শনিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

পোস্ট অফিসের ভূমিকায় ইউজিসি

নেই কোনো প্রভাব । পরিণত হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার সব থেকে দুর্বল প্রতিষ্ঠানে

আকতারুজ্জামান

পোস্ট অফিসের ভূমিকায় ইউজিসি

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুশাসন ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে সার্বিক সুবিধা দিতে প্রতিষ্ঠা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। কিন্তু সুশাসন ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় তেমন কোনো প্রভাব রাখতে পারছে না এ কমিশন। আইনে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা না থাকা, জনবল সংকট, বিভিন্ন মহলের প্রভাব বিস্তারের কারণে অনিয়ম করা বিশ্ববিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারে না ইউজিসি। ইউজিসি চেয়ারম্যানও বলছেন, ইউজিসি শুধু সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে চিঠি পাঠাতে পারে, কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চশিক্ষার পীঠস্থান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রক এ সংস্থা এখন শুধু পোস্ট অফিস বা চিঠি চালাচালির প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, এখন দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে দুর্বল বাংলাদেশের ইউজিসি।

সূত্র জানান, এখনো ১৯৭৩ সালের আইন দিয়েই চলছে মঞ্জুরি কমিশন। ১৯৭৩ সালে সারা দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মাত্র ছয়টি। ছাত্রছাত্রী ছিলেন প্রায় ৩০ হাজার। তখন অস্তিত্বই ছিল না বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। এখন সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ১৫৮টি। ছাত্রছাত্রী প্রায় ৪০ লাখ। কিন্তু ইউজিসির ক্ষমতায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। কমিশনটির নির্বাহী কোনো ক্ষমতা নেই বললেই চলে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতি, অনিয়ম, অস্বচ্ছতা, জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না কমিশন। দীর্ঘ সময় ধরে ইউজিসিকে উচ্চশিক্ষা কমিশনে রূপ দেওয়ার দাবিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দফায় দফায় প্রস্তাব-আবেদন জানানো হলেও কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়।

তথ্যমতে, ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী ইউজিসিকে উচ্চ কমিশনে রূপ দিতে ২০১৪ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে লিখিত প্রস্তাব পাঠান। এরপর সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নানও ইউজিসিকে কমিশনে রূপ দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন জমা দেন। ২০১৮ সালে সরকার উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করে। সে সময় উচ্চশিক্ষা কমিশন আইন প্রণয়নের জন্য সচিব কমিটি একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করে। প্রস্তাবে বলা হয়েছিল- উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন হলে বিদ্যমান ইউজিসি বিলুপ্ত হবে। তখন দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন বিষয় দেখভাল করবে উচ্চশিক্ষা কমিশন তথা হায়ার এডুকেশন কমিশন (এইচইসি)। কিন্তু অভিযোগ ওঠে, সচিব কমিটির সুপারিশের প্রস্তাবে খোদ উচ্চশিক্ষা কমিশনের স্বায়ত্তশাসন নিয়েই শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ, সুপারিশে গবেষক বা প্রশাসককেও কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। উচ্চশিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান পদে প্রশাসক বসানোর সুযোগ রাখায় এ প্রস্তাব নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয় শিক্ষাবিদদের মধ্যে। পরে বন্ধ হয়ে যায় সেই কমিশন গঠন প্রক্রিয়াও।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, ‘ইউজিসিকে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে হলে সম্পূর্ণ পৃথক একটি সচিবালয় থাকতে হবে।

তাদের নির্বাহী ক্ষমতা দিতে হবে। শুধু মন্ত্রণালয়ের পোস্ট অফিস হিসেবে কাজ করলে ইউজিসি কোনো দিন কিছু করতে পারবে না।’ তিনি বলেন, ‘দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অতীতে দেখেছি- কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অনিয়ম করলে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছি কিন্তু সে চিঠি মন্ত্রণালয়ে গিয়ে হারিয়ে গেছে। পরে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। অনিয়ম করা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ইউজিসিকে সব ধরনের ক্ষমতা দিতে হবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ইউজিসির এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো সক্ষমতা নেই। এর আগে কমিশনের সক্ষমতা বাড়াতে একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। কিন্তু দেখা গেল শিক্ষাবিদদের বাদ দিয়ে তা আমলা পুনর্বাসন কেন্দ্র করার একটি পরিকল্পনা। পরে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করে সে প্রক্রিয়া বন্ধ করিয়েছিলাম।’ ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর প্রতিবেদককে বলেন, ‘মঞ্জুরি কমিশনের সক্ষমতার অনেক অভাব রয়েছে। বিভিন্ন সময় নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ইউজিসির পক্ষ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু ব্যবস্থা নিতে দীর্ঘসূত্রতা লক্ষ্য করা গেছে। এ কারণে অনেক অনিয়মের বিরুদ্ধেই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনিয়ম ঠেকানো কঠিন নয়। কিন্তু সরকারকে মনেপ্রাণে তা চাইতে হবে। সরকার না চাইলে ইউজিসিকে দিয়ে তদন্ত বা সুপারিশ করিয়ে কোনো লাভ হবে না।’ তিনি বলেন, ‘অনিয়ম করলে আইন অনুযায়ী ইউজিসি তো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বন্ধ রাখার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু সরকার পাশে না থাকলে আমরা কি তা করতে পারব?’

ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ইউজিসির নিজস্ব ক্ষমতা কম। অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা শুধু মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করতে পারি, কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না। ব্যবস্থা নেওয়ার কথা তো সরকারের। আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।’ চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠানো হয়, কিন্তু মন্ত্রণালয়ে গিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ সুপারিশের কোনো অগ্রগতি দেখা যায় না।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর