থাইল্যান্ডে বেড়ে ওঠা পংসাকর্ন পংসাকের সবচেয়ে প্রিয় পানীয় ছিল কচি নারকেলের পানি। বিদেশে গিয়ে সেই স্বাদ না-পেয়ে তার মনে জন্ম নেয় নতুন এক ব্যবসায়িক ভাবনা—থাই নারকেলের পানি বোতলজাত করে বিশ্ববাজারে পৌঁছে দেওয়া। সেখান থেকেই শুরু তার উদ্যোক্তা যাত্রা।
৪৫ বছর বয়সী পংসাকর্ন ব্যাংকক থেকে অনলাইন সাক্ষাৎকারে ফোর্বস ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘আমাদের নারকেলের ঘ্রাণ দারুণ। তাই ভাবলাম, কেন এই ভালো জিনিসটা আমরা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরব না?
১২ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত তার কোম্পানি জেনারেল বেভারেজ আইএফ ব্র্যান্ড নামে নারকেলের পানি বাজারে আনে। আজ চীনের মূল ভূখণ্ডে আইএফই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া ব্র্যান্ড, বাজারের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি অংশীদারিত্ব তাদের দখলে। প্রতিদ্বন্দ্বী ভিটা কোকো, ডেলগার্ডেন কিংবা মালি কোকোর মতো ব্র্যান্ডের তুলনায় আইএফ এখন অনেক এগিয়ে।
শুধু ২০২৪ সালেই আইএফের বিক্রি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫৮ মিলিয়ন বা ১৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৮০ শতাংশ বেশি। নিট মুনাফা দ্বিগুণ হয়ে পৌঁছেছে ৩৩ মিলিয়ন বা ৩ কোটি ৩০ লাখ ডলারে। এই আয়ের ৯৭ শতাংশই এসেছে চীনের বাজার থেকে।
চীনে সাফল্যের পর পংসাকর্ন আরও বড় লক্ষ্যে নজর দিচ্ছেন। জুনে হংকং শেয়ারবাজারে আইএফবিএইচ তালিকাভুক্ত হয় এবং সেখান থেকে ১৪৫ মিলিয়ন ডলার তোলা হয়। চারোয়েন পকফান্ড গ্রুপ, ইউবিএসসহ বড় বিনিয়োগকারীরা এতে শেয়ার কিনেছেন। তালিকাভুক্তির পরও কোম্পানির ৬০ শতাংশ শেয়ার পংসাকর্ন পংসাকের দখলে রয়েছে, যার মূল্য এখন প্রায় ৭০০ মিলিয়ন বা ৭০ কোটি ডলার।
ফলে তিনি থাইল্যান্ডের অন্যতম ধনী উদ্যোক্তায় পরিণত হয়েছেন। এখানেই থেমে থাকতে চান না তিনি; আইপিও থেকে পাওয়া অর্থের একটি অংশ ব্যয় করবেন চীনের বাইরের বাজার সম্প্রসারণে।
বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধির কারণে নারকেলের পানি ও উদ্ভিদভিত্তিক পানীয় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যুক্তরাজ্যের ইউরোমনিটরের হিসাবে, ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিশ্ববাজারে এ ধরনের পানীয়র বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ শতাংশ। সফট ড্রিংকস শিল্পের গড় প্রবৃদ্ধির (৬.৬%) চেয়ে যা অনেক বেশি।
পংসাকর্নের লক্ষ্য এখন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার বাজারে অবস্থান শক্তিশালী করা। বর্তমানে এ দুই দেশ থেকে রাজস্ব আসে অতি সামান্যই। অথচ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় নারকেলের পানির বাজার, যেখানে ২০২৪ সালে বিক্রি হয়েছে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ১৪০ কোটি ডলারের পানীয়। তবে সেখানে প্রবেশ সহজ নয়। কেননা, দীর্ঘদিন ধরে সেখানে ভিটা কোকোর অবস্থান শক্তিশালী।
পংসাকর্ন জানাচ্ছেন, তিনি এখনো থাইল্যান্ডকেই মূল সরবরাহকেন্দ্র হিসেবে ধরে রাখতে চান। এর মধ্য দিয়ে ‘থাই স্বাদকে’ বিশ্বদরবারে তুলে ধরা সম্ভব। তবে প্রয়োজনে অন্যান্য দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশ থেকেও সরবরাহ নেওয়ার পরিকল্পনা আছে।
চীনে কৌশলগত সময়োপযোগী পদক্ষেপ থেকে তারা সফলতা অর্জন করেছে। ২০১৫ সালে প্রথমে হংকংয়ে এই পণ্য বিক্রি শুরু হয়, এরপর ২০১৭ সালে চীনের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করে এই পানীয়—প্রথমে আলিবাবার টিমল ও জেডি ডটকমে অনলাইন বিক্রির মাধ্যমে। পরে যোগ হয় নতুন স্বাদের ভ্যারিয়েশন—যেমন জেসমিন চালের স্বাদযুক্ত নারকেলের পানি কিংবা আম-নারকেলের দুধ। তরুণ ভোক্তাদের টার্গেট করে জনপ্রিয় তারকা শিয়াও ঝানকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করা হয়।
কোম্পানির মডেল হলো অ্যাসেট–লাইট—অর্থাৎ উৎপাদন থেকে বিতরণ পর্যন্ত অনেক কাজ আউটসোর্সে করা হয়, যদিও কঠোরভাবে মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আগামী দুই বছরে তারা সরবরাহের উৎস আরও বহুমুখী করতে চায়।
পংসাকর্নের পথচলা শুরু হয়েছিল পারিবারিক ব্যবসা থেকে। যুক্তরাষ্ট্রে স্নাতক শেষে পরিবারের মালিকানাধীন সুয়ান গ্রুপে কাজ করেন। ২০১১ সালে দেশে ফিরে তিনি গড়ে তোলেন জেনারেল বেভারেজ, প্রথমে বিভিন্ন ফলের জুস দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও ২০১৫ সালে তিনি নারকেলের পানিতে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন। তার নিজের ভাষায়, ‘আমি যখন কোনো কিছুর মধ্যে ডুবে যাই, তখন কোনো পিছুটান থাকে না; পেছনে ফিরে তাকানোর অবকাশ নেই আমার।’
কোভিড মহামারিতে স্বাস্থ্যকর পানীয়র চাহিদা বেড়ে গেলে কোম্পানিটি চাহিদা মেটাতে হিমশিম খায়। তখন আন্তর্জাতিক ব্যবসাকে আলাদা করে আইএফবিএইচ গড়ে তোলা হয়। এখন রাজস্বের প্রায় ৯৮ শতাংশ আসে নারকেলের পানি থেকে। ভবিষ্যতে তিনি ফলের রস, থাই মিল্ক টি, স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস ও বিকল্প প্রোটিন পণ্যে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছেন। এজন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ কোটি ৬০ লাখ ডলার। যা এশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন কোম্পানি অধিগ্রহণে ব্যবহার করা হবে।
পংসাকর্ন বিশ্বাস করেন, আজ নারকেলের পানি হয়তো একটি ছোট খাত, কিন্তু একদিন এটি কমলার রসের মতো বৈশ্বিক বাজারে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নেবে। আর সেই যাত্রার অগ্রভাগে থাকতেই তার এই প্রচেষ্টা। সূত্র: ফোর্বস
বিডি প্রতিদিন/নাজিম