না না আমাকে দেখতে আজ ভালো লাগছে না, আমি তোমাদের তোমাদের সাথে বেড়াতে যাবো না। এতো গেলো বড় মেয়ে জেনির কথা।মেঝ মেয়ে এ্যানির অবস্থা ভিন্ন, সে একঘণ্টা ধরে নিজের রুমে ড্রেসের পর ড্রেস বদলাচ্ছে, জুয়েলারির পর জুয়েলারি পরছে আর খুলছে। কোনোকিছুতেই তাকে মানাচ্ছে না। হয়তো আরও ঘণ্টাখানেক লাগবে, তারপরও নিজেকে নিয়ে অস্বস্তির রেখাগুলো তার মুখশ্রী থেকে মুছবে না।
এতো গেলো দুইমেয়ের কথা। একমাত্র ছেলে ড্যানি, সবার ছোট, বয়স মাত্র ১৫। সেও কারো চেয়ে কম নয়। সে মনে করে তার নাকটা থ্যাবড়া, এটা একটু চিকন, খাড়া হলে ভালো হতো। চোখদুটো নাকি কোটরাগত! দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে তার আয়না দেখে। মুখে যদি সাথে একটা ব্রণ ওঠে তাহলে তো কথা নেই। দেখা যাবে- শোয়া, বসা, খাবার গ্রহণের সময়েও আয়না দেখছে আর ভাবছে, চেহারার এতসব সমস্যা দূর করার জন্য কী করা যায়!
আসলে জেনি, এ্যানি, ড্যানি এরা তিনজনেই দেখতে খুব ভাল। জেনি, এ্যানি খুব সুন্দরী, হাইট-ওয়েট সবই ঠিক আছে। ড্যানিও বেশ হ্যান্ডসাম। কিন্তু তিনজনের অই একই সমস্যা। সবসময়ই তারা ভাবে তাদের চেহারা, শরীর-স্বাস্থ্য সুন্দর নয়, তারা দেখতে একবারেই যাচ্ছেতাই। কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা উঠলেই সমস্যাটা যেন আরও বেড়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে কারো যদি এই সমস্যা চলমান থাকে তাহলে বিষয়টি বডি ডিসমর্ফিক ডিসঅর্ডার বা বিডিডি কীনা তা দেখা উচিত।
বডি ডিসমর্ফিক ডিসঅর্ডার, চিকিৎসা বিজ্ঞানে এরকম একটা পরিভাষার ব্যবহার আছে। এটিকে ঠিক কোন রোগ বলা যায় না। তবে এটি কখনো কখনো মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। পরিভাষাটি যতটাই অপরিচিত হোক বিষয়টা কিন্তু ততটাই পরিচিত।
বডি ডিসমর্ফিক ডিসঅর্ডার কি?
বডি ডিসমর্ফিক ডিসঅর্ডার (বিডিডি) মানুষকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে যে তাদের শরীরের কিছু অংশ কুৎসিত দেখায় বা দেখতে ভাল লাগছে না। এই নিয়ে তারা ঘণ্টার র পর ঘণ্টা ব্যয় করে, নিজেকে উল্টেপাল্টে দেখে। প্রতিদিনই অনেকবার, তারা নিজেদেরকে নানাভাবে সাজায়, শরীরের অনেক কিছু আড়াল করে। বেশিরভাগ মানুষই এসব নিয়ে ভাবে না কিন্তু কিছু মানুষ এই বিষয়টিকেই ত্রুটি বা দোষ হিসাবে গণ্য করে তার সমাধানে অনেক সময় ব্যয় করে থাকে। টিনেজারদের মাঝে এই প্রবণতা বেশ লক্ষণীয়।
বডি ডিসমর্ফিক ডিসঅর্ডার বা বিডিডি এর লক্ষণগুলো হচ্ছে-
১. চেহারার বিষয়ে চরম মনোযোগ
এরা চেহারার কিছু অপছন্দের অংশ নিয়ে চিন্তা করা কোনোভাবেই বন্ধ করতে পারে না। তারা নির্দিষ্ট একটি বিষয়ের ওপর মনোনিবেশ করে - যেমন, তাদের ত্বকে কোন ফুসকুড়ি হয়েছে, তখন সেটাই তাদের মনযোগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কিংবা তাদের নাক, চোখ, ঠোঁট, কান বা হাতের আকৃতি নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকলে সেটাই তাদের ভাবনায় সর্বক্ষণ জুড়ে থাকে।
২. চেহারা সম্পর্কে বিরক্ত বোধ করে। চেহারা নিয়ে চিন্তিত, চাপগ্রস্ত এবং উদ্বিগ্ন বোধ করে।
৩. চেহারা পরখ করতে থাকে এবং তা ঠিক করার চেষ্টা করতে থাকে। এরা বারবার আয়নায় নিজের চেহারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার প্রবল প্রয়োজন অনুভব করে। যেমন, এরা আয়নায় তাদের চেহারা দেখতে থাকে এবং অন্যদের কাছে জানতে চায় তাকে কেমন দেখাচ্ছে। এরা বারবার পোষাক আর মেকআপ পরিবর্তন করে স্বস্তি পাওয়ার চেষ্টা করে থাকে।
৪. নিজেকে অন্যদের কাছ থেকে আড়াল করা। বিডিডি আক্রান্ত কিছু লোক তাদের চেহারা সম্পর্কে এত খারাপ অনুভব করে যে তারা পরিচিতজনদের সামনে নিজের চেহারা দেখাতে চায় না। তারা বাড়িতেই বেশি সময় অবস্থান করে, নির্জনে মেকাপ করে, টুপি পরে, মুখ ঢেকে রাখে। কেউ কেউ এতটাই চাপে থাকে যে আয়নায় মুখ দেখাও কমিয়ে দেয়।
৫. নিজের চেহারা নিয়ে এরা একটি মিথ্যা ধারণা পোষণ করে আছে। তারা শরীরের এমন বিষয় নিয়ে চিন্তিত থাকে যেগুলো হয়তো অন্যরা কদাচিৎ লক্ষ্য করেছে। আর তারা নিশ্চিত থাকে যে তারা দেখতে কুৎসিত, যদিও এটি সত্য নয়।
বডি ডিসমর্ফিক ডিসঅর্ডার (বিডিডি) কীভাবে নির্ণয় করা হয়?
একজন প্রশিক্ষিত মানসিক স্বাস্থ্য থেরাপিস্ট যিনি বিডিডি বোঝেন তিনি এটি নির্ণয় করতে পারবেন। কারো এই সমস্যা থাকলে কিছু প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এটি নির্ণয় করে থাকেন।
এই সমস্যার তাহলে সমাধান কী?
এই রকম একটা মর্মবেদনা নিয়েই কি জীবন চালানো অবশ্যই কষ্টের ব্যাপার।
বুদ্ধিবৃত্তিক আচরণগত থেরাপি:কগনিটিভ বিহেভিয়ারেল থেরাপি বা সিবিটি হলো এক ধরনের কথাথেরাপি। কথা বলার মাধ্যমে আক্রান্তদের অনুভূতি, চিন্তাকে বোঝার চেষ্টা করা হয়। আক্রান্তরা যাতে নিজের চিন্তাকে শনাক্ত করতে পারে এবং সেই চিন্তার বিরুদ্ধে নিজের যুক্তি দিয়ে জয়ী হতে পারে, সেই লক্ষেই এই কথা বলা। শরীরকে দেখার পদ্ধতি পরিবর্তন করার মাধ্যমে ধীরে ধীরে এই থেরাপি মানুষকে নিজের ত্রুটির প্রতি কম দৃষ্টিপাত করতে শেখায়। একপর্যায়ে তারা তাদের চেহারা বারবার চেক করা এবং তা ঠিক করা বন্ধ করতে শেখে।
ওষুধের মধ্যে সেরোটোনিন বিডিডি এর চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। এগুলিকে কখনও কখনও এসএসআরআই ওষুধ বলা হয়। এসএসআরআই ওষুধ মানুষকে তাদের চেহারা সম্পর্কে আবেগ কমিয়ে কষ্টের অনুভূতি কমাতে সাহায্য করতে পারে। সাথে সিবিটি অবস্থার উন্নতি করতে সাহায্য করে।
দৈহিক সৌন্দর্য নিয়ে অসন্তুষ্টি বা বিডিডি এর কারণ কী?
সঠিক কারণ সম্পর্কে এখনো তেমন কিছু জানা যায়নি। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন বিডিডি সৃষ্টির ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো ভূমিকা পালন করে সেগুলো হচ্ছে-
১. জিন বা বংশগত প্রভাব রয়েছে এমনটা মনে করেন অনেকে।
২. সেরোটোনিন মস্তিষ্কের একটি দরকারি রাসায়নিক পদার্থ। সেরোটোনিনের স্বল্পমাত্রা এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী হতে পারে।
৩. মস্তিষ্কের কিছু অঞ্চলের কার্যকারিতায় ভিন্নতাও একটি কারণ বলে মনে করা হয়।
বিডিডি এর জন্য আক্রান্ত ব্যক্তি কিংবা তার মা-বাবাকে দোষারোপ করা যায় না। কারণ এটি এক ধরনের মানসিক অবস্থা, যার জন্য চিকিৎসা প্রয়োজন।
বডি ডিসমর্ফিক ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত কারো জন্য বিষয়টি কেমন?
বিডিডিতে আক্রান্ত হলে চিন্তা ও উদ্বেগের কারণে অনেক সময় এবং শক্তি তাকে খরচ করতে হয়। বিডিডিতে আক্রান্ত একজন ব্যক্তি, তার চেহারা কেমন তা নিয়ে কখনই সঠিক ধারণা রাখেন না। এই সমস্যার কারণে, বিডিডি আক্রান্ত ব্যক্তি প্রায়ই বন্ধুবান্ধবদের সাথে থাকা, স্কুলে যাওয়া বা কর্মস্থলে যাওয়া, বা স্বাভাবিক কাজকর্ম মিস করে। এটি তাদেরকে একা, দুঃখিত বা বিষণ্ণ করে তোলে।
কেউ কেউ ত্রুটি ঠিক করার আশায় চিকিৎসা নেয় কিংবা অস্ত্রোপচারের কথা ভাবে। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই ত্রুটি দূর করার জন্য এগুলোর কোনকিছুরই দরকার নেই।
যদি কারো ডিসমর্ফিক ডিসঅর্ডার থাকে?
যদি কেউ মনে করে তার বিডিডি থাকতে পারে তাহলে-
১. পিতামাতা, থেরাপিস্ট, ডাক্তার, বা প্রাপ্তবয়স্ক যার ওপর বিশ্বাস করা যায় তার সাথে করেন তার সাথে কথা বলতে হবে। সেই সাথে মনের অবস্থা, চিন্তাভাবনা এবং চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বলতে হবে।
২. সিবিটি নিতে থেরাপিস্ট খুঁজে পেতে হবে।
আপনার BDD আছে কিনা তা জানতে CBT থেরাপিস্টের সাথে দেখা করতে হবে।
৩. নিজেকে দেখার পদ্ধতি পরিবর্তন করতে সময় এবং প্রচেষ্টা লাগে। থেরাপিস্টের সাথে সৎ এবং খোলামেলাভাবে সব বলতে হবে। বিষণ্ণ বোধ করলে সে বিষয়েও জানাতে হবে।
সমস্যাকে আমলে এনে তার নিরাময়ে ব্যবস্থা গ্রহণের মানসিকতা থাকতে হবে। নিজের সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দূর করে স্বাভাবিক সুস্থ মানসিক স্বাস্থ্য অর্জন করা কঠিন কোন বিষয় নয়।
লেখক: বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা