রসুল (সা.) হাদিস শরিফে ঘোষণা করেছেন, ‘মাহে রমজান তিনটি দশকে বিভক্ত। এর মধ্য প্রথম দশক হলো রহমতের দশক।’ আজ এ দশক বিদায় নিয়ে আমাদের মাঝে আসছে দ্বিতীয় দশক তথা মাগফিরাতের দশক। এরপর নাজাত তথা সর্বশেষ দশকটি বাকি থাকবে কেবল। দুনিয়াজুড়ে আরশের মালিক এ ১০ দিন পৃথবীবাসীর ওপর অঝোর ধারায় রহমত বর্ষণ করেছেন। ভাগ্যবান বান্দা সে, যে প্রভুর রহমত ধারণ করতে পেরেছে। আর যে অবহেলা-অযত্নে প্রভুর রহমত থেকে দূরে থেকেছে, তার ব্যাপারে নবীজি (সা.) নিজেই বলেছেন, ‘এমন হতভাগ্য বান্দা আরশের নিচে জমিনের ওপরে আর কেউ নেই।’ অন্য যে কোনো প্রজন্মের চেয়ে বর্তমান প্রজন্ম সবচেয়ে বেশি রহমতকাতর হয়ে পড়েছে। কেননা আমরা সুন্নাতাল্লাহ তথা খোদার বিধানকে চ্যালেঞ্জ করে এমন এমন সব প্রযুক্তির অপব্যবহার করেছি, যেগুলো আজ আমাদের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা শিল্প খাতকে উন্নত করতে গিয়ে ধ্বংস করেছি হাজার বছরের নদ-নদী। পাকা দালান নির্মাণ করতে গিয়ে শেষ করছি আমাদের মৃত্তিকাসম্পদ। আমাদের দেশের মাটিকে বলা হয় সোনার চেয়ে খাঁটি। সেই কৃষিজমির মাটি নিয়ে আমরা ইটভাটায় পুড়িয়ে বড় বড় দালান নির্মাণ করছি। এককালে কৃষি ও মৎস্য উৎপাদনে আমরা ছিলাম ভালোর দিকে, এখন আমরা শিল্প খাতে ভালো করলেও পিছিয়ে পড়েছি কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে। একইভাবে দিন দিন আমাদের পানযোগ্য স্বাদুপানির উৎসও ধীরে ধীরে কমে আসছে। বিশেষজ্ঞরা বারবার বলছেন, এমন অবৈজ্ঞানিক ও অপরিকল্পিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করলে একটা সময় পানি আমদানি করে খেতে হবে বাংলাদেশের মানুষকে। আসলে লোভ যখন একটা জাতির রক্তে মিশে যায় তখন এভাবেই তারা প্রাকৃতিক সম্পদ তথা খোদার রহমতের ভান্ডারের অপব্যবহার করে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনে। মনে পড়ছে বনি ইসরাইলের কথা। আল্লাহ তাদের মান্না ও সালওয়া নামে বিশেষ খাবার খাওয়াতেন। কিন্তু এ নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় না করে তারা বলল, আমরা খাদ্য উৎপাদন করতে চাই। তাদের এমন না-শুকরি আচরণে ভীষণ রাগ হন আল্লাহ তায়ালা। সুরা বাকারায় এ সম্পর্কে বিস্তারিত বলা আছে। একই অবস্থা আমাদের বেলায়ও দেখতে পাচ্ছি। আল্লাহ আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমিকে মৃত্তিকা, পানি ও জলজ সম্পদ দিয়ে ভরপুর করে দিয়েছিলেন। হায়! আমরা সে সম্পদ দিন দিন শেষ করে ফেলেছি। এখন আমাদের সামনে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই বাকি নেই। বৃষ্টি যখন হয়, তখন সব জায়গাতেই বৃষ্টি ঝরে। যে ভূমিটা উঁচু, বাঁকা সেখানে বৃষ্টি ঝরলেও পানি জমে না। তেমনি আল্লাহর রহমত সব বান্দার ওপর, সব জাতির ওপর সমানভাবে ঝরছে, ঝরবে। কিন্তু যে বান্দার কলবের জমিনটা অহংকারে উঁচু হয়ে আছে, যে জাতির বিবেকের মাটি অজ্ঞতা আর লোভের আগুনে শক্ত হয়ে গেছে, সে জাতি খোদার রহমত ধারণ করার যোগ্যতা রাখে না। সিয়াম সাধনার আলোচনা করতে গিয়ে এক বুজুর্গ বলেছেন, সিয়াম সাধনা হলো উঁচু কলবকে নিচু বানানোর মাস। অহংকারী মনকে বিনয়ী করার মাস। বান্দা যখন সিয়াম সাধনা শুরু করে, আস্তে আস্তে কোরআনের সঙ্গে, সালাতের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলে, তখন অটোমেটিকভাবে হৃদয় নরম হয়ে আসে। চোখ ভিজে ওঠে। দুনিয়ার মায়ামোহ তুচ্ছ মনে হয়। কবরের জীবনের জন্য এক ধরনের পেরেশানি, টান অনুভব করে। বান্দা যদি নিজেকে বদলানোর জন্য প্রস্তুত না করে, নিজের ভিতরে যদি রহমত ধারণের জন্য বিনয়ী না হয়, তাহলে আল্লাহ নিজ থেকে কাউকে পরিবর্তন করেন না। তাই আসুন রমজানের প্রথম দশকটি যারা কাজে লাগাতে পেরেছি তারা বাকি দুটি দশকও আরও বেশি করে মেহনত করি। আর যারা এখনো গাফিলতিতে ডুবে আছি, আজ থেকে, এখন থেকেই আল্লাহর রহমতের চাদরে আশ্রয় নিই। মাগফিরাত ও ক্ষমার বৃষ্টিতে ভিজে নিজেকে বদলে ফেলি। নিজে বদলালেই জাতি বদলাবে, দেশ ও সমাজ এগিয়ে যাবে। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন।