শনিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

থানায় গিয়ে মামুন বললো যুদ্ধ করব পুলিশের সাথে

মির্জা মেহেদী তমাল

থানায় গিয়ে মামুন বললো যুদ্ধ করব পুলিশের সাথে

কালো কাপড়ে ছেলেটির চোখ বাঁধা। পরনে কালো প্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি। হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসা। বয়স ২০-২২ বছর। তার উল্টো দিকে আট থেকে ১০ জন যুবক। প্রত্যেকেই মাটিতে বসা। তাদের একজন পিস্তলে গুলি লোড করছে। চোখ বাঁধা ছেলেটি অনুনয়-বিনয় করছে। বলছে, ‘আমারে জানে মাইরেন না ভাই।’ পিস্তল হাতের যুবকটি এবার দাঁড়ালেন। বললেন, ‘ঠিক আছে, তুই যেমনে কবি ওমনিই হইব। এইবার ক তোর শরীরের কোন দিকে গুলি করলে কষ্ট কম পাবি। মনে কর এইটাই তোর জীবনের শেষ ইচ্ছা।’ এ কথা শুনেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে ছেলেটি। পা ধরে, মাফ চায়, কসম কাটে, কত কী! কিন্তু পিস্তল হাতের যুবকটির এক কথা- ‘কোথায় গুলি করলে কষ্ট কম হবে।’ বারবার একই প্রশ্ন তার। এক সময় চোখ বাঁধা ছেলেটির পায়ে পিস্তল ঠেকিয়ে বলে, ‘ঠিক আছে, তরে পায়ে গুলি করি।’ এ কথা বলেই ট্রিগারে চাপ দেয়। গুলি পায়ের এক দিক দিয়ে ঢুকে আর এক দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। ‘বাবাগো’ বলে চিৎকার করে ছেলেটি। সহযোগীরা ছেলেটিকে জাপটে ধরে রাখে। মুখের ভিতর গুঁজে দেয় কাপড়। এবার বুকে, হাতে এবং শেষে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি চালায়। গগনবিদারী চিৎকার হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। ছেলেটিকে সবাই ছেড়ে দেয়। অল্প কিছু সময়ের জন্য ছেলেটির শরীরে ঝাঁকি হয়। গোঙানির শব্দ। এর পর কোনো সাড়া নেই। চারদিকে নিস্তব্ধতা। পিস্তল হাতের যুবক সহযোগীদের নির্দেশ দেন, ‘যা, লাশটা মাটিতে পুঁইতা রাখবি।’

ঢাকার আমিনবাজারের তুরাগ নদের  পাড়ে এভাবেই একের পর এক খুন করেছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন। যিনি বর্দির (বরদেশী গ্রামের ছোট নাম) মামুন নামেই পরিচিত। তার পুরো নাম খন্দকার মামুন। কথা বলতে বলতে মানুষ খুন করা ছিল তার নেশার মতো। তবে খুনের আগে জীবনের শেষ ইচ্ছা জেনে নিতেন মামুন। মামুনের কাছে শেষ ইচ্ছা বলতে শরীরের কোথায় গুলি করা হবে তা জেনে নেওয়া। এভাবেই শেষ ইচ্ছা জেনে নিয়ে খুন করতেন কাছ থেকে ধীরে সুস্থে।

মামুন এতটাই ভয়ংকর ছিলেন যে আমিনবাজারে তার নাম মনে করলে এখনো মানুষ আঁতকে ওঠে। এই মামুন একসময় খুন হওয়ার পর আমিনবাজারের মানুষ যেন প্রাণ ফিরে পায়। ওই সময় সিরিজ গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। একসঙ্গে তিনজন, দুজন গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। অতিষ্ঠ মানুষ মামুন খুনের পর তার সহযোগীদের যেখানে পেয়েছে সেখানেই গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করেছে। মামুনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল এমন এক সূত্র জানান, ‘হ্যাংলা পাতলা গড়নের মামুনের ভীষণ সাহস ছিল। সব সময় অস্ত্র বহন করতেন। ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতেন।’

১৯৮৮ সাল থেকেই রাজধানীর সবচেয়ে বড় মাদকের আখড়া ছিল আমিনবাজার। রাজধানীর উপকণ্ঠ আমিনবাজারের এ জায়গাতেই ভিড়ত ফেনসিডিলের চালান। যার পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করতেন বর্দির মামুন। আর এ মাদকের ডিপো নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য খুনখারাবি থেকে শুরু করে সব ধরনের অপরাধই করেছেন মামুন। মামুন বাহিনীতে শুধু ওই এলাকার অপরাধীরাই নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকার দুর্ধর্ষ অপরাধীদের নিয়ে এসেছিলেন মামুন। পুলিশও মামুনের আখড়ায় হানা দিতে একসময় ভয় করত। যে কারণে মামুন চলাফেরা করতেন বুক চিতিয়ে।

মাদক ব্যবসায় অঢেল সম্পদের মালিক বনে যান মামুন। অস্ত্রের ভান্ডার গড়ে তোলেন আমিনবাজারে। রাজধানীর দুর্ধর্ষ অপরাধীদের নিয়ে গড়ে তোলেন তার নিজস্ব বাহিনী। যারা আমিনবাজার থেকে শুরু করে শ্যামপুর পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়াত। আমিনবাজারের বরদেশী গ্রামের ভিতর দিয়ে বয়ে চলা তুরাগ নদের তীর ছিল তার খুন করার জায়গা। মাদকের ব্যবসায় যারা প্রতিবাদ করত বা নতুন করে মাদক ব্যবসা শুরু করত তাদেরই ধরে নিয়ে যাওয়া হতো নদের তীরে। যেখানে সন্ধ্যার পর মানুষ চলাচল করে না। সেখানেই বসত তার খুনের আসর। তার প্রতিপক্ষ গুলজারকে হাত-পা বেঁধে নদে ফেলে দিয়েছিলেন। সাভার থানার ওয়ারেন্টের আসামি ছিলেন মামুন। কিন্তু মামুন এতটাই দুর্ধর্ষ ছিলেন যে পুলিশকে থোড়াই কেয়ার করতেন। এতটাই দুর্ধর্ষ ছিলেন যে অস্ত্রহাতে সাভার থানায় গিয়ে পুলিশ সদস্যদের হত্যার হুমকিও দিয়েছেন। এক মধ্যরাতে সাভার থানায় হাজির হন মামুন। ডিউটি অফিসারের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমার নাম মামুন। আমারে দেখামাত্রই নাকি গুলি করার অর্ডার আছে। কই গুলি করেন এখন আপনারা। আজ থানার সঙ্গে আমার যুদ্ধ হবে।’ পুলিশ বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়নি। ডিউটি অফিসার মামুনকে চিনতে না পারায় তাকে গ্রেফতারও করতে পারছিলেন না। একজন কনস্টেবল তাকে চিনে ফেলেন। তিনি ডিউটি অফিসারকে বলার আগেই মামুন তার লোকজন নিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে যান। পুলিশের দল তাকে ধরতে গাড়ি নিয়ে বের হলেও সে রাতে তার খোঁজ পায়নি।

১৯৯০ সালের দিকে মামুনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাধে বিকাশ আর প্রকাশের। সমঝোতার কথা বলে মিরপুরে মামুনকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই কাটা রাইফেল ঠেকিয়ে মামুনকে হত্যার জন্য গুলি চালান প্রকাশ। গুলিবিদ্ধ মামুনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সংবাদ পেয়ে পুলিশ হাসপাতালে যায় মামুনকে গ্রেফতারের জন্য। এ খবর মামুনের কাছে পৌঁছে যায়। হাসপাতাল থেকেই ট্রলিসহ তার সহযোগীরা বের করে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান মামুনকে। এরপর তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু শরীরে রয়ে যায় বুলেটের কিছু অংশ। যা আর বের করতে পারেননি চিকিৎসকরা। শরীরে একাধিক বুলেট নিয়েই পালিয়ে বেড়াতেন মামুন।

রাজধানীর শীর্ষ সন্ত্রাসী আসলাম, সুব্রত বাইন, পিয়ালসহ আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব^ শুরু হয়। রাজধানীর এই শীর্ষ সন্ত্রাসীরা এক জোট হয়ে মামুনকে হত্যার পরিকল্পনা আঁটে। ১৯৯৬ সালে মিরপুরে মোল্লা মাসুদ গুলি করে হত্যা করেন মামুনকে। ঈদের আগে স্ত্রীকে নিয়ে শপিং করে রিকশায় ফিরছিলেন মামুন। কিন্তু আগে থেকে ওত পেতে থাকা মোল্লা মাসুদের বাহিনী তাকে গুলি চালায়। মামুন গুলি চালালেও তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। মামুন নিহত হন।

সর্বশেষ খবর