২ মার্চ, ২০২১ ০৯:৫৯

এমন ছাত্ররা যেন যুগে যুগে জন্ম নেয়

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

এমন ছাত্ররা যেন যুগে যুগে জন্ম নেয়

কেমন করে যেন ছাত্রদের সাথে আমার গভীর আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। শেকড়ের টানটা প্রাণের সুতোর সাথে একটা অলিখিত সমীকরণ সেখানে তৈরী করেছে। প্রথাগত শিক্ষক ছাত্রের প্রাচীর তত্ত্বে আমি কখনো বিশ্বাসী নই। তবে প্রাচীরটা তখনই ভাঙতে পারে যখন সে সম্পর্কটা নৈতিকতার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে। যেখানে আবেগ যুক্তিকে ও যুক্তি আবেগকে কখনো অতিক্রম করতে পারে না। আমি যতটা শিক্ষক তার থেকেও বেশি মানুষ হবার চেষ্টা করি। ঠিক তেমনি আমার কাছে একজন ছাত্র যতটা না ছাত্র তার থেকেও বেশি মানুষ। আমি ছাত্রদের মধ্যে ক্ষুধার যন্ত্রনা দেখেছি। প্রতিভাধরদের  চোখ আর মুখে পিপাসার জ্বালা দেখেছি। এটা খাদ্য আর পানির ক্ষুধা ও পিপাসার আকুতি ছিলো না বরং একজন ছাত্রের শিক্ষকের কাছে যতটা পাবার কথা ছিল ততটা না পাবার ক্ষুধা ও পিপাসা তাকে ভিতরে ভিতরে কাঁদিয়েছে। সে নীরব কান্নায় যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তা দেখার মতো শিক্ষকদের মনস্তত্ব চোখে পড়েনি। শিক্ষকদের দর্শনগত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলও ঘটেনি।

ছাত্রদের হাত ধরে এগিয়ে দেবার কথা কেউ ভাবছে না। দায়বদ্ধতার জায়গাটাতে সবাই হাত গুটিয়ে বসে আছে। ছাত্রদের ভিতরে প্রবেশ করে তাদের ভিতরের না বলা কথাগুলো বের করে এনে তা সমাধান করার যেন কেউ নেই। প্রতিদিন জীবনের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয় আমাদের ছাত্রদের। অনেক স্বপ্ন আর আশা নিয়ে দিনগুনে ছাত্রদের পরিবারগুলো। বাবার ভেঙে পড়া শরীর, মায়ের ছেঁড়া শাড়ির আঁচলে লুকানো কষ্ট, বোনের বিবর্ণ মুখ  আর ভাইয়ের ক্লান্ত চোখ জীবনের ঘানি টানতে টানতে অপেক্ষায় থাকে তার জন্য, আমাদের আশেপাশে স্বপ্ন খোঁজা ছাত্রটির জন্য। আমাদের ছাত্ররা গবেষণা করতে চায়। নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠতে চায়। কিন্তু কোথাও তো কেউ নেই। এমন কাউকেই তো এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না,  যারা ছাত্রদের আলোকিত পথ দেখিয়ে দিবে। তারায় তারায় স্বপ্নের রং বুনে আধার থেকে আলোর পথে যাত্রা শুরু করবে। ছাত্ররা অজয়কে জয় করতে চায়। সাহিত্য, দর্শন, মনস্তত্ব, সংগীত সহ সৃজনশীলতার সব জায়গায় ছাপ রেখে দিতে চায়। তারপরও ছাত্ররা মধ্যরাস্তায় দাঁড়িয়ে খুব অসহায় হয়। খুব শীতে জড়োসড়ো হয়ে থাকার মতো এক একটা প্রহর কাটায়। নির্ঘুম রাত আস্টেপিস্টে চিন্তার স্রোতে ভাসিয়ে নিতে চায় আমাদের ছাত্রদের। অনেক কথা হয়তো তাদের থাকে, হয়তো  সবাই তা জানে কিন্তু কেউ বলতে চায় না। শুনতে যায় না। জানতে চায় না। তবে কি সব স্থবির হয়ে আটকে যাবে মাছ ধরার বড়শিতে।  সেটা তো হতে দেওয়া যায় না। কারণ তখনও শুভশক্তি তার প্রাণশক্তি নিয়ে বলে উঠবে, শিক্ষা হোক আলোকিত। শিক্ষা হোক জীবন সম্পৃক্ত। গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষা নতুন জ্ঞান সৃষ্টির তীর্থভূমি হয়ে উঠুক। শিক্ষা হয়ে উঠুক মানবিক ও উদার। মৌলিক আর ফলিত গবেষণায় জাগ্রত হোক ছাত্ররা। ভেঙে পড়ুক সব অচলায়তন। বাধা, বিপত্তি, দুর্বোধ্যতা। শিক্ষকদের আলোয় মহিমান্বিত হয়ে উঠুক পিছনের ব্রেঞ্চে বসে থাকা অমনোযোগী ছাত্রটাও। আমি শিক্ষক তখনই অনেক বড় হয়ে উঠি যখন আমার ছাত্র আমাকে ছাড়িয়ে গিয়ে আরও অনেক বড় হয়ে উঠবে।

দরজায় কে যেন কড়া নাড়ছে। স্বার্থটা পড়ে থাকে বিধস্ত মাটিতে। দরজাটা খুলে যাক প্রকৃতির উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে। কারণ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের একদল মেধাবী প্রাণোচ্ছল ছাত্র। যারা একটু বিশ্বাস ও ভালোবাসা পেলে পৃথিবী বদলে দিবে। কারণ আমাদের স্বপ্নবাজ ছাত্ররা যা পারে তা আর কেউ পারে না। ইতিবাচক চিন্তাধারা দ্বারা পুষ্ট হোক তাদের মেধাশক্তি। তাদের প্রতিভার দীপ্যমান আলোর রশ্মি পৃথিবীকে চিৎকার করে বলে উঠুক, আমরা যদি একটু আলো পাই তবে আমরা সূর্য হয়ে উঠবো। তখন সে সূর্য ক্রমাগত আলোর ভিতরে আলোর ছড়িয়ে পৃথিবীর দুষ্প্রাপ্য সম্পদে পরিণত হবে। সেদিন আমরা শিক্ষকরা হয়তো নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে কোনো এক সমুদ্রসম জলরাশির প্রবল স্রোত দ্বারা তাড়িত হয়ে বলে উঠবো "এমন ছাত্ররা যেন যুগে যুগে জন্ম নেয়"। যেমন জন্ম নেয় একটার পর একটা প্রজন্ম। একটার পর একটা সভ্যতা।

বিডি প্রতিদিন/ সালাহ উদ্দীন

সর্বশেষ খবর