ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দেশের সেবা খাতে ১ লাখ ৪৬ হাজার ২৫২ কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে ঘুষের হার সবচেয়ে বেশি ভূমি, বিচারিক সেবা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, পাসপোর্ট, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও বিআরটিএতে। ওই বছর প্রাক্কলিত ঘুষের পরিমাণ ১০ হাজার ৯০২ কোটি টাকা।
গতকাল ধানমন্ডিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) কার্যালয়ে ‘সেবা খাতে দুর্নীতি : জাতীয় খানা জরিপ ২০২৩ প্রতিবেদন’ প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়।
টিআইবি জানায়, আট বিভাগের ১৫ হাজার ৫১৫টি পরিবারের তথ্য এ জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ১৩ মে থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে। আর ১৫ বছরের হিসাব টিআইবির ১০টি খানা জরিপের তথ্য-উপাত্ত থেকে করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জরিপে অন্তর্ভুক্ত ঘুষদাতা খানার ৭৭ দশমিক ২ শতাংশ বলেছে, ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না। ঘুষ আদায়ে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ অব্যাহত রয়েছে। জরিপবর্ষে অর্থাৎ ২০২৩-২৪ সালে সবচেয়ে বেশি ঘুষ দিতে হয়েছে।
প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩ সালে জাতীয়ভাবে প্রাক্কলিত ঘুষের পরিমাণ ১০ হাজার ৯০২ কোটি টাকা, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ ও জিডিপির ০ দশমিক ২২ শতাংশ। এ পরিমাণ অর্থ দেশের মানুষ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সেবা পেতে ঘুষ দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ভূমিতে ২ হাজার ৫১৩ কোটি, বিচারিক সেবায় ২ হাজার ৫১৩ কোটি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় ২ হাজার ৩৫৭ কোটি ৫০ লাখ, পাসপোর্টে ১ হাজার ৩৫০ কোটি, স্থানীয় সরকারে ৮৪০ কোটি ৯০ লাখ, বিদ্যুতে ৩০৯ কোটি ৬০ লাখ, স্বাস্থ্য খাতে ২৩৫ কোটি ১০ লাখ ও শিক্ষায় ২১৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা। তালিকায় মোট ১৪টি খাতের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সেবা পেতে খানা বা পরিবারপ্রতি ৫ হাজার ৬৮০ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। গড় ঘুষের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি বিচারিক সেবা, ভূমিসেবা ও ব্যাংকিং খাতে। সেবা পেতে ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ পরিবার দুর্নীতি ও ৫০ দশমিক ৮ শতাংশ পরিবার ঘুষের শিকার হয়েছে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিচারিক সেবা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় দুর্নীতি ও ঘুষের উচ্চহার অব্যাহত, যা সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বড় বাধা। অন্যদিকে ভূমিসেবা, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং বিআরটিএর মতো সেবায় উচ্চ দুর্নীতি ও ঘুষের কারণে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসহ সেবা প্রাপ্তির অধিকার বাধাগ্রস্ত করছে। তিনি বলেন, জাতীয় খানা জরিপ ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতি বছর করে আসছে টিআইবি। এ জরিপ ধারণাভিত্তিক গবেষণা নয়, সেবা নিতে গিয়ে যে হয়রানির শিকার হতে হয়, তাদের অভিজ্ঞতাভিত্তিক। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ১৫ হাজার ৫১৫টি খানার ওপর জরিপ পরিচালনা করা হয়। এতে ছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার, ভূমি, কৃষি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক প্রক্রিয়া, বিদ্যুৎ, ব্যাংকিং, বিআরটিএ, কর ও শুল্ক, এনজিও, পাসপোর্ট, বিমা, গ্যাস, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ সহায়তা এবং এনআইডি সেবা। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ২০২৩ সালে সার্বিকভাবে গড়ে ৫ হাজার ৬৮০ টাকা ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছেন সেবাগ্রহীতারা। বিচারিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় দুর্নীতি ও ঘুষের উচ্চহার অব্যাহত, যা সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে বড় বাধা। ভূমিসেবা, পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র সেবায় উচ্চ দুর্নীতি ও ঘুষ বিদ্যমান, যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সেবা প্রাপ্তির অধিকার বাধাগ্রস্ত করছে। দুর্নীতি প্রতিরোধ, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, তদারকি জোরদার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন, অভিযোগের ব্যবস্থা সম্পর্কে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নিয়মিত প্রকাশ ও নিয়মিত গণশুনানির আয়োজনের ওপর জোর দিতে বলেছে টিআইবি।
