে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগেও দুজন অতিরিক্ত সচিবের পদে কাজ করছেন ছয় কর্মকর্তা। আর চার যুগ্মসচিব ও ১৩ উপসচিবের পদে কাজ করছেন যথাক্রমে ৮ ও ২১ জন কর্মকর্তা। অর্থাৎ দুই বিভাগের চার অতিরিক্ত সচিব পদের বিপরীতে আছেন ২০ জন অতিরিক্ত সচিব; যা অনুমোদিত পদের পাঁচ গুণ। এ চিত্র শুধু স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নয়, বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের চিত্র অনেকটা একই। পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ায় প্রশাসনের পিরামিড আকৃতি এখন মটকার (পেট মোটা মাটির পাতিল) আকার ধারণ করেছে। এই মটকা আকৃতি প্রশাসন পিরামিডে  ফেরত আনার চেষ্টা করছে সরকার। তবে প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পদ ছাড়া পদোন্নতির সংস্কৃতি বন্ধ না হলে প্রশাসনের আকৃতি পিরামিডে ফেরত আনা সম্ভব নয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রশাসনের পিরামিড ঠিক রাখতে আমরা পদোন্নতির বিষয়ে সংকোচন নীতিতে যাওয়ার চেষ্টা করছি। যেখানে জনবল কাঠামোর আকৃতি পিরামিডের মতো হওয়ার কথা, সেখানে মটকার মতো পেট মোটা হয়ে গেছে। আমরা চেষ্টা করছি প্রশাসনের আকৃতি পিরামিডে ফেরত আনতে। এ জন্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতি কম দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি হওয়া পদোন্নতির বিষয় খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন। পিরামিডে ফিরতে হয়তো অনেক সময় লাগবে।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ১৬ সেপ্টেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রশাসনে সিনিয়র সচিব/সচিব পদ রয়েছে ৬৯টি; অথচ আছেন ৭৪ জন। অতিরিক্ত সচিবের কমবেশি ১৪০টি পদে কর্মকর্তা রয়েছেন ৫০১ জন। অর্থাৎ এ পদে ৩৬০ জন কর্মকর্তা বেশি। যুগ্ম সচিবের ৩৩০টি পদে রয়েছেন ৫৯৫ জন কর্মকর্তা। এ স্তরেও ২৬০ জনের বেশি কর্মকর্তা রয়েছেন। সুপারনিউমাররী পদসহ উপসচিবের অনুমোদিত পদ সংখ্যা ১৪২০টি, সেখানেও কর্মরত আছেন ১৯৫৯ জন। অর্থাৎ এ স্তরেও ৫৪০ জন কর্মকর্তা বেশি। আর সহকারী সচিব পদে কর্মরত ১৬০৪ জন হলেও পদ সংখ্যা ১৩৯৩টি। অর্থাৎ এ পদে কর্মকর্তার সংখ্যা পদের চেয়ে ২০০ কর্মকর্তা বেশি। আবার নিচের দিকে এর পুরো উল্টো। সিনিয়র সহকারী সচিব পদে ১ হাজার ৫১৮ জন কর্মরত থাকলেও এ স্তরে অনুমোদিত পদের সংখ্যা ২৯৬০। অর্থাৎ পদ সংখ্যার অর্ধেক কর্মরত। ওপরের পদে প্রয়োজনের চেয়ে লোক বেশি, নিচের পদে কম। পদোন্নতি পেলেও কাজ না থাকায় নিচের পদে বসে কাজ করছেন ওপরের পদের কর্মকর্তারা। পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ায় প্রশাসন এমন মটকা আকৃতি ধারণ করেছে বলে মনে করেন প্রশাসন বিষয়ক কলামিস্ট ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। তিনি বলেন, ‘জনবল কাঠামো পিরামিড আকৃতিতে ফেরাতে হলে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া বন্ধ করতে হবে। উপসচিব পর্যায়ে পদোন্নতি ২৫ শতাংশের বেশি দেওয়া ঠিক নয়।  যেহেতু উপরের দিকে পদ সংখ্যা কম তাই পদোন্নতির সংখ্যাও কমাতে হবে। পরিকল্পিতভাবে পদোন্নতি দেওয়া হলে এ পরিস্থির সৃষ্টি হতো না।’ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অনুবিভাগের প্রধান হলেন যুগ্ম-সচিব পদের কর্মকর্তা। অধিশাখার প্রধান উপসচিব এবং শাখার প্রধান হিসেবে থাকার কথা সিনিয়র সহকারী সচিব বা সহকারী সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা। কিন্তু পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ায় বর্তমানে প্রত্যেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সব অনুবিভাগে (যুগ্ম-সচিবের পদে) কাজ করছেন অতিরিক্ত সচিব পদের কর্মকর্তারা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়সহ অনেক মন্ত্রণালয়ের বিভাগের অধিশাখায়ও (উপসচিবের পদে) কাজ করছেন অতিরিক্ত সচিবরা। আর অধিকাংশ যুগ্ম সচিব কাজ করছেন অধিশাখায় (উপসচিবের পদে)। অনেক যুগ্ম সচিব শাখাতেও (সিনিয়র সহকারী বা সহকারী সচিবের পদে) কাজ করছেন। একইভাবে বেশিরভাগ উপসচিব কাজ করছেন সিনিয়র সহকারী বা সহকারী সচিবের পদে। অপর একটি সূত্র জানায়, পদ না থাকলেও পদোন্নতি এবং অনেক সিনিয়রের পেছনে ফেলে জুনিয়রদের পদোন্নতি দেওয়ায় জনপ্রশাসনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যে যাঁদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগকে পদ অনুযায়ী কাজ দেওয়া যায়নি। আবার একই পদে একাধিক কর্মকর্তা থাকায় কাজের ভাগাভাগি নিয়েও সমস্যা হচ্ছে। অন্যদিকে নিচের পদে কর্মকর্তা কম থাকায় মাঠ প্রশাসনে কাজকর্মে সমস্যা হচ্ছে। সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদে কর্মকর্তা কম থাকায় বেশ কিছু এলাকায় উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) ওই পদের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রশাসন বিষয়ক একাধিক বই প্রণেতা ও সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘প্রকৃত সৃষ্ট পদের তুলনায় পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি হওয়ায় প্রশাসনের পিরামিড আকৃতি নষ্ট হয়েছে। অনেকটা মটকা আকৃতি ধারণ করেছে। এমতাবস্থায় সরকার চাইলে প্রয়োজনে প্রশাসনের জনবল কাঠামো পুনর্বিন্যাস করতে পারে। সেই সঙ্গে পদ খালি হওয়া সাপেক্ষে পদোন্নতির বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে পারে।’

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর