সোমবার, ১৩ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

সরকারি চাকুরেদের করোনার ক্ষতিপূরণ নিয়ে বিভ্রান্তি

মৃত সরকারি কর্মচারীর পরিবারই ক্ষতিপূরণ পাবেন, আবেদন পড়েছে ১৫টি

মানিক মুনতাসির

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে কিংবা সুস্থ হচ্ছেন এমন সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সরকার যে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছে তা নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। চাকরিরত কিংবা সাধারণ মানুষ অনেকেই মনে করছেন, সরকারি কোনো চাকুরে আক্রান্ত হলেই লাখ লাখ টাকা পাবেন। এমনকি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ কোনো কোনো টিভি টকশোতেও এ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারের এ ঘোষণার পরপরই করোনাভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার ভুয়া পজিটিভ সনদ বাণিজ্যও বেড়েছে। যা অর্থবিভাগের নজরে এসেছে। কিন্তু অর্থবিভাগ বলছে, সরকারি চাকুরেরা আক্রান্ত হলেই লাখ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন, এটা ঠিক নয়। গত ২৩ এপ্রিল জারি করা এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, যেসব সরকারি চাকুরে (ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, মাঠ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী এবং যদি প্রত্যক্ষভাবে (সরাসরি) নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য কর্মচারী দায়িত্ব পালনকালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে সরকার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এদিকে গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ ও স্বাস্থ্যসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এক বৈঠক করে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায়  নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আপাতত যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন বা ভবিষ্যতে কেউ মারা গেলে শুধু তাদেরকেই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। আর আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হচ্ছেন এমন কর্মকর্তারা পরবর্তীতে ক্ষতিপূরণ পাবেন। খুব শিগগিরই এ সংক্রান্ত নতুন নির্দেশনা জারি করবে অর্থবিভাগ। অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু সরকারি চাকুরে হলেই হবে না বরং যদি কেউ করোনা নিয়ন্ত্রণ, করোনাভাইরাস সংক্রান্ত স্বাস্থ্য কিংবা অন্যান্য সেবা প্রদান কাজে সরাসরি নিযুক্ত থেকে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হন কিংবা আক্রান্ত হয়ে মারা যান কেবলমাত্র তারাই সে ক্ষতিপূরণ পাবেন। ধরুন, কোনো চিকিৎসক হাসপাতালে কর্মরত আছেন কিন্তু তিনি করোনভাইরাস ডেডিকেটেডের বাইরের কোনো ওয়ার্ডে চিকিৎসা দিচ্ছেন তিনি আক্রান্ত হলেও ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্য হবেন না। অর্থবিভাগ সূত্র আরও জানায়, কভিড-১৯ মহামারী বাংলাদেশে শুরু হওয়ার পর প্রত্যক্ষভাবে দেশের জন্য প্রথম জীবন উৎসর্গকারী চিকিৎসক সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিনের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দিনের পরিবার সরকার ঘোষিত ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করেছেন। এই আবেদনের দুই মাস পেরিয়ে গেলেও সে দাবিনামা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এর আগে গত ২৩ এপ্রিল অর্থ বিভাগ থেকে এক পরিপত্র জারি করা হয়। সেখানে বলা হয়, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় যেসব চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসনসহ সরকারি কর্মচারীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁদের কেউ আক্রান্ত হলে গ্রেড ভেদে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা করে দেবে সরকার। তাঁদের কেউ মারা গেলে উত্তরাধিকারী বা উত্তরাধিকারীদের দেওয়া হবে ২৫ থেকে ৫০ লাখ টাকা করে। জানা গেছে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ১৫ এপ্রিল কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে মারা যান এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিনের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দিন। এরপর গত ২৭ এপ্রিল করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া চিকিৎসক মঈন উদ্দীনের পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের আবেদন করা হয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে গত ২৭ এপ্রিল আবেদনটি করেন মঈন উদ্দীনের স্ত্রী চৌধুরী রিফাত জাহান। এরপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিভাগ আবেদন অনুযায়ী টাকা ছাড়ের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায়। গতকাল পর্যন্ত আড়াই মাস পার হয়েছে। কিন্তু এখনো ক্ষতিপূরণের টাকা পায়নি তার পরিবার। এ বিষয়ে ডা. মঈন উদ্দিনের ভায়রা সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক (মেডিসিন) ডা. তানভীর মোহিত গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আবেদনের দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। এটা দুঃখজনক। অর্থ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ে ইতিমধ্যে ১২ থেকে ১৫টি ক্ষতিপূরণের আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে মৃত এবং আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন এমন আবেদন রয়েছে। কিন্তু এ সংক্রান্ত ফাইল ওপেন না হওয়ায় ক্ষতিপূরণের অর্থ ছাড় শুরু হয়নি। অর্থ বিভাগের যে শাখা থেকে এ সংক্রান্ত কাজ হওয়ার কথা সেই বিভাগের বেশ কয়েকজন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ফলে অর্থ ছাড় বিলম্বিত হচ্ছে। ওই পরিপত্রে আরও বলা হয়, ২০১৫ এর বেতন স্কেল অনুযায়ী, ১৫-২০তম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে তিনি ক্ষতিপূরণ পাবেন পাঁচ লাখ, মারা গেলে পাবেন ২৫ লাখ টাকা। ১০-১৪তম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে পাবেন সাড়ে সাত লাখ এবং মারা গেলে সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা। এ ছাড়া প্রথম-নবম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে পাবেন ১০ লাখ এবং মারা গেলে ৫০ লাখ টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি প্রশাসনের মাঠপর্যায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ যারা প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তাদের সবার জন্য স্বাস্থ্যবীমার কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু বীমার ক্ষেত্রে সরকারকেই প্রিমিয়াম দিতে হবে। এ ছাড়া বীমার টাকা পেতে আইনি প্রক্রিয়া শেষ করতে অনেক সময় লেগে যায়। তাই মাঠপর্যায়ে যারা কাজ করছেন তাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে সরাসরি আর্থিক সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এদিকে গতকাল পর্যন্ত কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য সেবায় নিয়োজিত সরকারি বিভিন্ন সংস্থা, দফতরে কর্মরত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, আর্মিসহ প্রশাসনের কর্মরতদের মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। আর মারা গেছেন অন্তত ২০৬ জন।

এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জড়িত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৫৪৪ জন। মারা গেছেন ৬৫ জন। এর মধ্যে ৬৩ জনই চিকিৎসক। যাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন হাসপাতালের আইসিইউতে কর্মরত ছিলেন। বাংলাদেশ পুলিশের ১২ হাজার ৫৮২ জন আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ৪৮ জন। এর মধ্যে ডিএমপিরই আড়াই হাজার সদস্য আক্রান্ত। এ ছাড়া পুলিশ বাহিনীর প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ জন সদস্য কোয়ারেন্টাইনে আছেন। এখনো আইসোলেশনে আছেন অন্তত ৫ হাজার জন। আর সুস্থ হয়েছেন প্রায় ৯ হাজার জন। প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত প্রায় ৩০০ কর্মকর্তা আক্রান্ত হয়েছেন। সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে মারা গেছেন ১৫ জন। এদিকে গতকাল আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) এক বার্তায় জানানো হয়, অদ্যাবধি সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত ৬ হাজার ২০৫ জন সদস্য বা তাদের পরিবারের ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছেন চার হাজার ৬৭৫ জন। মৃত্যুবরণ করেছেন ৭৮ জন। এর মধ্যে গত এক সপ্তাহেই আক্রান্ত হয়েছেন ৫০৮ জন এবং কর্মরত দুই সেনা সদস্যসহ মারা গেছেন ১২ জন।

সর্বশেষ খবর