বৃহস্পতিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

তালেবান সরকারে মতবিরোধ তুঙ্গে বারাদারসহ কয়েক নেতা নিখোঁজ

কান্দাহারে হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভ

প্রতিদিন ডেস্ক

আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখলকারী তালেবানের মধ্যে অন্তর্বিরোধ বেড়েই চলেছে। এ বিরোধ শীর্ষ পর্যায়েও দেখা দিয়েছে। এমনকি প্রেসিডেন্ট প্রাসাদেও তুমুল বাগ্বিতন্ডার খবর পাওয়া গেছে। জানা গেছে, এর পর থেকেই তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মুহাম্মদ ওমরের জামাই মোল্লা আবদুল গনি বারাদার, শীর্ষ নেতা মোল্লা আখুন্দজাদাসহ বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এরই মধ্যে আবদুল গনি বারাদার নিহত হয়েছেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে, তবে তালেবান এ খবর মিথ্যা দাবি করেছে। সূত্র : বিবিসি, রয়টার্স, আলজাজিরা। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী চলে যাওয়ার পর ১৫ আগস্ট তালেবান বিনা যুদ্ধে ক্ষমতা দখল করে। এরপর সরকার গঠনে জোর চেষ্টা চালালেও নিজেদের মধ্যে বিরোধে তা বিলম্বিত হতে থাকে। এ অবস্থায় তিন সপ্তাহ পর একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ঘোষণা দেওয়া হলেও এ পর্যন্ত শপথ গ্রহণ করতে পারেনি। এরই মধ্যে প্রকাশ্যে এসেছে তালেবান সরকারে মতবিরোধ তুঙ্গে ওঠার কথা। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী মূলত নতুন সরকারের পদপদবি নিয়ে তালেবানের সহপ্রতিষ্ঠাতা মোল্লা আবদুল গানি বারাদার ও মন্ত্রিসভার এক সদস্যের মধ্যে তুমুল বাগ্বিতন্ডা হয়। এ খবর গোপন করার চেষ্টা হলেও তালেবানের এক সূত্র জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট প্যালেসে বারাদারের সঙ্গে হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রভাবশালী নেতা খলিলুর রহমান হাক্কানির বাগ্বিতন্ডা হয়। খলিল তালেবান সরকারের শরণার্থীবিষয়ক মন্ত্রী। কাতারে অবস্থানরত তালেবানের এক জ্যেষ্ঠ নেতা জানিয়েছেন, গত সপ্তায় এ ঘটনা ঘটে। তালেবানের বিভিন্ন সূত্র বলছেন, দ্ব›েদ্বর অন্যতম কারণ সরকারের কাঠামো নিয়ে বারাদার অসন্তুষ্ট। এ ছাড়া তালেবানের আবার ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার পেছনে কার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি তা নিয়েও বিতর্ক দেখা দিয়েছে। বারাদার মনে করেন তার মতো ব্যক্তিরা, যারা কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছিলেন তাদের কারণেই তালেবানের ‘জয়’ হয়েছে। অন্যদিকে হাক্কানি নেটওয়ার্কের সদস্যরা মনে করেন যুদ্ধ ক্ষেত্রে লড়াইয়ের মাধ্যমে তালেবানের জয় নিশ্চিত হয়।

তালেবানের এক কর্মকর্তা বিবিসি পশতুকে বলেছেন, মোল্লা বারাদার ও খলিলুর রহমান হাক্কানির মধ্যে তীব্র বাদানুবাদ হয়েছে। ওই সময় কাছেই তাদের সমর্থকদের মধ্যেও ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। একপর্যায়ে মোল্লা বারাদার প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যান। এ ঘটনার পরপরই বারাদারকে হত্যা করা হয়েছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। বলা হয়, তিনি কান্দাহারে যাওয়ার পর দুর্ধর্ষ হাক্কানি গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন। তবে তালেবানের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে বারাদার নিহত হওয়ার খবর স্রেফ গুজব। তিনি জীবিত এবং সুস্থ আছেন। তার পরও সন্দেহ দূর হয়নি। কারণ এর আগে মোল্লা ওমর নিহত হওয়ার খবরও দুই বছরের বেশি সময় গোপন রেখেছিল তালেবান।

তিনি নিহত হলেও পুরো সময় তারা ওমরের নাম ব্যবহার করে একের পর এক মিথ্যা বিবৃতি প্রকাশ করেছে।

এ অবস্থায় মোল্লা বারাদার আসলে কোথায়, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেই চলেছে। বিশেষ করে ১০ দিন ধরে তার কোনো খোঁজ নেই।

গোয়েন্দাদের তথ্যানুযায়ী কোনো কোনো সূত্র বলছেন, হাক্কানি গোষ্ঠীর সঙ্গে বারাদার শিবিরের সংঘর্ষের সময় গুরুতর জখম হন বারাদার। এরপর বেঁচে আছেন না মারা গেছেন তা নিশ্চিত নয়। বিশেষ করে বেঁচে থাকলে তিনি দেখা দিতে পারতেন, কিন্তু তা দিচ্ছেন না। এতে মৃত্যুর গুজব ডালপালা মেলেছে। তবে আফগানিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলের কাছে আসা রিপোর্ট অনুযায়ী বারাদারের মৃত্যু হয়েছে। যদিও তালেবান সোমবার বারাদারের নামে একটি অডিও প্রকাশ করেছে। তাতে তিনি বেঁচে আছেন বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, বেঁচে থাকলে ভিডিওর বদলে অডিও কেন? তিনি কেন নিজেই প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন না? তার কোনো ভিডিওবার্তাও কেন প্রকাশ করা হচ্ছে না? অন্য এক সূত্র জানান, দোহায় আমেরিকা ও অন্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আলোচনায় থাকা তালেবান গোষ্ঠীর সঙ্গে যখন আলোচনা চলছে তখন পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা এমন কিছু তৎপরতা চালাচ্ছে যে কারণে ১০ দিন ধরে তালেবান সরকার নিয়ে ঠান্ডা যুদ্ধ চলছে। বিশেষ করে পাকিস্তানপন্থি আর পাকিস্তানবিরোধী অংশের মধ্যে দ্ধন্ধ চরম আকার নিয়েছে।

এদিকে বারাদারের মতো শীর্ষ নেতা মোল্লা আখুন্দজাদাকেও প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না। তালেবানের রাজনৈতিক, সামরিক ও ধর্মীয় বিষয়ক এই সর্বোচ্চ নেতাকে নিয়েও বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়ছে। আরও কয়েকজন নেতারও নিখোঁজ সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। সব মিলিয়ে তালেবানের ভিতরে বিরোধ বড় আকার ধারণ করে চলেছে, যা সংঘাতে রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।

কান্দাহারে তালেবানবিরোধী বিক্ষোভ : আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর কান্দাহারে তালেবানবিরোধী বিক্ষোভ করেছেন হাজার হাজার বাসিন্দা। বিক্ষোভকারীরা বলছেন, তালেবান তিন দিনের মধ্যে বাড়ি ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে। আর তারই প্রতিবাদে মঙ্গলবার বিক্ষোভ করেন বাসিন্দারা।

জানা গেছে, সরকারি মালিকানাধীন একটি আবাসিক এলাকা থেকে বাসিন্দাদের সরে যেতে তিন দিন সময় বেঁধে দেন তালেবান কর্তৃপক্ষ। এরই প্রতিবাদে কান্দাহারের গভর্নর কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন সাড়ে ৩ হাজার বাসিন্দা। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া এক নারী মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএনকে বলেন, ‘আমার অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। সাম্প্রতিক সংঘাতে পরিবারের বহু সদস্য হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছি আমি।’ তিনি আরও জানান, ওই আবাসিক এলাকায় বসবাসরত সবাই নিজেদের শেষ সম্পদ ব্যয় করে বাড়ি বানিয়ে নিয়েছেন। এখন অন্য কোথাও যাওয়ার উপায় তাদের নেই। স্থানীয় টেলিভিশনে প্রচারিত ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, বিক্ষোভকারীরা একটি সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন। কান্দাহারের অ্যাকটিভিস্ট মুহাম্মদ ইবরাহিম জানিয়েছেন, ফেরকাহ-ই কোহনা আবাসিক এলাকাটি প্রাদেশিক রাজধানীর এক প্রান্তে অবস্থিত। সরকারি মালিকানাধীন জায়গাটি সরকারি কর্মীদের মধ্যে বিতরণ করে দেয় আগের সরকার। তবে বণ্টনের সময় দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে সরকারি কর্মী ছাড়াও অন্যরা জমি বরাদ্দ নিতে সক্ষম হন। কোনো কোনো বাসিন্দা ২০ বছরের বেশি সময় ধরে সেখানে বসবাস করছেন। বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়ার বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করেননি তালেবান মুখপাত্র।

অর্থনৈতিক সংকট চোখ রাঙাচ্ছে তালেবানকে : কাবুল দখলের এক মাস পর দ্রুতগতিতে অর্জিত তাদের সামরিক সাফল্যকে দীর্ঘস্থায়ী একটি শান্তিকালীন সরকারে রূপান্তর করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে তালেবানকে। খরা ও দুর্ভিক্ষ দেশটির হাজার হাজার মানুষকে শহরে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির আশঙ্কা, চলতি মাসের শেষ দিকে মজুদ খাদ্য ফুরিয়ে যেতে পারে। তেমনটা হলে ১ কোটি ৪০ লাখ আফগান অনাহারের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যেতে পারে বলেও অনুমান তাদের। নতুন তালেবান সরকার নারী অধিকার সুরক্ষিত রাখার প্রতিশ্রতি পূরণ করছে কি না বা আল-কায়েদার মতো জঙ্গিগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিচ্ছে কি না পশ্চিমা দেশগুলো এসব দিকে বেশি মনোযোগ দিলেও বেশির ভাগ আফগানের কাছে এখন কোনোমতে টিকে থাকাই প্রধান অগ্রাধিকার।

কাবুলের বাসিন্দা আবদুল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, সব নারী, পুরুষ, শিশু ক্ষুধার্ত। তাদের কাছে এক ব্যাগ ময়দা বা রান্নার তেলও নেই। ব্যাংকগুলোর বাইরে এখনো অপেক্ষমাণের দীর্ঘ সারি, কাউন্টার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলে এক সপ্তার জন্য তুলতে পারছেন সর্বোচ্চ ২০০ ডলার বা ২০ হাজার আফগানি, ক্ষীণ হতে থাকা রিজার্ভের সুরক্ষায় এ সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। কাবুলজুড়ে এখন অসংখ্য ছোটখাট অস্থায়ী বাজার, যেখানে মানুষজন অর্থের জন্য ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করতে নেমেছেন, যদিও ক্রেতার সংখ্যা সীমিত। বিভিন্ন সূত্রের তথ্যানুযায়ী শত শত কোটি ডলারের বিদেশি সাহায্যের পরও আফগানিস্তানের অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরেই ধুঁকছিল; জনসংখ্যার ক্রমাগত বৃদ্ধির সঙ্গে প্রবৃদ্ধি তাল মেলাতে ব্যর্থ হয়। চাকরি দুষ্প্রাপ্য। সরকারি কর্মীদের অনেকে জুলাই থেকে বেতনও পাননি। ফলে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে এসে পড়েছে দেশটির জনগণ।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর