ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চিকিৎসা নিতে এসে ধরা পড়ে জাহিদুল ইসলাম সোহাগ (৪০)। তার বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, সোহাগ ছিনতাই করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। একটি মিস ফায়ারের ঘটনায় ধরা পড়ে এই ছিনতাইকারী চক্রটি। এরা মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাসে কখনো বধির স্কুল, কখনো ডিবি ও র্যাবের স্ট্রিকার লাগিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই করে বেড়াত। ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত দুটি মোটরসাইকেল জব্দ করতে পারলেও পুলিশ তাদের ব্যবহৃত মাইক্রোটি এখনো উদ্ধার করতে পারেনি। গত ২৩ মার্চ রাজধানীর গুলিস্তানে হানিফ ফ্লাইওভারের পূর্ব পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন সুজাউদ্দিন তালুকদার (৩৭)। তিনি নাভানা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের নির্বাহী কর্মকর্তা। দুপুর ১টার দিকে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। তার বাম পায়ে গুলি লাগে। একই সময় ওই এলাকায় জাহিদুল ইসলাম সোহাগ (৪০) নামের আরেক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়। তার বাড়ি ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে। একে একে দুজনই চিকিৎসা নিতে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি হয়। সেখানে উভয়ই দাবি করে, তারা ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছে। ওইদিনই আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ এবং পথচারীদের সাক্ষ্য নিয়ে কিছু সময় পর পুলিশ জানায়, সুজাউদ্দিনের কাছ থেকে মূল্যবান কাগজপত্র ও ব্যাংকের চেক ছিনতাই করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয় সোহাগ। তার আগে সুজাউদ্দিন গুলিবিদ্ধ হন। কিন্তু সোহাগকে গ্রেফতারের পর তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানতে পারেন, গুলিস্তান নাট্যমঞ্চের পূর্বপাশ দিয়ে সুজাউদ্দিন অফিসের কাজে হেঁটে নবাবপুরের দিকে যাচ্ছিলেন। এ সময় বিপরীত দিকে থেকে দুটি মোটরসাইকেল তাকে অনুসরণ করতে থাকে। একপর্যায়ে মোটরসাইকেল থেকে নেমে সোহাগ রাস্তায় থাকা সুজাউদ্দিনের হাতের ব্যাগ ধরে টান দেয়। তবে সুজাউদ্দিন তাতে বাধা দেন। দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। সোহাগ এ সময় সুজাউদ্দিনকে এলোপাতাড়ি ঘুষি মারে। ব্যাগটা নিতে না পেরে মোটরসাইকেলে থাকা আরেক ছিনতাইকারী পিস্তল বের করে সুজাউদ্দিনের বাম পায়ে গুলি করে। এ সময় অপর গুলি সোহাগের বাম পায়ে বিদ্ধ হয়। পরে সুজাউদ্দিনের কাছ থেকে তার হাতব্যাগটি নিয়ে ছিনতাইকারীরা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। আহতাবস্থায় সুজাউদ্দিনকে হাসপাতালে এনে ভর্তি করে মনির হোসেন নামে এক পথচারী।
ঢামেক সূত্র জানায়, সুজাউদ্দিনকে হাসপাতালে আনার মিনিট দশেক পর জিন্স প্যান্ট ও স্যান্ডো গেঞ্জি পরা সোহাগকেও হাসপাতালে আনা হয়। তখন সোহাগ ফুটপাথে হাঁটার সময় গুলিবিদ্ধ হয় বলে দাবি করে। তাদের চিকিৎসা চলাকালে বেলা পৌনে ২টার দিকে ঢামেক হাসপাতালে পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহমুদুল হকের নেতৃত্বে পুলিশের দল আসে। তাদের সঙ্গে ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী। তারা গুলিবিদ্ধ দুজনের সঙ্গে কথা বলেন। কথা বলার একপর্যায়ে জাহিদুল ইসলাম সোহাগের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেন ওসি। এদিন রাতে তার বিরুদ্ধে ছিনতাইয়ের অভিযোগে মামলা করা হয়। পরে মামলাটি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি-পূর্ব বিভাগ) স্থানান্তর করা হয়। জানা যায়, গত ১৮ এপ্রিল উত্তরার খালপাড় এলাকায় ঘটে একই ধরনের ঘটনা। সিরাজ নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে প্রায় ৭ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় ছিনতাই চক্র। ছিনতাইয়ের খবর পেয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় যায় ডিবি। সেখানে ওই ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়। এই জিডির ভিত্তিতে চলে নতুন করে তদন্ত। উত্তরার সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেখে একজনকে গ্রেফতার করে ডিবি। আগে গ্রেফতার হওয়া সোহাগের সামনে হাজির করা হয় তাকে। মুহূর্তেই সোহাগ তাকে চিনে ফেলে। তাদের দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে একে একে গ্রেফতার করা হয় ছিনতাই চক্রের আরও ৪ সদস্যকে। সোহাগ ছাড়া বাকিরা হলো মিজান ওরফে ডেমরা মিজান, রাসেল, স্বপন ও বারেক। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গত ২৩ মার্চ দুপুরে সংঘটিত ছিনতাইয়ের আসল ঘটনা। আসামিরা জানায়, ওইদিন রাজধানীর মহানগর নাট্যমঞ্চের কাছে ব্যাগভর্তি টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে মিজান ও সোহাগ। আশপাশে ওই চক্রের আরও দুজন সে সময় উপস্থিত ছিল। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে সুজাউদ্দিন মাটিতে পড়ে যান। এ সময় আশপাশের লোকজন ধর ধর বলে চিৎকার দিলে মিজান গুলি চালায়। সুজাউদ্দিন গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হলেও ভুলক্রমে একটি গুলি গিয়ে লাগে ছিনতাইকারী চক্রের আরেক সদস্য সোহাগের পায়ে। পরে নিরুপায় হয়ে সোহাগকে রেখে মিজান পালিয়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানায়, তারা একটি মাইক্রোবাস ভাড়া নিয়ে ছিনতাই করত। চক্রের মূলহোতা আবদুল হকের সঙ্গে পল্টনের জাতীয় বধির স্কুলের কর্মকর্তাদের যোগাযোগ ছিল। তাই তিনি রেন্ট-এ কারে কখনো বধির স্কুলের স্টিকার, কখনো ‘ডিবি’ ও ‘র্যাবের’ স্ট্রিকার লাগিয়ে ছিনতাই করত। কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে তারা এসব করত। একটি গ্রুপ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা তুলে বের হওয়া ব্যক্তিদের সম্পর্কে তথ্য দিত। আরেক গ্রুপ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে সুযোগ বুঝে ছিনতাই করত। সর্বশেষ তারা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক থেকে একটি গরুর ট্রাক থেকে গরু ছিনতাই করে। মহাসড়কে তারা প্রায়ই এসএ পরিবহনের কুরিয়ার সার্ভিসের গাড়ি টার্গেট করে। জানতে চাইলে ডিবি-দক্ষিণ বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) খোন্দকার নুরুন্নবী এ প্রতিবেদককে বলেন, মামলাটি আমরা ডিটেক্ট করে ফেলেছি। ছিনতাইয়ের ওই ঘটনায় মোট ৫ জনকে এরই মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে এ চক্রের মোট সদস্য ১২ জন। অন্যরা এখনো গ্রেফতার হয়নি, তাদের গ্রেফতারে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।