করোনার ধাক্কা যদি আরেক প্রান্তিক অব্যাহত থাকে, তাহলে এ দেশের ছোট-বড় শিল্পমালিকরা বিপাকে পড়তে পারেন বলে মনে করেন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম। তিনি করোনার ধাক্কা সামাল দিতে সরকারকে দেওয়া বাজেট প্রস্তাবে বলেছেন, বড় শিল্পমালিকদের ছাড় করা প্রণোদনার টাকার ৫ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত অনুদান হিসেবে রূপান্তর করা উচিত। এ ছাড়া কৃষি খাতে যেসব প্রতিষ্ঠান প্রণোদনার অর্থ পেয়েছে, তাদেরও ৫০ শতাংশ অনুদান হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার দাবি করেছে এফবিসিসিআই।
গতকাল অনলাইনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর এবং বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআই আয়োজিত বাজেট পরামর্শক কমিটির ৪১তম সভায় এ প্রস্তাব দেন শেখ ফজলে ফাহিম। সভার প্রধান অতিথি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সারা দেশের বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য শুনে বলেন, ব্যবসায়ীদের দাবিগুলো যৌক্তিক। তাদের দাবিগুলো বিবেচনা করা হবে। জাতীয় বাজেটে ব্যবসায়ীদের দাবি-দাওয়া বা চাওয়া যুক্তিসংগত, অযৌক্তিক কোনো চাওয়া থাকে না। তারা দেশের নিবিড় অর্থনীতির চালিকাশক্তি। ব্যবসায়ীদের সুযোগ বাড়িয়ে দিলে দেশ উন্নত হয়। আমি বাজেট কাঠামো ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করব। হয়তো পূর্ণ মাত্রায় পারব না। অর্থমন্ত্রী বলেন, আমি মনে করি ব্যবসায়ীদের সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়ানো দরকার। ব্যবসায়ীদের সুযোগ দিলে একদিকে রাজস্ব আয় বাড়বে, অন্যদিকে কর্মসংস্থান বাড়বে। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, আপনারা যদি দেশকে উজাড় করে দেন, তাহলে ঠকবেন না। আপনাদের নিজের যেমন আয় বাড়বে, তেমনি দেশে কর্মসংস্থান তৈরি হবে। বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া এই দেশকে ২০৩০ সালের মধ্যেই আমরা ভালো অবস্থানে নিয়ে যেতে চাই। এর আগে এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন এমপি বলেন- নদী খনন অগ্রাধিকার খাত হওয়ায় ড্রেজিং আমদানিতে করহার যৌক্তিক করা হোক। এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, একটি ব্যবসাবান্ধব কর প্রশাসন গড়ে তুলতে চাই। কর ফাঁকি সংকোচন করতে চাই। করজাল বাড়ালে করহার কমানোর সুযোগ হবে। আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসাব পেলে আগামীতে করপোরেট করহার কমানো যাবে। এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম সারা দেশের ব্যবসায়ীদের সমম্বিত বাজেট প্রস্তাবনা তুলে ধরে বলেন, ব্যাংকের খরচ কমানো উচিত। আগামী দুই বছরের মধ্যে আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম আয়কর ও আগাম ভ্যাট প্রত্যাহার করা হোক। এক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি- করোনার সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য কমে গেছে। আবার সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ সময়ে অগ্রিম আয়কর ও আগাম ভ্যাট প্রত্যাহার করা হলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নগদ টাকার প্রবাহ বাড়বে। এ ছাড়া স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করপোরেট কর কমানোর সুপারিশ করেন তিনি। এফবিসিসিআইর সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, এনবিআর থেকে পলিসি শাখা পৃথক করা উচিত। রিসাইক্লিং শিল্পে কর সহায়তা প্রয়োজন। নদী শাসন ও খননে ড্রেজিং ৩১ শতাংশ কর আরোপের প্রয়োজন নেই। সব রপ্তানিতে উৎসে কর দশমিক ২ শতাংশ রাখা উচিত।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, পোশাকশিল্পে ভ্যাটের মওকুফ ও রিটার্ন দাখিল প্রক্রিয়া বাতিল করা হোক। আগামী পাঁচ বছর উৎসে কর দশমিক ২৫ শতাংশ করা হোক। এ ছাড়া পোশাক রপ্তানিতে নগদ সহায়তার ওপর উৎসে কর ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশন-বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ককর কমানো উচিত। দেশীয় শিল্প বাঁচাতে সব ধরনের সুতার ওপর অগ্রিম আয়কর কমানো উচিত। চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুব আলম বলেন, অগ্রিম আয়কর কমানো প্রয়োজন।
ফরেন ইনভেস্টর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-ফিকি সভাপতি রূপালী চৌধুরী বলেন, বিনিয়োগ বাড়ানোর চিন্তা করতে হবে। খুচরা ব্যবসায়ীদের বাঁচানোর চিন্তা করতে হবে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস-বেসিস সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, প্রতিবছর কর অব্যাহতির সনদ তোলা খুবই ঝামেলা, এটা তিন বছর মেয়াদি করা হোক। আইটি কোম্পানিগুলোর জন্য ৫০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হোক। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ই-ক্যাব সভাপতি শমী কায়সার বলেন, ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের অধিকাংশই এসএমই। তাদের ডিজিটাল পেমেন্টের ক্ষেত্রে ভ্যাট ও করমুক্ত সুবিধা চাই। প্রাণ আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী বলেন, মুড়িতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট মওকুফ করা হোক।
ওই বাজেট পরামর্শক কমিটির সভায় আরও বক্তব্য দেন এফবিসিসিআইর সিনিয়র সহ-সভাপতি মুনতাকিম আশরাফ, সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারাস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আলমগীর কবির, ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পমালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রাজ্জাক, ফার্নিচার শিল্পমালিক সমিতির সভাপতি সেলিম এইচ রহমান, রাজশাহী চেম্বারের সভাপতি মনির হোসেন, খুলনা চেম্বারের সভাপতি কাজী আমিনুল হক প্রমুখ।