বৃহস্পতিবার, ৪ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

উন্নয়ন সহযোগীদের পাশে চায় সরকার

আইএমএফকে চিঠি দেওয়ার পর এবার বিশ্বব্যাংক, জাইকা, এডিবি, ইউএসএইড ইউকেএইড থেকে ঋণ ও সহায়তা পেতে চেষ্টা। অর্থবছরের শুরুতে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কিছুটা বেড়েছে

মানিক মুনতাসির

প্রতি মাসে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স থেকে দেশে যে পরিমাণ আয় আসছে তা প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে আমদানি ব্যয় হচ্ছে ৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। প্রতি মাসে বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি থাকছে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এদিকে ডলারের সংকট বাড়ায় টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত। গতকালও খোলাবাজারে প্রতি ডলার রেকর্ড ১০৮-১০৯ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এর এক সপ্তাহ আগে তা ১১২ টাকায়ও উঠেছিল। এমন পরিস্থিতিতে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা আনতে এবং সংকটে পড়া অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে বৈদেশিক ঋণ ও সহায়তাই একমাত্র ভরসা, যার পরিপ্রেক্ষিতে উন্নয়ন-সহযোগীদের ঋণ ও সহায়তা পেতে সক্রিয় সরকার। আইএমএফকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়ার পরপরই বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ঢাকা সফর করেন জাইকার প্রেসিডেন্ট। তার সঙ্গে বৈঠক করে ৫০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা চেয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এ ছাড়া জাইকার অর্থায়নে চলমান প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন স্বাভাবিক রাখারও অনুরোধ জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ মুুহূর্তে আমরা একটি জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের সব ধরনের অপচয় কমাতে হবে। টাকা পাচার রোধ করতে হবে। রিজার্ভের সাশ্রয় ও সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে হবে। আমরা যে কোনো সংকটের বোঝা ধনীদের ওপর না চাপিয়ে গরিবদের ওপর চাপাই। এতে বৈষম্য বাড়ে। এ জন্য বড়লোকদের ভর্তুকি না দিয়ে গরিবদের ভর্তুকি দিতে হবে।’ তিনি বলেন, যে সংস্থার কাছ থেকেই ঋণ নেওয়া হোক না কেন, তা ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে। একইভাবে ডলারের খরচে লাগামটা আরও শক্ত করে ধরতে হবে।

এদিকে সামষ্টিক অর্থনীতির অবস্থা যে ভালো নেই এটা বুঝতে খুব বেশি গবেষণার প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। প্রতিদিনই আমরা ঝুঁকির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। করোনা মহামারির ধাক্কা প্রশমিত হওয়ার সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দামামা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নতুন এক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। মূল্যস্ফীতির চাপ ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে গেছে। বাণিজ্য ঘাটতি ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। উচ্চ আমদানি ব্যয়, ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি, রেমিট্যান্সে নিম্নগতি, কমছে রিজার্ভ, রাজস্ব আয়ে নেমে এসেছে স্থবিরতা। সব ধরনের ব্যয় কমিয়েও পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা) ঋণ চেয়েছে সরকার। বাজেট সহায়তার অংশ হিসেবে এ ঋণ হবে স্বল্প সুদের এবং সহজ শর্তের এমনটাই মনে করে বাংলাদেশ। গত মাসের শেষ দিকে আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়ে চিঠি দেওয়ার পর এবার বিশ্বব্যাংক, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেটিভ এজেন্সি (জাইকা), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থা ইউএসএইড ও যুক্তরাজ্যের সাহায্য সংস্থা ইউকেএইড থেকে ঋণ পেতে যোগাযোগ শুরু করেছে সরকার। সংকট মোকাবিলায় ঋণ ও সহায়তা পেতে এসব সংস্থাকেও আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে অর্থ বিভাগের একাধিক সূত্র।

তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাসে (জুলাই) রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বেড়েছে। জুলাই মাসে রেকর্ড পরিমাণ ২ দশমিক শূন্য ৯ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত ১৫ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) একই মাসের চেয়ে এটি প্রায় ১১ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের একই মাসে এসেছিল ১৮৭ কোটি ডলার। এ ছাড়া গতকাল প্রকাশিত ইপিবির প্রতিবেদন মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে প্রায় ১৫ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ অর্থবছরের জুলাই মাসে পণ্য খাতে মোট রপ্তানি আয় হয়েছে ৩৯৮ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৫১ কোটি ডলার বেশি।

এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, জুনে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশ অতিক্রম করেছে। খাদ্যে মূল্যস্ফীতি প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশ। এক বছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার কমেছে। প্রতি মাসে বাণিজ্য ঘাটতি থাকছে দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি। অর্থাৎ প্রতি মাসে যে পরিমাণ রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় আসছে, এর চেয়ে আমদানি ব্যয় অন্তত ২ বিলিয়ন ডলার বেশি হচ্ছে। ফলে এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ কমেছে। ২১ জুলাই ২০২২ পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩৯ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। এক বছর আগে ২১ জুলাই ২০২১ ছিল ৪১ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার। এদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমছে প্রতিদিনই। প্রতি এক ডলার খোলাবাজারে ১০৯ টাকা অতিক্রম করেছে। ব্যাংকিং চ্যানেলেও ১০৩ টাকায় উঠেছে প্রতি ডলার। এর প্রভাবে কেবল চলতি বছরই টাকার অবমূল্যায়ন করতে হয়েছে ১০ শতাংশের বেশি। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ তিন বছরের জন্য ৪ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার চেয়েছে আইএমএফের কাছে। জরুরি ভিত্তিতে লেনদেনের ভারসাম্য বজায় রাখা ও বাজেট সহায়তা বাবদ বাংলাদেশ সংস্থাটির কাছে এ পরিমাণ অর্থ চেয়েছে। এর আগে ১২ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত আইএমএফের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করেছে। এ ঋণের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই হচ্ছে। ঋণপ্রস্তাব চূড়ান্ত হওয়ার আগে নিয়ম অনুযায়ী আবারও ঢাকা সফর করবে আইএমএফ। সূত্রগুলো বলছে, বিশ্ববাজারে হু হু করে বাড়ছে জ্বালানি, খাদ্য ও নিত্যপণ্যের দাম। ব্যাহত হচ্ছে সরবরাহ ব্যবস্থা। কভিডের ক্ষতি থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার পেতে পেতে নতুন বিপদ হিসেবে আসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস, সার ও ভোজ্য তেলের বাজার এখনো অস্থির। ফলে কেবল নয়টি পণ্যেই, অর্থাৎ পরিশোধিত ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), কয়লা, চাল, গম, ভুট্টা, সার, পাম ও সয়াবিন তেল আমদানিতে বাড়তি গুনতে হয়েছে ৭৬০ কোটি ডলার। প্রতি ডলার ৯৪ দশমিক ৭০ টাকা দরে হিসাব করলে বাংলাদেশি মুদ্রায় তা দাঁড়ায় ৭১ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা। অর্থনীতির এ খারাপ সময়ে সহায়তা চেয়ে চিঠি পাঠানোটা যৌক্তিক ও সময়োপযোগী মনে করা হচ্ছে। এখন দরকার আলোচনা শুরু করা। আইএমএফের একটি মিশন দ্রুত ঢাকায় আসার প্রত্যাশা করছে অর্থ বিভাগ। অর্থ বিভাগ বলছে, ঋণের জন্য শুধু আইএমএফ নয়, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকার কাছ থেকেও ৫০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এ নিয়ে গত সপ্তাহে জাইকার সভাপতি আকিহিকো তানাকার সঙ্গে বৈঠক করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এডিবির সঙ্গে ১০০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা নিয়ে আলোচনা চলছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ৭০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা নিয়েও চিঠি চালাচালি করছে সরকার। এ ছাড়া ইউকেএইড, ইউএসএইডসহ সব উন্নয়ন-সহযোগীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে উন্নয়ন-সহযোগী অনেক দেশ ও সংস্থার সঙ্গে অনলাইনেও যোগাযোগ করেছেন অর্থমন্ত্রী।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর