দক্ষিণ এশিয়ার দুই বড় শক্তি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের মধ্য দিয়ে যে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে যুদ্ধরত দেশ দুটি বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্নভাবে এত বেশি সংশ্লিষ্ট যে বাংলাদেশেও নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি করেছে। এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে নানামাত্রিক প্রভাব পড়তে পারে। আমদানি-রপ্তানি খাত ছাড়াও বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে জ্বালানি, খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাক-ভারত যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে সংশ্লিষ্টরা যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, সেগুলো হচ্ছে-১. যুদ্ধরত দুই দেশ থেকে খাদ্য ও নিত্যপণ্য সরবরাহ কমে যেতে পারে। ২. বেড়ে যেতে পারে মূল্যস্ফীতি। ৩. শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে বিঘ্ন ঘটতে পারে। ৪. জ্বালানি ও কাঁচামালের দাম বেড়ে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। ৪. আমদানি ও রপ্তানি উভয় খাতেই তৈরি হবে শঙ্কা। ৫. নেতিবাচক প্রভাব পড়বে শেয়ারবাজার, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বেসরকারি খাত ছাড়াও সরকারিভাবে ভারত ও পাকিস্তান থেকে চাল আমদানি করা হচ্ছে, যা খাদ্যনিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। উৎপাদন মৌসুমেও বাজারে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। যুদ্ধের কারণে দেশ দুটি থেকে খাদ্য আমদানিতে বিঘ্ন ঘটলে আরেক দফা বাড়তে পারে চালের দাম। ভারত ও পাকিস্তান থেকে প্রচুর গমও আমদানি হয়। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের প্রথম দিকে প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য (চাল ও গম) আমদানির পরিকল্পনা গ্রহণ করে সরকার; যার একটি বড় অংশ ভারত ও পাকিস্তান থেকে কেনার কথা রয়েছে। এরই মধ্যে দেশ দুটি থেকে সরকারি পর্যায়ে (জিটুজি) ১ লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি হয়েছে এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাল এসে পৌঁছেছে। যুদ্ধের কারণে এ বড় দুটি গন্তব্য থেকে খাদ্য আমদানি বিঘ্নিত হলে তা বাজারে অস্থিরতা বাড়িয়ে দিতে পারে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক এম কে মুজেরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার নিকট প্রতিবেশী দুই দেশ ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি আক্রমণ যদি সর্বাত্মক যুদ্ধে রূপ নেয়, তবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে দেশের মানুষের জন্য নানা ধরনের সংকট তৈরি করবে।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই চিফ ইকোনমিস্ট বলেন, ‘ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশ থেকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে চাল ও গম আমদানি হচ্ছে। যুদ্ধের কারণে খাদ্য আমদানিতে বিঘ্ন ঘটলে চাল ও গমের দাম বেড়ে যাবে। এর ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে। শুধু তাই নয়, অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়াও দেশের উৎপাদনমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানি হয় এ দুটি দেশ থেকে। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে নিত্যপণ্য সরবরাহে সংকট সৃষ্টি হবে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে বিঘ্ন ঘটলে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। আমদানি খাত ছাড়াও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে রপ্তানি খাতে।’
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সম্ভাব্য অভিঘাত বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর বহুমাত্রিক হতে পারে। যুদ্ধ সংঘটিত হলে এ অঞ্চলে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে ব্যবসাবাণিজ্য, বিনিয়োগ ও জ্বালানি সরবরাহে। ভারত এবং পাকিস্তান উভয় দেশই বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও আঞ্চলিক যোগাযোগের অংশীদার। যুদ্ধকালীন স্থল, নৌ ও আকাশপথে চলাচল সীমিত বা বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যা আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে বিঘ্ন ঘটাবে। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বাণিজ্য ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীলতা বিবেচনায় বাংলাদেশ তাৎক্ষণিক সরবরাহ শৃঙ্খল সংকটের মুখে পড়তে পারে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির এই অধ্যাপক বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশ দুটিতে যুদ্ধাবস্থা অব্যাহত থাকলে দেশের বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও পুঁজিবাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা হ্রাস পেয়ে পুঁজি প্রত্যাহার ও বিনিয়োগ স্থগিত হতে পারে, যা কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। দক্ষিণ এশিয়ায় সংঘাতের কারণে জ্বালানি বাজারে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে, যা বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে তুলবে। তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি শিল্প উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বাড়াবে, ফলে সামগ্রিকভাবে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ও বাড়বে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সহায়তা ও উন্নয়ন সহযোগীদের মনোযোগ এ অঞ্চলের নিরাপত্তা ইস্যুর দিকে চলে যেতে পারে। ফলে উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নের গতি কমে যাওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে। সব মিলিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনীতি মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে একাধিক দিক থেকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে।’