শনিবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

খুনির সঙ্গে বসবাস

মির্জা মেহেদী তমাল

খুনির সঙ্গে বসবাস

যুক্তরাষ্ট্রে রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী আবুল বাশার সপরিবারে দেশে এসেছেন। উদ্দেশ্য ছেলেকে বাংলাদেশে বিয়ে করাবেন। বিয়ে শেষ করে আবারো সবাই উড়াল দেবেন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে। বিয়ের আয়োজন নিয়ে গাজীপুরের টঙ্গীর আরিচপুরে তাদের বাসায় বেশ আনন্দঘন পরিবেশ। দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয়স্বজন আসছেন, যাচ্ছেন। বিয়ের প্রস্তুতি পর্ব নিয়ে একটা হই হই রই রই অবস্থা। বাড়ির কেয়ারটেকার থেকে শুরু করে এলাকার ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীরাও তাদের এই আনন্দে শামিল। এই আনন্দঘন পরিবেশের মধ্যেই একটি ঘটনা বাশার পরিবারের সব কিছু ওলট পালট করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরেই আবুল বাশার তার স্ত্রী মনোয়ারা বেগমসহ পরিবারের সবাই তিন তলা ভবনের দোতলায় উঠেছেন। তিন তলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়াটে নেই, খালি। একদিন দুপুরে সেই ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে আসেন কয়েকজন ব্যক্তি। ফ্ল্যাট দেখানোর মতো বাসায় সেই সময় কেউ ছিলেন না। যে কারণে মনোয়ারা বেগম নিজেই ভাড়াটেদের ফ্ল্যাট দেখানোর জন্য তিন তলায় উঠেন। তিনি ফ্ল্যাট খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন। তার পেছনে ঢুকেন ভাড়া নিতে আসা ব্যক্তিরা। মনোয়ারা বেগম কিছু বুঝে ওঠার আগেই অজ্ঞাত সেই ব্যক্তিরা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে মনোয়ারা বেগমকে কুপিয়ে ফেলে রেখে চম্পট দেয়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু ঘটে ৫৭ বছর বয়সী মনোয়ারা বেগমের। ঘটনাটি ২০১৭ সালের জুন মাসের।

নোয়াখালীর আবুল বাসার ৪৫ বছর আগে দেশ ছাড়েন। জাহাজে করে মার্কিন মুুল্লুকে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি। সেখানে পরিশ্রম করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। স্ত্রী মনোয়ারা বেগম ও পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে আবুল বাশার নিউইয়র্কে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। সেখানে তার রেস্তোরাঁ রয়েছে। তিনি এবং তার স্ত্রী মনোয়ারা বেগম প্রতি দুই বছরে একবার করে বাংলাদেশে আসেন। এবার তারা এসেছেন ছেলের বিয়ে দিতে সপরিবারে। টঙ্গীর বাড়িতে তাদের পক্ষে ভাড়া উত্তোলনসহ কেয়ারটেকারের দায়িত্ব পালন করেন সোহেল। তার গ্রামের বাড়ি সোনাইমুরীর হীরাপুর।

নিজ বাসায় যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মনোয়ারা বেগম এমন নৃশংসভাবে খুন হওয়ায় গোটা গাজীপুরে তোলপাড় শুরু হয়। বাড়ির ছেলের বিয়ের আনন্দের পরিবর্তে শোক সাগরে ডুবে যায় পুরো পরিবার। তার স্বামী আবুল বাশার ও সন্তানেরা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন কেয়ারটেকার সোহেলও। লাশ জাপটে ধরে ‘খালাম্মা’ ‘খালাম্মা’ বলে আহাজারি করছিলেন। মনোয়ারা বেগম তাকে খুব আদর করতেন। সন্তানের মতোই ভালোবাসতেন। সোহেলের আহাজারিতে অনেকেই সেদিন চোখের পানি আটকে রাখতে পারেননি।

ভরদুপুরে এমন খুনের ঘটনাটি পুলিশ প্রশাসনকেও ভাবিয়ে তোলে। পুলিশ, র‌্যাব এই খুনের ঘটনাটি তদন্তে মাঠে নামে। আবুল বাশার পরিবারের সঙ্গে কারও কোনো শত্রুতা ছিল কি না, বা সম্প্রতি কোনো কিছু কারও সঙ্গে ঘটেছে কি না তা জানার চেষ্টা করে গোয়েন্দারা। তারা একপর্যায়ে জানতে পারে, এবার মনোয়ারা বেগমের সঙ্গে ভাড়ার টাকার হিসাব-নিকাশ নিয়ে মনোমালিন্য হয়েছে। ঠিক মতো হিসাব না দেওয়ায় মনোয়ারা বেগম গালাগাল করেছেন কেয়ারটেকার সোহেলকে। গোয়েন্দাদের সন্দেহের তীর এখন কেয়ারটেকার সোহেল। তারা সোহেলের খোঁজ করেন। কিন্তু সোহেল নেই। যে ছেলেটি মনোয়ারা বেগমের লাশ ধরে আহাজারি করছিলেন, ঘটনার পরদিন সকাল থেকেই লাপাত্তা! সন্দেহ আরও প্রকট হয় গোয়েন্দাদের। র‌্যাব গাজীপুর থেকেই গ্রেফতার করে কেয়ারটেকার সোহেলকে। কিন্তু সব প্রশ্নের জবাবেই সোহেলের এক জবাব, ‘আমার ফাঁসিতে যদি খালাম্মার খুনিরা ধরা পড়ে, তাহলে আমার ফাঁসি হোক। আমি চাই খুনিরা ধরা পড়ুক। খালাম্মা আমার মায়ের মতো। খালাম্মা নেই, আমারও বেঁচে থাকার দরকার নেই।’ ধন্দে পড়ে যায় র‌্যাব ও তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তবে কি তাদের কোথাও ভুল হচ্ছে? এমন ধন্দের মধ্যেই তদন্ত কাজে ধীরগতি হয়। খুনিরা ধরা পড়ে না। সোহেলকে পাঠানো হয় কারাগারে। মামলার তদন্ত সেখানেই থেমে থাকে। ধীরে ধীরে সব কিছুই স্বাভাবিক হতে থাকে। পেরিয়ে যায় এক বছর।

মামলার বাদী মনোয়ারা বেগমের স্বামী আবুল বাশারও হতাশ। তিনি আবেদন করেন মামলার তদন্তে ভার পিবিআইকে দেওয়ার জন্য। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলার তদন্তের ভার দেওয়া হয় পিবিআইকে।

পিবিআইয়ের গাজীপুরের পরিদর্শক মোস্তফা খায়রুল বাশারকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তদন্তভার পাওয়ার পর প্রথমে হত্যাকান্ডের কোনো সূত্র খুঁজে পাচ্ছিল না পিবিআই। খুনের বিষয়ে তদন্ত করতে যেয়ে দুটি নাম ঘুরে ফিরে আসে তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে। স্থানীয় সন্ত্রাসী স্বপন মিয়া ও আরিফ খানকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করে পিবিআই। এরা সন্দেহের বাইরে ছিল প্রথম থেকেই। তাদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। যে সন্দেহ প্রথম থেকে করা হচ্ছিল সেটাই প্রমাণিত হলো। জেরার মুখে তারা হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। তারা বলেছে এ ঘটনার মাস্টারমাইন্ড কেয়ারটেকার সোহেল। এরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।

পিবিআই টিমের কাছে জেরার মুখে স্বপন বলেন, তার পেশা ছিল ‘তিন মিনিটে চুরি’ করা। তার একমাত্র ছেলের মৃত্যুর পর এ পেশা ছেড়ে দেন। এখন অন্য ব্যবসা করেন। যেহেতু তিনি আগে চুরি করতেন, সেহেতু কেউ ডাকলে তাকে যেতে হয়। এবার তাকে ডেকেছেন পাড়ার মাস্তান খান্ডে বাবু ওরফে সোহেল মাহমুদ। গিয়ে দেখেন খান্ডে বাবুর সঙ্গে আছেন স্বপন মিয়ার পূর্বপরিচিত আরও তিনজনসহ সোনাইমুরীর সোহেল।

স্বপন মিয়া পুলিশের জেরায় বলতে থাকেন বাড়ির ভাড়া তুলতে তুলতে তার ইচ্ছা বড় হতে থাকে। তার ইচ্ছা ছিল খালাম্মা মনোয়ারা বেগমের মেয়েকে বিয়ে করবেন। এ কারণে খালাম্মাকে তিনি খুব ভালোবাসেন। সোহেল পরে বুঝতে পারেন মার্কিন দেশে জন্ম ও বসবাসকারী খালাম্মার মেয়ে তাকে কখনো বিয়ে করবেন না। খালাম্মাও তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেবেন না। সুতরাং খালাম্মাকে ভালোবাসাটা বৃথাই। তাই তার লোভ জন্মে বাড়ির ওপর। মনোয়ারা বেগমকে হত্যা করতে পারলেই অন্তত বাড়ির মালিক বনে যেতে পারবেন তিনি। কেয়ারটেকার সোহেল খান্ডে বাবু ওরফে সোহেল মাহমুদের সঙ্গে চুক্তি করেন পাঁচ লাখ টাকার। খান্ডে বাবু আবার তাদের ভাড়া করে খুন করতেন। নগদ ২ লাখ টাকা দেন এবং কীভাবে খুন হবে তার ছক দেন। কথা ছিল, বাকি টাকা হত্যাকান্ডের পর দেওয়া হবে। সেই টাকা সোহেল তাদের আর দেননি। 

যে ইচ্ছা পূরণে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মনোয়ারা বেগমকে হত্যা করেছিলেন সোহেল, সেই ইচ্ছা পূরণ দূরের কথা তার জায়গা এখন কারাগার। অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে চূড়ান্ত বিচারের জন্য। এ ঘটনায় জড়িত কেয়ারটেকার সোহেল, ভাড়াটে খুনি স্বপন আর আরিফ রয়েছেন কারাগারে। অপর খুনি সোহেল মাহমুদ পলাতক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর