শিরোনাম
শনিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

কৃত্রিম সংকটে মোটা চালের মোকাম

বাজার দর

মোস্তফা কাজল

কৃত্রিম সংকটে মোটা চালের মোকাম

রাজধানীর নিত্যপণ্যের বাজারে মধ্যবিত্তের মোটা চাল কৃত্রিম সংকটের মুখে পড়েছে। ওয়াকিবহাল সূত্রগুলোর মতে, মিলারদের কারসাজিতে এ চালের বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারি ও খুচরা বাজারের সব মোকামেই চালের কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে মোটা চালের কেজি এখন ৪০ টাকা। এ ছাড়া রাজধানীর কাঁচাবাজারে এক সপ্তাহের ব্যবধানে শাক-সবজিসহ বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের দাম আরও বেড়েছে। এর মধ্যে সবজির দাম কেজিতে বেড়েছে ১০ থেকে ৩০ টাকা। সরেজমিন গতকাল রাজধানীর মিরপুর ও নর্দ্দা বাজার ঘুরে সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য থেকে জানা গেছে, বগুড়া,  শেরপুর, জামালপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর ও নাটোরের মোকামগুলোর মিলাররা চাল ছাড়ছেন না। তারা অধিক মুনাফার আশায় এ কাজ করছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মিল মালিকরা এখনো ৬ লাখ ২০ হাজার টন চাল সরবরাহ করেননি। নানা অজুহাতে কয়েকবার সময় বাড়িয়েও তারা পুরোপুরি চাল সরবরাহ করেননি। তারা ৬ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন চাল দেওয়ার বদলে সরকারকে দিয়েছেন মাত্র ৪ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন চাল। তাদের কাছে এখনো পাওনা ১ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন। এ অবস্থায় খাদ্য মন্ত্রণালয় আগামী ৩১ অক্টোবরের মধ্যে মিলারদের প্রতি বাকি চাল সরবরাহের নির্দেশ দিয়েছে। এতে হুঁশিয়ার করে বলা হয়েছে, যে সব মিলার এ সময়ের মধ্যে চাল দিতে ব্যর্থ হবেন, তাদের আগামী ৫ বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করা হবে। এরপরেও এখন পর্যন্ত মিলাররা চাল সরবরাহে উদ্যোগী হননি। ধারণা পাওয়া গেছে, তারা সরকারের কাছ থেকে সরবরাহের সময় বাড়ানোর চেষ্টা করছেন, না হলে হয়তো তারা ২/৩ দিনের মধ্যে বাকি চাল সরবরাহ করতে পারেন। আর এ বিষয়টি আঁচ করতে পেরেই সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই চালের দাম কমবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার সরকার ৭ লাখ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল, সে অনুযায়ী সংগ্রহীত ধান থেকে চাল বানানো হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, দেশে এ বছর ২৪ হাজার  মেট্রিক টন চাল বাড়তি উৎপাদিত হয়েছে। আর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, এই মুহূর্তে সরকারের গুদামে মজুদ আছে সাড়ে ৭ লাখ মেট্রিক টন চাল। পাইপ লাইনে আছে আরও দেড় লাখ মেট্রিক টন চাল। সব মিলিয়ে ৯ লাখ মেট্রিক টন চাল। এই বাস্তবতায় আগামী ডিসেম্বরে উঠবে আমন ধান। এ বছর আমনেরও বাম্পার ফলন হয়েছে। মিলারদের কারসাজি সম্পর্কে ওয়াকিবহালরা বলছেন, তারা ধান সরবরাহে সংকট দেখিয়ে চালের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন। এমনকি প্রতি বস্তা চালে মিলগেটেই ৩০০-৪০০ টাকা আগের চেয়ে বেশি দরে বিক্রি করছেন। কারসাজি করে এভাবে বেশি দাম নেওয়ায় ঢাকার পাইকারি বাজারগুলোয় চাল আসা একেবারেই কমে  গেছে। যেহেতু সামনে আমন মৌসুম এবং এবার এর বাম্পার ফলন হবে, সেহেতু চালের দাম অবশ্যই কমবে—এমন ধারণা থেকে অনেকে চাল মজুদ রাখা বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে বাজারে স্বাভাবিক সরবরাহে বিঘ্ন ঘটেছে। আর এই সুযোগটিও কাজে লাগিয়েছেন মিলাররা। সূত্র মতে, ধান সংকটের কারণে চালের দাম বাড়ছে। মোটা ও স্বর্ণা চালের ধান পাওয়া যাচ্ছে না। অগ্রহায়ণ মাসের ধান ওঠার আগে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকবে। কমার সুযোগ নেই। এখন যে ধান রয়েছে তার সবই মিলারদের হাতে। এদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানাচ্ছে, মিলারদের কারসাজি প্রমাণিত হওয়ার পর কঠোর হয়েছে সরকার। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা বলেন, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাওয়ার কথা ভাবছে সরকার। এ ক্ষেত্রে মিলারদের অপরাধ তিনটি। প্রথমত, মিলাররা একদিকে সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী চাল সরবরাহ করেননি। দ্বিতীয়ত, তারা যে দেড় লাখ টন চাল সরবরাহ করেননি, সেই চালের ঘাটতি দেখিয়ে বাজারে চালের কৃত্রিম সংকটের গুজব ছড়িয়েছেন। পাশাপাশি জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়েছেন। আর তৃতীয় অপরাধ হচ্ছে, এই গুজবকে কাজে লাগিয়ে তারা অনৈতিক মুনাফা লুটে নিচ্ছেন। অপরদিকে মিলার আবদুর রউফ বলেন, এ বছর অতিবৃষ্টির কারণে ধান শুকানো যায়নি। ফলে সরকারের গুদামে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চাল সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। এখন আবহাওয়া ভালো হয়েছে। রোদ আছে। কাজেই ধান শুকিয়ে চাল বানিয়ে গুদামে সরবরাহ করতে বেশি সময় লাগবে না। সরকার ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত যে সময় দিয়েছে তার আগেই আমরা চাল সরবরাহ করতে পারব। তিনি আরও বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে ধান মজুদ করে রাখার যে অভিযোগ উঠেছে, তা সত্য নয়। আমাদের কারসাজিতে চালের দাম বাড়ার যে অভিযোগ উঠেছে, সেটিও সত্য নয়। আবহাওয়ার কারণেই চালের সরবরাহে বিঘ্ন ঘটেছে। আশা করছি, এক সপ্তাহের মধ্যে বাজারে চালের সরবরাহ স্বাভাবিক হবে এবং চালের দামও কমে যাবে। মজুদের অভিযোগ অস্বীকার করে পাইকারি চাল ব্যবসায়ী আবদুল আউয়াল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এখন  কোনো পাইকারই চালের মজুদ করেন না। এর কারণ হচ্ছে, ১ মাসের বেশি সময় চাল গোডাউনে রাখলে পোকায় ধরে। তখন বস্তার দাম আগের মতো পাওয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়েই সবাই চাল বিক্রি করে দেন। সবজির বাজার চড়া : সবজির বাজার চড়া। প্রতিদিনই কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়ছে। একবার দাম বাড়লে কমার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। গতকাল রাজধানীর মিরপুর ও নর্দ্দা কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি শিম বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়, যা গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকায়। এ ছাড়া করলা ৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৭০ টাকা, গাজর ১০ টাকা থেকে ৮০ টাকা, ঢেঁড়স ১০ টাকা থেকে হয়েছে ৬০ টাকা, কচুরলতি ১০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৫০ টাকা। ঝিঙ্গা ২০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৬০ টাকা, বরবটি ৩০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৮০ টাকা, চিচিঙ্গা ২০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৬০ টাকা। কাঁকরোল ১০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৭০ টাকা, পেঁপে ২ টাকা বেড়ে হয়েছে ২৫ টাকা, পটোল ১০ টাকা বেড়ে মানভেদে হয়েছে ৫০-৬০ টাকা। অপরিবর্তিত রয়েছে কাঁচামরিচ, মুলা, ফুলকপি, বেগুন, লাউ, কুমড়া, শসা ও টমেটোর দাম। বাজারের সবজি বিক্রেতা মজিদ মিয়া বলেন, সবজির দাম তো প্রতি সপ্তাহেই বাড়ে-কমে। এখন যেসব সবজির মৌসুম শেষের দিকে রয়েছে, সেগুলোর দাম কিছুটা বেড়েছে। এ ছাড়া বাজারে শীতের সবজিও আসতে শুরু করেছে। তাই এগুলোর দামটা একটু বাড়তি। তবে আগামী দুই তিন সপ্তাহ পর শীতকালীন সবজি পুরোপুরি বাজারে এসে গেলে দাম কমে যাবে। এদিকে এক সপ্তাহের ব্যবধানে আবার ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে। বিশেষ করে সয়াবিন তেল প্রতি লিটারে  বেড়েছে ৬ টাকা। ফলে ৯৮ টাকার এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল এখন ১০৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ার কারণে বেশি দামে আমদানি করতে হচ্ছে। এ কারণেই দেশি বাজারে দাম বেড়েছে। গত সপ্তাহের তুলনার কেজিতে ৩ টাকা কমে আলু বিক্রি হচ্ছে ২২ টাকায়। আমদানি করা রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকায়, দেশি রসুন ১৫০ টাকায় এবং আদা ৮০ টাকায়। পিয়াজের দাম গত সপ্তাহে বেড়ে যা হয়েছিল বর্তমানে সে দামেই বিক্রি হচ্ছে। মাছের বাজারে দেখা গেছে, রুই কেজি প্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, শিং ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা, পাঙ্গাস ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা এবং কৈ ২০০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে বাজারে ইলিশের দেখা  মেলেনি। এ ছাড়া গরুর মাংস ৪৪০ থেকে ৪৫০ টাকা, খাসির মাংস ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর