রবিবার, ৩ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

ফেরিঘাটে সুনসান নীরবতা

নেই গাড়ি নেই ভিড়, গোটানো হচ্ছে দোকানপাট

প্রতিদিন ডেস্ক

ফেরিঘাটে সুনসান নীরবতা

পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর পাল্টে গেছে ফেরিঘাটের চিত্র। এখন আর কোনো ঘাটেই পারাপারের জন্য যানবাহনের চাপ নেই। এমনকি লোকজনেরও ভিড় নেই। ফলে মাথায় হাত পড়েছে ঘাটসংলগ্ন দোকান ব্যবসায়ীদের। বেচা-বিক্রি না থাকায় তাদের অনেকেই দোকানপাট, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান গুটিয়ে নেওয়া শুরু করেছেন।

আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর অনুযায়ী, ঘাটপাড়ে এখন আর পারাপারের জন্য গাড়ি বা যানবাহনের কোনো অপেক্ষা নেই। তার বদলে ফেরিগুলোই যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করছে। এ চিত্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার প্রবেশদ্বার হিসেবে খ্যাত সবকটি ফেরিঘাটের। মাদারীপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় মাদারীপুরের শিবচরের বাংলাবাজার ফেরিঘাট এখন যাত্রীশূন্য হয়ে পড়েছে। ঘাটসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে তিন দশক ধরে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কাছে যাতায়াতের সবচেয়ে জনপ্রিয় বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌপথটি অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। নৌপথকে ঘিরে লঞ্চ ও স্পিডবোটসহ ঘাটের কয়েক হাজার শ্রমিক ও ব্যবসায়ী বেকার হয়ে পড়েছেন।

গতকাল সকালে বাংলাবাজার লঞ্চঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, কোনো ভিড় নেই। নেই যাত্রীদের হইচই। দূর-দূরান্ত থেকে যাত্রীবাহী পরিবহন বাসগুলোও এসে থামছে না। ৩ নম্বর লঞ্চঘাটের গলিতে গিয়ে দেখা গেল, একটি খাবারের হোটেল ও একটি চায়ের দোকান খোলা রয়েছে। বাকি সব দোকান বন্ধ। একটু এগিয়ে লঞ্চঘাটের পন্টুনে গিয়ে দেখা গেল, ঘাটে সারি সারি করে বেঁধে রাখা হয়েছে প্রায় ৪০টি লঞ্চ। কারও চোখেমুখে কোনো ব্যস্ততার ছাপ নেই। মুখগুলো সবার মলিন, ধূসর। একটি লঞ্চে স্থানীয় কিছু লোকজনকে পদ্মা পাড়ি দিতে উঠতে দেখা গেল। শিবচরের মাদবরচরের বাসিন্দা বশির মাদবর। তিনি ঝালমুড়ি বিক্রি করতেন ঘাটে। বললেন, সেতু চালু হয়েছে। এখন এই ঘাটের তেমন গুরুত্ব নেই। মানুষ নেই, ঘাটের জৌলুসও নেই। এই নৌপথের হাজী শরীয়তউল্লাহ লঞ্চের মাস্টার হানিফ হাওলাদার বলেন, ‘সারা দিন এই রুটের বাংলাবাজার ঘাট থেকে মাত্র ৩-৪টি লঞ্চ  ছাড়ে। আগে ১৫ মিনিটেই একটি লঞ্চ যাত্রীতে ভরে যেত। আজ সেখানে দুই ঘণ্টায়ও ১০০ জন যাত্রী হয় না।’

এমভি শুভ অ্যান্ড রোদেলা লঞ্চের কর্মী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এখন বেকার হয়ে গেলাম। কীভাবে সংসার চালাব, কিস্তি চালাব-তা বুঝতে পারছি না।’

আরেকটি লঞ্চের চালক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এই নদীর সঙ্গে ৩০ বছর ধরে যুদ্ধ করে বেঁচে ছিলাম। এখন এই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। কিন্তু বেকার জীবন নিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকব- বুঝতে পারছি না। সরকারের কাছে আমাদের পুনর্বাসনের দাবি করছি।

এদিকে একই চিত্র স্পিডবোট ঘাটেও। সেখানেও নেই যাত্রী। আর ফেরিঘাট একেবারেই শূন্য। গত বছর পদ্মা সেতুর সঙ্গে ফেরির একাধিকবার ধাক্কা লাগে। এরপর থেকেই বাংলাবাজার ঘাট থেকে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফেরি চলাচলের নতুন ঘাট ঠিক করা হয় শরীয়তপুরের মাঝির ঘাট। কিন্তু সেখানেও যাত্রীর চাপ নেই। তবে গাড়ির বদলে কিছু মোটরসাইকেল পারাপার হচ্ছিল ফেরিতে।

বাংলাবাজার ঘাটের বিআইডব্লিউটিএর ট্রাফিক ইন্সপেক্টর আখতার হোসেন বলেন, ‘১৯৯৬ সাল থেকে শিবচরের এ ঘাটটি চালু হয়। এরপর থেকে টানা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষকে এ ঘাট দিয়ে সেবা দেওয়া হয়েছে। এখন পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এই ঘাটের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে আসছে। তাই এখন যাত্রীদের চাপ আর থাকবে না। প্রতিদিন এই রুটে ৮৭টি লঞ্চ, ১৭টি ফেরি ও দেড় শতাধিক স্পিডবোট চলাচল করত। সময়ের দাবি অনুযায়ী এখন সব নৌযানই সরিয়ে ফেলা হচ্ছে।’ বাংলাবাজার ঘাটের লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির বলেন, ‘আমরা নতুন নৌপথ পাওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছি। তারা আমাদের আশ্বাস দিয়েছে, কিন্তু এখনো কোনো পারমিশন পাইনি।’ এ বিষয়ে মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় কেউ কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। এই নৌপথের চালক শ্রমিকদের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে, যাতে তারা কেউ বেকার না থাকেন।’ শরীয়তপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, শরীয়তপুরের মাঝিকান্দি ঘাটটি পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের আগে থেকেই বন্ধ রয়েছে। ফলে আগের যে ব্যস্ত ফেরিঘাট ছিল, এখন তা নেই, রয়েছে কেবলই সুনসান নীরবতা। ব্যবসায়ীরা পড়েছেন বিপাকে। দোকান ভাড়াসহ কর্মচারীর বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। দেখা গেছে, মাঝিকান্দি ফেরিঘাটে সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। নেই গাড়ির কোনো শব্দ। তবে ফেরিঘাট দখল করে রেখেছে সিএনজি। ঘাটের মাঠে করা হয়েছে বাসস্ট্যান্ড। অনেকে দোকানই খোলেননি। আবার কেউ দোকান সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন অন্য কোথাও।

আনোয়ার হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, দুই দিন ধরে এই এলাকায় ফেরি আসে না। শুধু লঞ্চের যাত্রীদের ওপর ভিত্তি করে ব্যবসা করা যায় না। আগে যে পরিমাণ মানুষ লঞ্চে আসত এখন তাও আসে না। পদ্মা সেতু হওয়ার পর যাত্রীরা আসা-যাওয়া করছেন না।

আরেক ব্যবসায়ী হালিম মিয়া বলেন, এখানে আর ব্যবসা করা যাবে না। যেমন দোকান রয়েছে তেমন ক্রেতা নেই। এতে ফেরিঘাটে আর ব্যবসা করা যাবে না। পদ্মা সেতু হওয়াতে ফেরি বন্ধ হয়ে গেছে। এ এলাকায় আর যানবাহন আসবে না। তাই আমি এখান থেকে এ চলে যাচ্ছি।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের মাওয়া বন্দর কর্মকর্তা শাহাদাৎ হোসেন বলেন, এ নৌরুটে আর গাড়ি আসছে না। ২৭ জুন একটি ফেরি চালু রেখেছিলাম মোটরসাইকেল পারাপারের জন্য। এখন ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। গাড়ি থাকলে তবেই ফেরি চলাচল শুরু করব।

মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে এখন আর আগের মতো ভোগান্তি নেই। কয়েক মাইলজুড়ে আটকে থাকা যানবাহনের দীর্ঘ লাইনও নেই। ফেরিতে আগে ওঠার প্রতিযোগিতা চলত, এখন তা নেই। এ কারণে নেই অতিরিক্ত টাকা আদায়ের অভিযোগও। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যানবাহনের চাপও কমেছে। কোথাও যানজট হচ্ছে না। যানবাহনগুলো মহাসড়কসহ নৌপথ দিয়ে নির্বিঘ্নে পার হচ্ছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর পুরো শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে।

রাজবাড়ীর জাহাঙ্গীর ও দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের বাসা  ঢাকার মিরপুরে। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুট দিয়ে যাতায়াত করে থাকি। সারা জীবন ভোগান্তি নিয়ে আসা-যাওয়া করেছি, এখন সড়ক ও নৌপথে কোনো সমস্যা নেই।

ট্রাকচালক ইউসুফ আলী ও নান্নু মিয়া বলেন, ঘাট পার হতে কোনো সমস্যা নেই। আগে ঘাটে তিন চার দিন অপেক্ষা করতে হতো। এখন আর সমস্যা নেই। পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া  নৌরুটে স্বাচ্ছন্দ্যে পারাপার হচ্ছে যানবাহন। বিআইডব্লিউটিসি আরিচা অঞ্চলের ডিজিএম খালেদ নেওয়াজ জানান, গাড়ির সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে তবে ঘাটে কোনো গাড়ি আটকে থাকছে না। ঘাটে যানবাহন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফেরিতে পার হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বহরে ২০টি ফেরি যুক্ত রয়েছে।  রাজবাড়ী প্রতিনিধি জানান, পদ্মা সেতু চালুর প্রভাব পড়েছে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে। ফেরি পাড়ের জন্য যানবাহনের সংখ্যা কমে আসছে। এক সময় এই নৌরুট দিয়ে গড়ে ৭ হাজার যানবাহন পারাপার হয়েছে। বর্তমানে সেই সংখ্যা অর্ধেকেরও কম। যাত্রী ও যানবাহনের চাপ কম থাকায় এখন ফেরিগুলোই যানবাহনের অপেক্ষায় থাকছে। এ ছাড়া এক সময় দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের জিরো পয়েন্ট থেকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের রাজবাড়ী অংশে লেগেই থাকত যানজট। সেই মহাসড়কও এখন ফাঁকা, সুনসান।

বিআইডব্লিউটিসির দৌলতদিয়া ফেরিঘাট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ১৬টি ফেরি দিয়ে যাত্রী ও যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে। রোস্টার পদ্ধতিতে ফেরিগুলো চলাচল করছে।  পদ্মা সেতু চালুর পর সর্বশেষ পাঁচ দিনে যানবাহনের সংখ্যা কমেছে প্রায় ৮ হাজার। 

গতকাল দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এলাকায় দেখা গেছে, ফেরিঘাটের জিরো পয়েন্ট থেকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে যানবাহনের কোনো সিরিয়াল নেই। অনেক দোকানপাটই বন্ধ। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা যানবাহনগুলো সোজা ফেরিতে চলে যাচ্ছে। এগুলোর জন্যই অপেক্ষা করছিল ফেরিগুলো। রোস্টার পদ্ধতিতে দৌলতদিয়া প্রান্ত থেকে ফেরিগুলো ছেড়ে যাচ্ছে। দৌলতদিয়া থেকে ছেড়ে যাওয়া ফেরিগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ কোরবানির পশুবোঝাই ট্রাক ও ছোট গাড়ি রয়েছে। যাত্রীবাহী বাসের সংখ্যাও কম। সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টায় মাত্র ১৫টি বাস দৌলতদিয়া প্রান্ত থেকে পাটুরিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যেতে দেখা গেছে। 

যাত্রীদের অনেকেই বলেন, ‘অভিশপ্ত ফেরিঘাট হচ্ছে দৌলতদিয়া। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেতে মানুষ এখন পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকায় যাচ্ছেন। দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন পারাপার।’

গরুবোঝাই ট্রাকচালক মো. আমিন ব্যাপারী বলেন, প্রায় দুই যুগ গরু নিয়ে দৌলতদিয়া ফেরিঘাট দিয়ে ঢাকায় যাওয়া-আসা করি। ঈদের ৮-১০ দিন আগের থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। ভোগান্তি অতিরিক্ত ভাড়া, বখরা সবই ছিল এই ঘাটে। কিন্তু এখন সরাসরি ফেরিতে যেতে পারছি। কোনো ভোগান্তি নেই।

বিআইডব্লিউটিসির দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক মো. শিহাব উদ্দীন বলেন, ফেরিঘাটে বর্তমানে কোনো ভোগান্তি নেই। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে বর্তমানে স্বস্তির যাত্রা শুরু হয়েছে। তবে যানবাহন পারাপারের সংখ্যা অনেক হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে এ রুটে ১৬টি ফেরি চলাচল করছে।

জানা গেছে, বর্তমানে যেসব যানবাহন নদী পারের জন্য আসছে সেগুলো সরাসরি ফেরিতে উঠতে পারছে। অধিকাংশ ফেরিই এখন যানবাহনের জন্য প্রায় ১ ঘণ্টা অপেক্ষা করে ঘাট ছেড়ে যাচ্ছে। আবার কোনো কোনো সময় যানবাহন না পেয়ে অর্ধেক জায়গা ফাঁকা রেখেই ঘাট ছাড়ছে ফেরিগুলো।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন (বিআইডব্লিউটিসি) দৌলতদিয়া ঘাট শাখার ব্যবস্থাপক প্রফুল্ল চৌহান বলেন, ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে দৌলতদিয়া নৌরুটে পাঁচ দিনে যানবাহন কমেছে ৭ হাজার ৬৮৮টি। তবে আমরা আশা করছি আর কয়েক দিন পর কোরবানির ঈদ, সে সময় গরুর ট্রাকসহ যানবাহনের চাপ পড়বে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর