ঘটনা-১ : জসিম মন্ডল (৫৫)। পেশায় রিকশাচালক। পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে রাজধানীর রামপুরার বউবাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। বড় ছেলের জন্য স্কুলের ইউনিফর্ম কিনতে পারছেন না। তাই স্কুল খুললেও ছেলে স্কুলে যেতে পারছে না। মাস তিনেক আগে একটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছিলেন ১০ হাজার টাকা। সাপ্তাহিক কিস্তি পরিশোধের পর সপ্তাহ শেষে তেমন কিছু থাকে না। তাই মাছ-মাংস কিনতে পারছেন না সপ্তাহ এমনকি মাস শেষেও। ঋণটা পরিশোধ হলেই গ্রামের বাড়ি চলে যাবেন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অন্তত বাসা ভাড়ার চাপ তো কমবে! জেলা শহরে রিকশা চালিয়ে কোনোরকমে চালিয়ে নেবেন জানান জসিম মন্ডল।
ঘটনা-২ : হালিমা খাতুন। স্কুলশিক্ষক। খিলগাঁওয়ে থাকেন ভাড়া বাসায়। চারজনের সংসারে গত এক যুগেও কোনো টানাপোড়েন ছিল না। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে গত প্রায় দেড় বছর অর্ধেক বেতন পেয়েছেন। স্কুলে ফুল বেতন দেওয়া শুরু হয়েছে কয়েক মাস হলো। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় করোনা মহামারির এ দুই বছরে পরিবারের চাহিদা মেটাতে ১ লাখ টাকার বেশি ধার করেছেন কয়েকজনের থেকে। তা পরিশোধও করতে পারছেন না। তাই কম ভাড়ার বাসা খুঁজছেন ছয় মাসের বেশি সময়। কিন্তু বাজেটের মধ্যে বাসা পাচ্ছেন না। আবার উচ্চ ভাড়া দিয়ে পুরনো বাসাতেই থাকতে পারছেন না। পড়েছেন উভয় সংকটে। তিনি বলেন, ‘ভাই, নিরুপায়। আমরা দুজন মিলে আয় করি এর পরও সামলাতে পারছি না। মাছ-মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। ছেলেদের খেলনা কেনা বন্ধ করে দিয়েছি। আর কোন দিক দিয়ে খরচ কমাব বুঝতে পারছি না।’
এমন লাখ লাখ পরিবার ঋণ করে কোনোরকমে চলার চেষ্টা করছে। অনেকের ধার-কর্জ আর ঋণের জায়গাও বন্ধ হয়ে গেছে। দৈনন্দিন বাজেট কমাতে কমাতে খাওয়া খরচ কমিয়ে দিয়েছেন অনেকেই। এর পরও সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এদিকে চাল, ডাল, তেল, শাকসবজি, মাছ-মাংসসহ সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে হুহু করে। তাই ডাল-ভাত খেয়ে জীবন ধারণ করাও এখন মানুষের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে ঋণ করে সংসার চালাতেও হিমশিম খাচ্ছেন অনেকে। এদিকে রোজা শুরুর আগেই ডাল, পিঁয়াজ, রসুন, চালসহ অন্য অনেক পণ্যের দাম বেড়েছে আরেক দফা। নিত্যপণ্যের বাজারে যেন আগুন লেগে গেছে। আর সে আগুনে পুড়ছে সাধারণ ক্রেতা। ৫০০ টাকা নিয়ে বাজারে গেলেও ছোট একটি পরিবারের দু-তিন দিনের প্রয়োজনীয় বাজার করা সম্ভব হয় না। সয়াবিন তেলের দাম তো রীতিমতো আকাশচুম্বী। ভালো মানের চিকন চাল, যেটা তিন মাস আগেও ছিল ৬৮ টাকা, সে চাল গতকাল ৭৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ২ কেজি আটার প্যাকেটের দাম এখন ৯০ টাকা, যা ছয় মাস আগে ছিল ৬৫-৭০ টাকা। গরুর মাংসের কেজি এক লাফে উঠেছে ৬৫০ টাকায়। গরিবের মাছ হিসেবে পরিচিত চাষের কই, মাগুর, শিং, পাঙ্গাশ ও নলার কেজি গড়ে ছিল ১২০-১৫০ টাকা। এখন তা ২০০-২২০ টাকা। রোজার মাসে ছোলার ব্যবহার বাড়ে। সব শ্রেণির মানুষ ইফতারিতে ছোলা খায়। এ ছোলার বাজারেও আগুন লেগেছে। মুগ ডালের কেজিও ঠেকেছে ১৪০ টাকায়। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে মানুষের আয় বেড়েছে, ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকদের প্রশ্ন হলো, যাদের আয় বেড়েছে তাদের সংখ্যা কত। আর যাদের আয় কমেছে বা আগের মতোই আয় করছে অথচ ব্যয় অনেক বেড়েছে তাদের সংখ্যা কত। ৫ বা ১০ শতাংশ মানুষের আয় বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। সেটাই মাথাপিছু আয়টাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এজন্য বাস্তব চিত্রের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিসংখ্যানের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না বলে মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, উন্নয়ন হচ্ছে, কিছু মানুষের আয় বেড়েছে এটা সঠিক। কিন্তু এর চেয়ে বড় কথা হলো জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে পারছে না সরকার। এ ছাড়া মানুষের আয় যাদের কমেছে তাদের প্রয়োজনমতো সহায়তা দেওয়া হচ্ছে না। ফলে সমাজে প্রকটভাবে বেড়েছে বৈষম্য। নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ জীবন বাঁচাতে রীতিমতো যুদ্ধ করছে বলে মনে করেন তিনি। এদিকে নিত্যপণ্যের বাজারে সরকারের তেমন কোনো তদারকিই নেই। সারা বছর দু-একটি ভেজালবিরোধী অভিযান চোখে পড়ে। কিন্তু পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে কেন বাড়ছে, কারা বাড়াচ্ছে, অধিক মুনাফা কারা করছে, কারসাজির সঙ্গে কারা জড়িত, কৃত্রিম সংকট তৈরির পেছনে কারা দায়ী- এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে কখনই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। এমনকি বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপও চোখে পড়ে না সারা বছর। সরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান টিসিবির হিসাবে সব ধরনের গুঁড়া দুধের দাম এক বছরের ব্যবধানে কেজিতে প্রায় ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। গতকালের বাজারদর অনুযায়ী ১ কেজি ডানো গুঁড়া দুধ ৬৯০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা এক বছর আগের এই দিনে ছিল ৬০০ থেকে ৬১০ টাকা। ডিপ্লোমা ব্র্যান্ডের (নিউজিল্যান্ড) গুঁড়া দুধ প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৬৮০ টাকা, যা এক বছর আগে ছিল ৬১০-৬৩০ টাকা। অনলাইন শপ চালডালের ওয়েবসাইটে এটার মূল্য ৭২০ টাকা। দেশি ব্র্যান্ডের গুঁড়া দুধ মার্কসেরও দাম বেড়েছে। এ দুধ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৮৫-৬২০ টাকায়, যা গত বছর এই দিনে বিক্রি হয়েছিল ৫৪০-৫৭০ টাকায়। ড্যানিশ ব্র্যান্ডের ১ কেজি গুঁড়া দুধের দাম ৬৯০ টাকা, যা এক বছর আগে ছিল ৬০০-৬৩০ টাকা। মিল্কভিটার ১ লিটার দুধের দাম ৫৭০ টাকা। এ ছাড়া ল্যাকটোজেন, বায়োমিল, সেরেলাকসহ অন্যান্য শিশুখাদ্যের বাজারও ঊর্ধ্বমুখী। আমদানিকারকরা বলছেন, আমদানি ব্যয় বাড়ার কারণে আমদানি-পণ্যের দাম বাড়ছে। টাকার বিপরীতে ডলারের দামও বাড়ছে অব্যাহতভাবে। এক বছরের ব্যবধানে প্রতি ডলারের দাম টাকার বিনিময়ে বেড়েছে প্রায় ২ টাকা। গতকালও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় ডলার বিক্রি হয়েছে ৮৮ টাকা ৫০ পয়সা পর্যন্ত। যদিও খোলাবাজারে ডলারের দাম ৯০-৯১ টাকা পর্যন্ত উঠেছে বলে জানা গেছে। অবশ্য গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে ডলারের রেট ছিল ৮৬ টাকা। আমদানি-রপ্তানি কার্যকম জোরালো হওয়ায় বিশ্বব্যাপী ডলারের চাহিদা বেড়েছে। ফলে ডলারের দাম বাড়ছে। এতে পণ্যমূল্য বাড়ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।