রবিবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

এ প্রজন্মের একুশ : তবুও লাবণ্য ধরে

ড. শহীদ ইকবাল

এ প্রজন্মের একুশ : তবুও লাবণ্য ধরে

একুশ, একুশের ভেতরের আগুন, পলাশরঙা আগুন- এমন কথা কিছুতেই আর নতুন নয়। কথা যতটা ব্যক্তিগত ততটা স্মৃতিরোহী। তবে প্রশ্ন জাগে, ওসব পেরিয়ে সত্তরোর্ধ্ব একুশ নিয়ে এই প্রাত্যহিক কলামে আমি কী বলতে পারি! আমারও তো বয়স হয়ে বসল, পুরনো জিনিস জাবরকাটা তা দিয়ে কারই-বা কী হবে; অন্তত যখন চতুর্দিকে হতাশার ইঙ্গিতগুলো হয়ে ওঠে হননের আর জিঘাংসার- তখন পেরোনোর অস্ত্র ব্যক্তিগত স্মৃতিকথাতে তেমন কি কাজ হওয়ার কথা! ইতিহাসেরও চলকগুলো কেন যেন আজকাল আর নবায়ন হচ্ছে না। নতুন কথা বলা বা সৃষ্টির তর্কে ঝালানো যাচ্ছে না কিছুই। ফলে এক জোলো-হাওয়া আমাদের চারদিক পরিবেষ্টন করে বসে আছে। এ থেকে মুক্তি যে নেই তা বলব কী করে, তবে কিছু তো সময় ক্ষয় হবেই- গাদ-ক্বাথ ঝরবে বলেই মনে হয়। বলি, একুশের সাতচল্লিশের আগের ইতিহাসটা কী? পরাধীন ভারতবর্ষেও ‘ভাষা’ নিয়ে রাজনীতি তো কম হয়নি! ব্রিটিশরাও বেশ গরম তেলে ‘ভাষা’কে ভুনিয়ে মনের মতো করে কাজে লাগিয়েছেন।

সুভাষ বসু, চিত্তরঞ্জন দাশ বাঙালি- মারাঠিরা দুরদর্শী এমন বাঙালিদের পছন্দ করতেন না। জিন্নাহর মৃত্যুর পর ভগ্নদশা রাষ্ট্র পাকিস্তানের বড় অংশ পূর্ববাংলা ক্রমশ ঔপনিবেশিক আস্তিনে আটকে যায়। ভাষার রাজনীতি বরাবরের মতো আর্থনীতিক-রাজনীতিক হয়ে ওঠে। কথাগুলো বলার কারণ, এই ভাষিক রাজনীতি যে চিরকালের! এখনো তো তা চলছে। চলবেও। পুঁজির দাস হলে তাই তো হবে! উপনিবেশে গড়ে ওঠা যে উপনিবেশিত মন সেটি আমাদের স্বাধীনতার বায়ান্ন বছর পরও শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। হুমায়ুন আজাদ ভাষার মাসকে বলেছেন ‘বাঙালির ছলনার মাস’। কারণ, বায়ান্নর উত্তরাধিকারীরা কেউ সাইনবোর্ড বাংলায় করে না, বাংলাদেশে নতুন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বাংলায় হয় না (প্রায় নেই বললেই চলে), স্বাধীন দেশের বুদ্ধিজীবীরা কেউ বাংলাবিষয়ক জ্ঞান সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি (আন্তরিক প্রচেষ্টা করেন নাই), বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মসাম্মানিক হয়ে ওঠেন না কেউ-ই, গর্বিত তো হনই না। অধিকাংশ পাঠ্যপুস্তক এখনো বাংলায় নয়, টেকনিক্যাল জ্ঞান এতে হয় না, মেডিকেল শিক্ষা ‘জ্ঞান’শূন্য- আত্মস্থতার পথ নেই। আমরা সত্তর বছরে করে উঠতে পারিনি। বিপরীতে ইংরেজির রাজনীতি খুব মধুময়। মেডিকেল শিক্ষা, আইন-আদালতের শিক্ষা, বিজ্ঞানের শিক্ষা- সব ইংরেজিতে। ইংরেজি ভাষার সঙ্গে বিত্ত ও ক্ষমতা জড়িত। ইংরেজি সাহিত্যের লোক নেই কিন্তু ইংরেজি-ভাষা পড়ানোর লোকের অভাব নেই। ভুঁইফোড় বাঙালি বরাবরই স্মৃতিকাতর ও মোহগ্রস্ত। সেটির দোষগুণ পরীক্ষা না করেই বলা চলে- তারা এ যুগে সহজে শর্টকাট সুযোগ নিয়ে সবার ওপরে উঠতে চান। এই ওঠার সিঁড়ি ‘ইংরেজি’। অবশ্যই ইংরেজি ভাষার বিরোধিতার কোনো প্রশ্ন নেই কিন্তু ইরেজি যদি আগ্রাসী অক্টোপাসরূপে আমাদের অক্ষম করে তোলে- সেটাই আপত্তি। একদা উর্দু ছিল রাষ্ট্রের চাপানো ভাষা এখন অসহায় রাষ্ট্রের ওপর করপোরেট ব্যবস্থা চাপিয়ে দিচ্ছে ওই ইংরেজি ভাষা। এখন তরুণ প্রজন্ম কী করবে? মনে রাখতে হবে, ভাষা একটি চলমান স্রোত। সে বাঁক বদলায়। বাস্তব জীবনের অনুষঙ্গ ধরে সে নিজেকে নবায়ন করে। কোনো ভাষাই অপ্রয়োজন নয়। শত্রু তো নয়ই। কারণ, বহু ভাষা সক্ষম একজন মানুষ বৈশ্বিক হয়ে উঠতে পারে। বিচিত্র কালচারের সঙ্গে তার মোলাকাত হয়। কিন্তু আধিপত্য তো শোষণের শামিল। সেটি পরিত্যাজ্য। তা না করলে, এই ভাষাই রাজনীতির কোপানলে পড়ে, বর্ণবাদী বানায়, করে তোলে মানসিক প্রতিবন্ধী। ফলে দাসত্বই হয় তার মাপকাঠি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি- সেটি তো বিপন্ন স্বাধীনতা নয়- কিন্তু পরদেশি ভাষা-সংস্কৃতির আগ্রাসনে বিশ্বায়নের নামে আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের দেশচেতনা থেকে সরে যাচ্ছি। একটি জাতি বড় হয় কীসে? তাঁর আত্মমর্যাদা ও সংস্কৃতির পাদপীঠ কোনটি? কীভাবে এক প্রজন্ম অন্য প্রজন্মকে অগ্রসরতা দেয়- ইত্যাকার যাবতীয় প্রশ্নের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে স্বাজাত্যবোধ ও স্বভাষিক পরিচর্যার সম্পর্ক। করপোরেট হইচইয়ে আমরা তা ভুলে যাচ্ছি। ও-টি-টি প্রযুক্তি ভঙ্গি দিয়ে ভোলাচ্ছে আমাদের। ফলে মুক্তির পথ রুদ্ধ। এ বন্দিত্ব ঘুচাতে হবে। ভাষার মাসে ভাষা নিয়ে হইচই-ই শেষ কথা নয়। সেটি ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপক কিছু নয়। সারা রাত শহীদ মিনারে কাটালে ‘সালাম-রফিকউদ্দিন-জব্বার থোকা থোকা নামে’র চেতনা প্রতিষ্ঠিত হয় না। সেটি অর্জন ও দায়বদ্ধতার প্রশ্নে প্রোথিত। একই সঙ্গে তা ঠিক মমতারও। স্বাধীন বাংলাদেশ বাংলা ভাষার দেশ। জাপানিজ, চাইনিজ ভাষার মতো অনেক ভাষা প্রতিষ্ঠিত কিন্তু আমাদের আর্থিক দৈন্যের চেয়ে মানসিক দৈন্য তো বেশি- যা আমাদের প্রাত্যহিকতার যাপিত জীবনে দাসত্বের বা আত্ম অবমাননার অপর নাম।

লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর