রবিবার, ২৬ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

ঝুলছে পৌনে ৩ লাখ মামলা

চেক জালিয়াতি - ♦ পাঁচ বছরের বেশি বিচারাধীন ২৪ হাজার, স্থগিত ৬৭২ ♦ বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তির শেষ নেই ♦ মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হলে অপরাধ কমবে অভিমত আইনজ্ঞদের

আরাফাত মুন্না

ঝুলছে পৌনে ৩ লাখ মামলা

শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের একটি বুটিক হাউসের মালিক শিশির কুমার হাজরা ২০১৯ সালে সাড়ে ৩ লাখ টাকার চেক প্রতারণার মামলা করেন মো. শফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। এনআই অ্যাক্টের ১৩৮ ধারায় এ মামলার বিচার চলছে ঢাকার চতুর্থ যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতে। এ মামলায় শুনানির তারিখ পড়ে সাত-আট মাস পর পর। একই আদালতে শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার ইলিয়াস আহমেদের মামলার বিচার চলছে। ৫ লাখ টাকার একটি চেক প্রতারণার অভিযোগে তিনি মামলাটি করেছিলেন রাজধানীর রামপুরার আফতাবনগরের বাসিন্দা মনীন্দ্রনাথ মন্ডলের বিরুদ্ধে। এ মামলার অবস্থাও একই। শুনানির তারিখ পড়ে সাত থেকে ১০ মাস পর পর। শুধু শিশির কুমার বা ইলিয়াস আহমেদের মামলা নয়, সারা দেশের আদালতে নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্ট (এনআই অ্যাক্ট)-এ দায়ের হওয়া পৌনে ৩ লাখের বেশি মামলা ঝুলে আছে। বছরের পর বছর ধরে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বিচারপ্রার্থীদের। পাওনা টাকা আদায় করতে আদালতে ঘুরে খরচ করতে হচ্ছে নিজ অর্থ। অপচয় হচ্ছে সময়। আইনজ্ঞরা বলেন, চেক ডিজঅনার ভয়াবহ অপরাধ। কিন্তু সে অনুযায়ী শাস্তি নেই। ফলে অপরাধও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আইনের দুর্বলতার কারণে এ অপরাধের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে না। সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে বিচারাধীন এনআই অ্যাক্টের মামলা ছিল ২ লাখ ৭৮ হাজার ৯৭৮টি। এর মধ্যে ২৩ হাজার ৯৪৮টি পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে। এ ছাড়া ৬৭১টি মামলা উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। এসবের মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি মামলা বিচারাধীন। এ জেলায় মোট ৯৬ হাজার ৪৮১টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে ১৪ হাজার ২৯০টি বিচারাধীন পাঁচ বছরের বেশি। আর সবচেয়ে কম মাত্র ১০৮টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে নেত্রকোনা জেলায়। এ জেলায় পাঁচ বছরের বেশি পুরনো কোনো মামলা নেই এনআই অ্যাক্টের। জানা গেছে, ব্যক্তিগত লেনদেন থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণের সিকিউরিটি হিসেবে দেওয়া হয় ব্যাংক হিসাবের চেক। আর সেই লেনদেনে যখন অঙ্গীকার ঠিক থাকে না, তখন চেকের বিপরীতে ১৮৮১ সালের এনআই অ্যাক্টের ১৩৮ ও ১৪০ ধারা অনুযায়ী মামলা দায়ের করা হয়। বিচার সংক্ষিপ্ত পদ্ধতির হলেও চেক প্রতারণার মামলা এখন পাওনাদারদের জন্য যেন মারণফাঁদে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের মামলায় বিচারের দীর্ঘসূত্রতা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। শুধু ব্যক্তি নয়, এসব মামলা নিয়ে চরম বিপাকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানও। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চেক ডিজঅনার ভয়াবহ অপরাধ। কিন্তু সে অনুযায়ী শাস্তি নেই। আর শাস্তি যেটা আছে, সেটাও মামলার দীর্ঘসূত্রতায় আটকে যায়। বর্তমান সময়ের ব্যবধানে আইনটির বেশ কিছু প্রায়োগিক দুর্বলতা রয়েছে। এটাকে আরও যুগোপযোগী করা উচিত। তিনি বলেন, মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে না পারলে অপরাধ কমবে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনজীবী ইমতিয়াজ আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এসব মামলায় অনেক সময় আসামি গ্রেফতার হয়, কিন্তু বিচার হয় না। শাস্তির নজির খুবই কম হওয়ায় অপরাধীদের ভয় কম। আর মামলাগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি হলে এসব অপরাধ কমে আসবে। তিনি বলেন, আইনে কিছু জটিলতা রয়েছে। কিছু ধারা সংশোধন করা খুব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। উল্লেখ্য, ১৮৮১ সালের মূল আইন ১৯৯৪, ২০০০ ও সর্বশেষ ২০০৬ সালে সংশোধন হলেও আইনের মৌলিক কাঠামোয় পরিবর্তন আসেনি। ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এক রায়ে চেক ডিজঅনার মামলার বিচারে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে। ওই রায়ে বলা হয়, এনআই অ্যাক্টের ৪৩ ধারা অনুযায়ী যে ‘কনসিডারেশনে’ চেক দেওয়া হয়েছিল, সেই ‘কনসিডারেশন’ পূরণ না হলে বা কোনো ‘কনসিডারেশন’ না থাকলে চেকদাতার কোনো দায়বদ্ধতা নেই। এদিকে ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বরে এনআই অ্যাক্টের বেশ কিছু সংশোধনসহ আইন মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠায় আইন কমিশন। নিরীহ, নিরপরাধ মানুষের হয়রানি রোধে বিশেষজ্ঞদের মত নিয়ে সংশোধনের সুপারিশটি পাঠানো হয়। দুই বছর পর সেই সুপারিশ আমলে নিয়ে এনআই অ্যাক্ট রহিত করে ‘হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন’ নামে নতুন আইন করার উদ্যোগ নেয় সরকার। বর্তমানে আইনটি খসড়া পর্যায়ে রয়েছে।

সর্বশেষ খবর