বৃহস্পতিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

ইলিশ রক্ষায় নদীতে জেলেদের উৎসবের মহড়া

রফিকুল ইসলাম রনি, মোহনপুর (চাঁদপুর) থেকে ফিরে

ইলিশ রক্ষায় নদীতে জেলেদের উৎসবের মহড়া

মা-ইলিশ রক্ষায় নদীতে যেন উৎসবে মেতেছেন জেলেরা। সারা দেশে গতকাল ১৪ অক্টোবর থেকে আগামী ৪ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন নিষিদ্ধ করা হয়েছে মা-ইলিশ আহরণ, পরিবহন, মজুদ, বাজারজাতকরণ, বিনিময়করণ। এ বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। জেলেদের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে বিশেষ রেশনিংয়ের। ফলে জেলেরা নদীতে নামেননি জাল নিয়ে। বরং ‘মা-ইলিশ ধরব না, দেশের ক্ষতি করব না’, ‘আর ধরব না জাটকা, ইলিশ খাব টাটকা’ স্লোগানে চাঁদপুর মোহনায় মেঘনা নদীতে মা-ইলিশ রক্ষায় নৌবহরে স্বতঃস্ফূর্ত শামিল হয়েছিলেন শত শত জেলে। স্লোগান- সংবলিত পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে উৎসবে মেতে ওঠেন তারা। গতকাল বিকাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ঘাট থেকে চাঁদপুরের চর রাজৈশ্বর, মোহনপুর, হরিণাঘাট এলাকায় চোখে পড়ে নদীতে জেলেদের পাহারা দেওয়ার দৃশ্য।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং নৌপুলিশ আয়োজন করে ‘মা-ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান’। এতে অংশ নিয়ে সরেজমিন নারায়ণগঞ্জের মেঘনা নদীবন্দর থেকে চাঁদপুরের মতলব উপজেলার মোহনপুর এলাকা পর্যন্ত পরিদর্শনে যান মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম। এ সময় মন্ত্রণালয়ের সচিব রওনক মাহমুদসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। নৌপুলিশের বিশেষ লঞ্চটি দুপুর নাগাদ মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় পৌঁছয়। এ সময় মৎস্যমন্ত্রীর নৌবহরকে স্বাগত জানান অর্ধশতাধিক নৌকায় পাঁচ শতাধিক জেলে। তারা নেচে-গেয়ে সরকার-ঘোষিত ‘মা-ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান’কে উৎসাহিত করতে উৎসবে মেতে ওঠেন। এ ছাড়া মন্ত্রীর নামে নানা স্লোগান দিতে থাকেন জেলেরা। লঞ্চ থেকে মন্ত্রী হাত নেড়ে জেলেদের অভিবাদনের জবাব দেন।

মেঘনায় যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি। বালুবাহী যাত্রীবাহী ট্রলার দেখা গেলেও কোনো মাছ ধরার দৃশ্য নেই নদীতে। বেলা ১টার দিকে চাঁদপুরের মতলবের মোহনপুর এলাকায় পৌঁছানোর আগেই একশর বেশি ট্রলারে হাজারো জেলেকে মাছ না ধরার প্রচারণা চালাতে দেখা যায়। এ সময় তারা নৌবহরকে স্বাগত জানিয়ে মোহনপুর পর্যন্ত নিয়ে যান। মোহনপুর থেকে ফেরার পথেও চোখে পড়ে একই চিত্র। জেলেদের পাশাপাশি ছিল নৌপুলিশের টহল।

মোহনপুরে স্থানীয় জেলে ও মৎস্যজীবী সম্প্রদায়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের উদ্দেশে মা-ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানের গুরুত্ব তুলে ধরে বক্তব্য প্রদান করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। তিনি বলেন, ‘মৎস্য খাতে একটা বিপ্লবের সৃষ্টি হয়েছে। দেশের সব মানুষের মাছের চাহিদা আমরা পূরণ করতে পেরেছি। ইলিশের উৎপাদন এবার অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ব্যাপক আকারে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইলিশ ধরার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মৎস্যজীবী, জেলেসহ যারা মাছ বিপণন করেন সবার ভূমিকা রয়েছে। অভিযানে শত শত জেলে যোগ দিয়ে মা-ইলিশ রক্ষায় স্লোগান দিচ্ছেন। অফুরন্ত সম্ভাবনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে এটাই হচ্ছে দৃষ্টান্ত। মা-ইলিশ সংরক্ষণের সময় মৎস্যজীবীরা যাতে কষ্টে না থাকেন, সে জন্য এবার অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি ভিজিএফ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আগামী বছর আরও বেশি বরাদ্দ দেওয়া হবে।’

মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের উদ্দেশে শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘মা-ইলিশ সংরক্ষণে আমাদের সহায়তা করুন। ইলিশের উৎপাদন এমন জায়গায় নিয়ে যাব, যাতে প্রতিটি ঘরে, গ্রামে সবাই ইলিশ খাওয়ার পরও উপচে পড়বে। সেই ইলিশ আমরা রপ্তানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে শেখ হাসিনার উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে আরও ত্বরান্বিত করব। আশা করি আমাদের এ অভিযান সার্থক করতে যে যেখানে আছেন সহায়তা করবেন।’

মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এবার কঠোর। আমাদের এ অভিযানকে নষ্ট করার জন্য কেউ যদি গভীর রাতেও মা-ইলিশ ধরতে আসে, তাদের আটকানোর জন্য নৌপুলিশ, কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর অভিযান চলমান থাকবে। এমনকি আকাশপথে নজরদারির জন্য থাকবে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার। আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করব, কেউ মা-ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান ধূলিসাৎ করার জন্য ভূমিকা রাখছেন কিনা। যারা মা-ইলিশ সংরক্ষণে সহায়তা করবেন না, তাদের ঠিকানা হবে জেলখানা। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাদের সাজা দেওয়া হবে। তাই কোনো দুর্বৃত্তের প্ররোচনায় মৎস্যজীবী ভাইয়েরা মা-ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানে বিঘ্ন ঘটাবেন না বা নিয়মের বাইরে কোথাও আসবেন না।’ 

এ সময় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব রওনক মাহমুদ, অতিরিক্ত সচিব শাহ মো. ইমদাদুল হক, শ্যামল চন্দ্র কর্মকার, সুবোল বোস মনি ও মো. তৌফিকুল আরিফ, মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক কাজী শামস আফরোজ, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ, নৌপুলিশের ডিআইজি মো. আতিকুল ইসলাম, চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মো. মাজেদুর রহমান খান, পুলিশ সুপার মো. মাহমুদুর রহমান, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আসাদুল বাকী, মতলব উত্তর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এম এ কুদ্দুস, মৎস্যজীবীদের প্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা ও নৌপুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে মা-ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানের প্রথম দিন গতকাল মেঘনায় জেলেদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও প্রচারাভিযানকে স্বাগত জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে মা-ইলিশ সংরক্ষণে সরকারের নানামুখী উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন জেলে ও মাছ ধরার সঙ্গে যুক্ত অন্য পেশাজীবীরা। এ প্রসঙ্গে জাতীয় মৎস্যজীবী অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফণীভূষণ মালো মানিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘১৪ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান সফল করতে হবে। এই সময় সরকার জেলেদের রেশনিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। এটা ইতিবাচক দিক। জেলে সম্প্রদায় এটাকে স্বাগত জানিয়েছে। কারণ এখন প্রজননের সময় মা-ইলিশ রক্ষা করলে সারা বছর প্রচুর ইলিশ পাওয়া যাবে। আমরা দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইলিশ রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হব।’

মোহনপুরের জেলে সুরুজ্জামান মিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মাছ ধরাই আমাদের একমাত্র জীবন-জীবিকার উৎস। মাছ ধরা বন্ধ তো কারও কারও ঘরে খাবার বন্ধ। এখন সরকার আমাদের ভিজিডি কার্ডের মাধ্যমে চাল বরাদ্দ দিচ্ছে। আমরা এতেই খুশি। সেই কারণে মা-ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানকে স্বাগত জানিয়ে আনন্দ-উৎসব করছি।’ সুরুজ্জামানের সঙ্গে একমত হলেন জেলে তুহিন হালদার, তৌফিক হালদার, মমিন মাঝি প্রমুখ।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব রওনক মাহমুদ বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার ২২ দিন আমরা প্রত্যেক জেলেকে ২০ কেজি করে চাল দিচ্ছি। মৎস্যজীবী সমিতি, জেলে ও বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে আমরা ইলিশ সম্পদ রক্ষা করব।’

এদিকে নৌপুলিশের প্রধান আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘এ বছর জাটকা ধরা নিষেধকালীন ২৭টি জাহাজ দিয়ে ৫৯ দিন নদীতে আমাদের টিম কাজ করেছে। ফলে এবার বড় আকারের ইলিশ মানুষ বাজারে পেয়েছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর