মঙ্গলবার, ২১ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

পি কে হালদারকে ফিরিয়ে আনা ঝুলে যাচ্ছে!

সাখাওয়াত কাওসার

পি কে হালদারকে ফিরিয়ে আনা ঝুলে যাচ্ছে!

মাস পেরিয়ে গেলেও আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের রেড নোটিসে নাম থাকা প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার ইস্যুতে ঢাকার চিঠিতে সাড়া দেয়নি নয়াদিল্লি। ১৪ মে ভারতে গ্রেফতার হওয়া বহুল আলোচিত পি কে হালদার ইস্যুতে বাংলাদেশ পুলিশের এনসিবি শাখা থেকে দিল্লি পুলিশের এনসিবি শাখায় চিঠি পাঠানো হয়। তবে ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে কোনো জবাব না আসায় পি কে হালদারকে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি ঝুলে যেতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ভারতে পি কে হালদারের বিচার শেষ হতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। এ বিষয়ে গতকাল সন্ধ্যায় কথা হয় পুলিশের এনসিবি (ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো) শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক (বর্তমানে অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মহিউল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পি কে হালদার গ্রেফতারের পরপরই আমরা দিল্লি এনসিবিকে একটা চিঠি দিয়েছিলাম। এর কোনো উত্তর আসেনি। এরপর আন্তমন্ত্রণালয়ের একটি বৈঠকেও আমার উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। এখন বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেখভাল করছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্দিবিনিময় চুক্তি রয়েছে। কূটনৈতিক চ্যানেল ব্যবহার করেই তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।’ পুলিশ সদর দফতর সূত্র বলছে, গত বছর ৫ জানুয়ারি বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচারের অভিযোগে বিদেশে থাকা পি কে হালদারের বিরুদ্ধে রেড অ্যালার্ট জারির জন্য ইন্টারপোলে নোটিস পাঠানো হয়। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্টস ও সাপোর্টিং এলি মেন্টসসহকারে পাঠানো সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে ৮ জানুয়ারি পি কে হালদারের বিরুদ্ধে রেড নোটিস জারি করে ইন্টারপোল। ইন্টারপোলের কেন্দ্রীয় ওয়েবসাইটে প্রকাশের পাশাপাশি সারা বিশ্বে বিভিন্ন দেশে ইন্টারপোলের শাখাসমূহেও ওই নোটিসটি পাঠানো হয়। জানা গেছে, ১৩ ও ১৪ মে টানা দুই দিনের অভিযানে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনার অশোকনগরে পি কে হালদার, তার দুই ভাই প্রীতীশ ও প্রাণেশ হালদারসহ অন্যতম প্রধান সহযোগী সুকুমার মৃধার বাড়িতে অভিযান চালায় ইডি। ১৪ মে পি কে হালদার, প্রীতীশ, উত্তম মিত্র, স্বপন মিত্র ও সুকুমার মৃধার জামাতা সঞ্জীব হাওলাদারকে গ্রেফতারের পর প্রথম দফায় তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে তাদের কলকাতার অর্থঋণ আদালতে দ্বিতীয় দফায় সোপর্দ করে আবারও কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ভারতের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিরেক্টরেট অব এনফোর্সমেন্ট (ইডি)। পি কে হালদারসহ ভারতে গ্রেফতার হওয়া পাঁচজনই বিভিন্ন নামে ওই দেশের আধার কার্ড, ভোটার কার্ডসহ জাল-জালিয়াতি করে নাগরিকত্বের কাগজপত্র তৈরি করে বসবাস করে আসছিলেন। প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার ভারতে গিয়ে হন শিবশঙ্কর হালদার, উত্তম কুমার মিস্ত্রি হন উত্তম মিত্র, স্বপন কুমার মিস্ত্রি হন স্বপন মিত্র। নতুন নামে তারা জালিয়াতি করে নাগরিকত্বের কাগজপত্র তৈরি করেছিলেন। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই ইডি অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে। ভারতে তার নামে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার সম্পদ খুঁজে পেয়েছে দেশটির আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা ইডি।

এ ছাড়া মালয়েশিয়াতেও তার বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। ১৯ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে দুদকের প্রতিনিধি, বিএফআইইউ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে পি কে হালদারকে কীভাবে দ্রুততম সময়ে দেশে ফিরিয়ে আনা যেতে পারে সে বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি প্রয়োজনে একটি যৌথ প্রতিনিধি দল ভারতে গিয়ে পি কে হালদারকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে বলেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে ওই বৈঠকের এক মাস পেরিয়ে গেলেও এ নিয়ে আর কোনো অগ্রগতি নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক সাঈদ মাহবুব খান বলেন, ‘দেখুন, পি কে হালদারকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করছে। আপাতত বলার মতো কোনো আপডেট নেই। একটি টিম ভারতে গিয়ে পি কের সম্পত্তির বিষয়ে সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে শিগগিরই হয়তো যাওয়া হচ্ছে না। এর আগে আমরা প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করছি।’ দুদকের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, শুরুতে খুব আগ্রহ দেখালেও ভারতে পি কের বিরুদ্ধে একাধিক মামলার কারণে বিষয়টি ঝুলে গেছে। বোঝাই যাচ্ছে ভারতে মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে ফিরিয়ে আনা খুব সহজ নয়। দুদক সূত্র জানায়, পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে দদুক মোট ৩৫টি মামলা দায়ের করেছে। এর মধ্যে একটি মামলায় আদালতে চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছে। ওই মামলার চার্জশিটে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। ২০১৯ সালে শেষের দিকে পি কে হালদারের অর্থ লোপাটের বিষয়টি আলোচনায় আসার পর ওই বছরেরই ২৩ অক্টোবর দুদকের পক্ষ থেকে তার বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তবে এর আগেই তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এর পর থেকে দুদকের অনুসন্ধানে একের পর এক তার অর্থ কেলেঙ্কারীর তথ্য-উপাত্ত বেরিয়ে আসে। এসব অর্থ তিনি তার নিয়ন্ত্রণাধীন চারটি প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও পিপলস লিজিং থেকে কাগুজে প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ঋণের নামে হাতিয়ে নিয়েছেন। সবগুলো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই তার আত্মীয়স্বজন ও সহযোগী-সহকর্মীদের ব্যবহার করেছেন। আমাদের কলকতা প্রতিনিধি জানান, ১৪ দিনের জেল হেফাজতের (জুডিশিয়াল কাস্টডি) মেয়াদ শেষে আজ ফের আদালতে তোলা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে গ্রেফতার হওয়া বাংলাদেশভিত্তিক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাঙ্কের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পি কে হালদারকে। তার সঙ্গে আদালতে তোলা হবে এ মামলায় মূল অভিযুক্ত পি কের সহযোগী তার ভাই প্রাণেশ কুমার হালদার, ইমাম হোসেন ওরফে ইমন হালদার, স্বপন মৈত্র ওরফে স্বপন মিস্ত্রি, উত্তম মৈত্র, আমানা সুলতানা ওরফে শর্মী হালদারসহ বাকি পাঁচ অভিযুক্তকে। এদিন বেলার প্রথম অর্ধেই তাদের কলকাতার নগর দায়রা আদালতের বিশেষ সিবিআই আদালতে তোলা হবে। সে ক্ষেত্রে আদালতের কাছে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ফের ১৪ দিনের জন্য জেল হেফাজতের আবেদন জানাবে ভারতের তদন্ত সংস্থা ইডি। গতকাল এ কথা জানান ইডির আইনজীবী অরিজিৎ চক্রবর্তী।

সর্বশেষ খবর