কোনো সন্দেহ নেই ফেরেশতাদের ভেতর জিবরাইল (আ.)-ই ছিলেন মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। কেননা তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর কাছে ওহি নিয়ে আসতেন, সাহায্যের প্রয়োজন হলে তিনি প্রেরিত হতেন এবং শরিয়তের কোনো বিধানের প্রায়োগিকরূপ দেখানোর প্রয়োজন হলে তিনি তা দেখিয়ে দিতেন। পবিত্র কোরআনে বিষয়টি এভাবে বর্ণিত হয়েছে, ‘তাকে শিক্ষা দান করে শক্তিশালী, প্রজ্ঞাসম্পন্ন এবং সে নিজ আকৃতিতে স্থির হয়েছিল, তখন সে ঊর্ধ্ব দিগন্তে, অতঃপর সে তার নিকটবর্তী হলো, অতি নিকটবর্তী, ফলে তাদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান রইল অথবা তারও কম। তখন আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি যা ওহি করার তা ওহি করলেন।’ (সুরা : নাজম, আয়াত : ৫-১০)
উল্লিখিত আয়াত থেকে ধারণা হতে পারে, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনে জিবরাইল (আ.)-এর ভূমিকা ছিল শিক্ষকের মতো। তবে বিষয়টি মোটেই এমন নয়।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষার ব্যাপারে জিবরাইল (আ.) মোটেই মধ্যস্থ ছিলেন না। তিনি ছিলেন কেবলই বার্তাবাহক।
আর বার্তাবাহককে কখনোই মধ্যস্থ বা শিক্ষক বলা যায় না। যেমন—একজন শিক্ষক যদি নিজ ছাত্র বা মুরিদের কাছে কোনো শিক্ষণীয় বিষয়ে চিঠি পাঠান। আর ডাকব্যবস্থার ডাকপিয়ন সে চিঠি সেই ছাত্র বা মুরিদের কাছে পৌঁছে দেয়, তবে কি কেউ ডাকপিয়নকে তাদের শিক্ষক বলবে? না, সেটা বলা হবে না, বরং চিঠি প্রেরকই তাকে শিক্ষা দিয়েছেন বলা হবে। জিবরাইল (আ.) বার্তাবাহক হয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে মহানবী (সা.)-এর কাছে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি নিজে তা শিক্ষা দেননি।
এ বিষয়ে আরেকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। মনে করুন, কোনো বাদশাহ যদি কাউকে মন্ত্রী নিয়োগ করেছেন মর্মে ফরমান জারি করেন এবং তা একজন দারোয়ানের মাধ্যমে নবনিযুক্ত মন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেন, তবে কাকে নিয়োগকারী বলা হবে? বাদশাহকে, না দারোয়ানকে? একইভাবে বাদশাহ যদি কিছু আইন জারি করে বার্তাবাহকের মাধ্যমে মন্ত্রীর কাছে পাঠান, তবে এই আইনগুলো কে জারি করল আর কে তা মন্ত্রীকে শেখাল? বাদশাহ, না বার্তাবাহক। মহানবী (সা.)-এর ব্যাপারে জিবরাইল (আ.)-এর ভূমিকাও অনুরূপ ছিল।
মূলকথা হলো, মহান আল্লাহ রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে কোনো মাধ্যম ছাড়াই শিক্ষা দিয়েছেন। সুতরাং দুনিয়ার কোনো মানুষই তাঁর সমকক্ষ জ্ঞানী হতে পারে না।
মহানবী (সা.) কোনো মাধ্যম ছাড়াই জ্ঞান লাভ করলেও তিনি দুনিয়াবাসীকে কোনো পার্থিব জীবনের উপায়-উপকরণ সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করতে বলেননি। তিনি বলেন, ‘তুমি পৃথিবীতে বসবাস কোরো পথিকের মতো।’ এই হাদিসে তিনি উম্মতকে পার্থিব জীবনের উপকরণ গ্রহণ করার অনুমতি দিয়েছেন, তবে মোহ ত্যাগ করে অল্পে তুষ্ট হতে বলেছেন। ঠিক যেমন একজন পথিক সফরের সময় ততটুকুই রশদ নেয়, যতটুকু না হলে নয়। এই হাদিসের আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, মহানবী (সা.) বলেছেন, কেমন যেন তুমি পথিক বা পথিকের মতো। তিনি বলেননি, পথিক হয়ে বসবাস কোরো। যেন তাঁর নির্দেশ পালন করা মানুষের জন্য অসম্ভব হয়ে না যায়।
অন্য হাদিসে মহানবী (সা.) বলেন, তুমি পৃথিবীতে মৃত ব্যক্তির মতো বাস কোরো। অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির যেমন পৃথিবীর প্রতি কোনো আসক্তি থাকে না, তেমন তোমার ভেতরও যেন দুনিয়ার প্রতি আসক্তি না থাকে। এক হাদিসে নবীজি (সা.) বলেছেন, তুমি নিজেকে কবরবাসীর অন্তর্ভুক্ত মনে কোরো। অর্থাৎ তুমি পার্থিব জীবনের তাড়নায় কবরের জীবনকে ভুলে যেয়ো না।
আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।
মাওয়ায়িজে আশরাফিয়া থেকে আলেমা হাবিবা আক্তারের ভাবানুবাদ
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন