রবিবার, ৫ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা
জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস উপলক্ষে গোলটেবিল বৈঠক

প্রস্তুতি ও সচেতনতা রুখবে দুর্যোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রস্তুতি ও সচেতনতা রুখবে দুর্যোগ

প্রতি বছরই ঝড়, বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন দুর্যোগের চোখ রাঙানি থাকে বাংলাদেশের ওপর। তবে পূর্বাভাস ও পূর্বপ্রস্তুতির কারণে দুর্যোগের ক্ষতি কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। দুর্যোগে নতুন আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে ভূমিকম্প। এ দুর্যোগ ঠেকাতে সঠিক নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণ এবং স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহারে জোর দিয়েছেন বক্তারা। দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস সামনে রেখে গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের গোলটেবিল বৈঠকে তারা এসব কথা বলেন।

এ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আগামী ১০ মার্চ পালিত হবে জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য ‘স্মার্ট বাংলাদেশের প্রত্যয়, দুর্যোগ প্রস্তুতি সবসময়।’ রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বাংলাদেশ প্রতিদিন কার্যালয়ে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রধান বার্তা সম্পাদক কামাল মাহমুদের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলাম এমপি। অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী বক্তব্য দেন বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম। বাংলাদেশ প্রতিদিনের নির্বাহী সম্পাদক আবু তাহেরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মাহবুবা নাসরিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মুজিবকিল্লা নির্মাণ সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্পের সহকারী প্রকৌশলী মুহাম্মদ মবিনুর রহমান, কুমিল্লা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা এম আবেদ আলী। এ সময় উপস্থিত ছিলেন কালের কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক, কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, বাংলাদেশ প্রতিদিনের উপ-সম্পাদক মাহমুদ হাসান, প্রধান প্রতিবেদক মনজুরুল ইসলাম, সার্কুলেশন বিভাগের প্রধান বিল্লাল হোসেন মন্টু, বিজ্ঞাপন বিভাগের প্রধান সালাহ উদ্দিন আহমেদ এবং ডিজাস্টার রিস্ক ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনহ্যান্স প্রজেক্টের পরিচালক সুব্রত পাল চৌধুরী। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ১৫ মিটার দৈর্ঘ্য পর্যন্ত সেতু/কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক মো. ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিকল্পনায় ১৯৭২ সালে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র চালু করা হয়। এর অধীনে দেশে বর্তমানে ৩৫০টি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র সচল রয়েছে। ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সাহায্যে ৭-১০ দিন পূর্বাভাস নির্ভুলভাবে পাওয়া যায়। বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে দেশের আটটি জায়গায় বজ্রপাত চিহ্নিতকরণ যন্ত্র বসানো হয়েছে। দুর্যোগ সহনীয় বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৩১২টি। ৩২৭টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। আরও ৫৫০টি আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উপকূলীয় ও বন্যাপ্রবণ এলাকায় ২৩০টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। ৪২৩টির নির্মাণকাজ চলছে। এ ছাড়া ১৪৮ উপজেলায় ৩৭৮টি মুজিবকিল্লা নির্মাণ করা হয়েছে। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলাম এমপি বলেন, ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে যতই আমরা শক্তিশালী হই ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করার শক্তি আমাদের নেই। কিন্তু সে জন্য আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারব না। এগুলো নিয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে। কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায়। যেমন- ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ১০ লাখ মানুষ মারা গেছে। কিন্তু এখন আর সে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হবে না। কারণ আমাদের সব ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি রয়েছে। যা করছি সব জনগণের জানমাল রক্ষা করার জন্য।’ নঈম নিজাম বলেন, ‘দুর্যোগ মোকাবিলায় সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। কারণ বড় ধরনের দুর্যোগে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোরও অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে। তুরস্ক, সিরিয়া ভূমিকম্প মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছে। দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য কোন জায়গাগুলোতে ঘাটতি আছে তা খুঁজে দেখতে হবে। উপজেলাগুলোতে ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নেই। আগে দুর্যোগ উপকূলবর্তী এলাকায় হানা দিত, এখন সারা দেশই দুর্যোগ ঝুঁকিতে রয়েছে।’ মো. কামরুল হাসান বলেন, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া আমাদের লক্ষ্য। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে। দুর্যোগ প্রতিরোধে সব ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এতে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি প্রশংসনীয়ভাবে কমিয়ে আনা হচ্ছে। জনগণকে বলব বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করুন।’ মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘১৮৯৭ সালে এই দেশে বড় ভূমিকম্প হয়। সে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮.২। ওই ভূমিকম্পে মৃত্যুর হার ছিল ১৫ শতাংশ। ঠিক ১২৫ বছর পর এখন যদি এই মাত্রার ভূমিকম্প হয় তাহলে আমাদের কী অবস্থা হবে? সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবে পুরান ঢাকা। এখন আগের তুলনায় রড ও সিমেন্টের মান অনেক ভালো। সবাইকে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) মেনে ভবন তৈরি করতে হবে। তাহলে ভূমিকম্পসহ সব ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধে অনেকটা সহায়ক হবে।’ অধ্যাপক মাহবুবা নাসরিন বলেন, ‘আমি ১৯৯১ সাল থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করছি। এ সময়কার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন দৃশ্যমান। এখন ঝটিকা বন্যা বা ফ্লাস ফ্লাড নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। অনলাইন অপারেশনাল ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে দুর্যোগের সব তথ্য সবার কাছে পৌঁছাতে হবে।’ অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘দুর্যোগ প্রস্তুতি একটা চলমান প্রক্রিয়া। দুর্যোগ প্রস্তুতি ও উদ্ধার তৎপরতায় বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল। ভৌগোলিকভাবেই বাংলাদেশ বন্যাপ্রবণ। আগে দ্রুত বন্যার পানি সরে যেত, কিন্তু এখন বন্যা দীর্ঘ হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হচ্ছে। বর্তমানে ভূমিকম্প ও ভূমিধস আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে। আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হতে হবে সবাইকে।’ মুহাম্মদ মবিনুর রহমান বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। প্রতি বছর বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ এখানে হয়ে থাকে। ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ড নামে একটি ওয়েবসাইটে জানা যায়, বিশ্বের ভয়ংকর ৩৫টি মৌসুমি ঘূর্ণিঝড়ের ২৬টি বঙ্গোপসাগরে হয়েছে। আমাদের সতর্কবার্তায় স্মার্টনেস আনতে হবে। তাহলে প্রাণহানি কমে আসবে।’ এম আবেদ আলী বলেন, ‘স্মার্ট বাংলাদেশের প্রত্যয়ে দুর্যোগ প্রস্তুতি সবসময়’। কুমিল্লা জেলা কার্যালয় বছরে দুটি দিবস পালন করে। এ ছাড়া বছরব্যাপী বিভিন্ন কার্যক্রম করে থাকে। সারা বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমাদের মহড়া কার্যক্রম চলমান থাকে। এসব ব্যবস্থাপনার কারণে সারা বিশ্বে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে।’

সর্বশেষ খবর