বৃহস্পতিবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

চলে গেলেন গরিবের আইনজীবী

নিজস্ব প্রতিবেদক

চলে গেলেন গরিবের আইনজীবী

চলে গেলেন ‘গরিবের আইনজীবী’ বলে খ্যাত অ্যাডভোকেট আবদুল বাসেত মজুমদার। গতকাল সকাল সোয়া ৮টায় রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তিনি দুই মেয়ে ও দুই ছেলে রেখে গেছেন।

গত ২৩ অক্টোবর আবদুল  বাসেত মজুমদারকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি  হলে গত সোমবার তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। মেরুদন্ডের সমস্যাসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন তিনি। বাসেত মজুমদারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গতকাল সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ (হাই কোর্ট ও আপিল বিভাগ) এবং ঢাকার নিম্ন আদালতের বিচার কাজ বন্ধ রাখা হয়। রাজধানী ঢাকায় দুই দফা ও নিজ জেলা কুমিল্লার লালমাই উপজেলার শানিচোঁ স্কুল মাঠে বাদ মাগরিব তৃতীয় নামাজে  জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর বাবা আবদুল আজিজ মজুমদারের কবরের পাশে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হন। অ্যাডভোকেট আবদুল বাসেত মজুমদার দুস্থ আইনজীবীদের জন্য ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেন। দেশের বিভিন্ন আইনজীবী সমিতিতে এ ফান্ড থেকে অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়। দীর্ঘ পেশাজীবনে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষকে বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে আইনি সহায়তা দিয়েছেন তিনি। এ কারণে আইনাঙ্গনে তিনি ‘গরিবের আইনজীবী’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। গতকাল বেলা ২টায় মরহুমের দীর্ঘদিনের কর্মস্থল সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে তাঁর মরদেহ আনা হলে আইনজীবী, বিচারক, বিচারপ্রার্থীসহ হাজারো মানুষ অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। পরে সুপ্রিম কোর্ট-সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ মাঠে তাঁর দ্বিতীয় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে শেষ বিদায় জানাতে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের ঢল নামে। অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। জানাজায় অংশ নেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক, রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুবে আলম, অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, আপিল বিভাগের বিচারপতি, হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতি, সিনিয়র আইনজীবী, আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল প্রমুখ। জানাজা শেষে বাসেত মজুমদারের কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারের পক্ষে এবং প্রধান বিচারপতি শ্রদ্ধা জানান। এ ছাড়া আইন মন্ত্রণালয়, অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি, আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটি, ল’ রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ), বৃহত্তর ময়মনসিংহ আইনজীবী সমিতি, বৃহত্তর ফরিদপুর আইনজীবী সমিতি, সৈয়দ রেজাউর রহমান অ্যাসোসিয়েটসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়।

জাতীয় ঈদগাহ মাঠে দ্বিতীয় জানাজার আগে মরহুম আবদুল বাসেত মজুমদারের ছেলে আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, বাবা ৫৪ বছর এ অঙ্গনে কাজ করেছেন। প্রতিদিন সকালে উঠে বলতেন, রাজা ওঠো, তাড়াতাড়ি কোর্টে যেতে হবে। আর কোনো দিন তিনি কোর্টে আসার কথা বলবেন না। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, আবদুল বাসেত মজুমদার রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তাই তার সব সিভিল মামলা জুনিয়র হিসেবে হাই কোর্টে আমি লড়েছি। সুতরাং আবদুল বাসেত মজুমদারের কাছে আমার যে ঋণ, সেই ঋণ কোনো দিন শোধ হবে না। উনার সব থেকে বড় পরিচয় ছিল উনি জুনিয়র আইনজীবীদের বন্ধু। যখন যে আইনজীবী তাকে মামলা লড়তে বলেছেন, তিনি টাকার হিসাব না করে তা করে দিয়েছেন। অনেক গরিব মানুষের মামলা বিনা পয়সায় লড়েছেন। প্রবীণ এই আইনজীবীর প্রথম জানাজা গতকাল বেলা ১১টায় বনানী কেন্দ্রীয় মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় ঈদগাহ মাঠে জানাজা শেষে মরহুমের কফিন কুমিল্লার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। লালমাই উপজেলায় মরহুমের গ্রামের বাড়িতে জানাজায় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ড. মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান আইনজীবী সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সাইফুল বাহার মজুমদার, বাসেত মজুমদারের পরিবারের সদস্য-স্বজনরাসহ স্থানীয়রা অংশ নেন।

শোক : আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুল বাসেত মজুমদারের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচারপ্রার্থীদের আইনি সহায়তা দিতে আবদুল বাসেত মজুমদারের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর শোকবার্তায় সাধারণ মানুষকে আইনি সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি আইনজীবীদের পরম বন্ধুখ্যাত আবদুল বাসেত মজুমদারের আইন অঙ্গনে অবদানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। আবদুল বাসেত মজুমদারের মৃত্যুতে আরও শোক প্রকাশ করেছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আইন বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম, জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এমপি, জাতীয় আইনজীবী ফেডারেশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট শেখ মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম।

সংক্ষিপ্ত জীবনী : অ্যাডভোকেট আবদুল বাসেত মজুমদার ১৯৩৮ সালের ১ জানুয়ারি কুমিল্লার লাকসামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ১৯৬৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি হাই কোর্টে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর অন্যতম সদস্য ছিলেন আবদুল বাসেত মজুমদার। তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর