বৃহস্পতিবার, ২৬ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

স্বাস্থ্যসেবায় এগিয়ে যাচ্ছে দেশ

► বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার প্রায় ৬৫ ভাগ নিশ্চিত করছে বেসরকারি হাসপাতালগুলো ► রোগী ও চিকিৎসকদের অধিকার নিশ্চিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন জরুরি

জয়শ্রী ভাদুড়ী

স্বাস্থ্যসেবায় এগিয়ে যাচ্ছে দেশ

দেশের স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। কভিড-১৯ মহামারি সামলাতে সরকারি হাসপাতালের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে সেবা দিয়ে গেছে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো। দেশে ৬৫ শতাংশের বেশি রোগী চিকিৎসাসেবা নেয় বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে।

তবে অনেক সময় ভুল রিপোর্ট, কমিশন বাণিজ্য, অপচিকিৎসার অভিযোগ ওঠে বিভিন্ন হাসপাতাল-ক্লিনিকের বিরুদ্ধে। নিয়মিত তদারকির ব্যবস্থা না থাকায় কিছু প্রতিষ্ঠানের জন্য সুনাম নষ্ট হয় অন্য বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকেরও। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার খরচ নিয়েও রয়েছে আলোচনা-সমালোচনা।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার প্রায় ৬৫ ভাগ নিশ্চিত করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর সব দেশেই শুধু সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রত্যেক মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা কঠিন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে সরকারকে সহযোগিতা করছে। করোনাকালে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দেশের মানুষের কল্যাণে যে সেবা দিয়েছে, নিঃসন্দেহে তা প্রশংসার দাবিদার।’ তিনি আরও বলেন, ‘চিকিৎসার গুণগত মান উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে তদারকি প্রয়োজন। হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে রোগীদের বিভিন্ন রকম অভিযোগ থাকে। তার সমাধান করতে হবে। সেবা দিতে গিয়ে অনেক সময় চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরা নানারকম হামলার শিকার হন। এগুলো সমাধানে আমরা স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন চাই। দীর্ঘ সময় ধরে আমরা এ আইনের দাবি জানিয়ে আসছি। স্বাস্থ্যসেবায় আধুনিকায়নের সঙ্গে গুণগত মান বাড়াতে নজর দেওয়া জরুরি।’

স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের পরিচালক (গবেষণা) ড. মো. নুরুল আমিনের ‘রোগীর নিজ পকেট থেকে চিকিৎসার জন্য উচ্চ ব্যয়ের নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধান’ শীর্ষক গবেষণায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে সেবাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে। তাঁর গবেষণায় দেখা যায়, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা খরচ কম। অথচ মাত্র ১৪ দশমিক ৪১ শতাংশ মানুষ সরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিতে যায়। এর মধ্যে আছে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র (৫ দশমিক ২২ শতাংশ), উপজেলার নিচে (৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ), জেলা হাসপাতাল ও মাতৃসদন (৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ), মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত হাসপাতাল (১ দশমিক ৮৭ শতাংশ) এবং অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান (০ দশমিক ০৯ শতাংশ)। ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ পরীক্ষা-নিরীক্ষাই রোগীকে করতে হয় বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। চিকিৎসাসেবায় বড় অবদান রেখে চলেছে বেসরকারি খাত। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তিন ধরনের। ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসায়িক হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। বেসরকারি দাতব্য প্রতিষ্ঠান এবং দেশি বা বিদেশি এনজিওচালিত প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানই বেশি। চিকিৎসার পাশাপাশি মেডিকেল শিক্ষায়ও তারা বড় ভূমিকা রাখছে। এখন যত সরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে, তার দ্বিগুণ রয়েছে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ। সরকারি হাসপাতালে শয্যাসংকট, জনবলের অপ্রতুলতার কারণে মানুষের বেসরকারি হাসপাতালের প্রতি উৎসাহ বাড়ছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, রোগীর সংখ্যা বাড়ায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। কিন্তু এর অধিকাংশই মানসম্মত নয়। একদিকে যেমন পাঁচ তারকাবিশিষ্ট বিলাসবহুল হাসপাতাল রয়েছে, তেমনই রয়েছে মেয়াদোত্তীর্ণ নিম্নমানের ক্লিনিক। বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৬৫৪টি এবং এসব হাসপাতালে মোট শয্যা ৫১ হাজার ৩১৬টি। বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৫ হাজার ৫৫টি, যেখানে মোট শয্যা ১ লাখ ৫ হাজার ১৮৩টি। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট আইসিইউ শয্যা রয়েছে ১ হাজার ১৬৯টি। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে রয়েছে ৪৩২টি (ঢাকায় ৩২২টি, ঢাকার বাইরে ১১০টি) আর বেসরকারি হাসপাতালে ৭৩৭টি (ঢাকা মহানগরীতে ৪৯৪টি, অন্যান্য জেলায় ২৪৩টি)। তবে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে চিকিৎসার মান নিয়ে এখনো রয়েছে নানা অভিযোগ। কিডনি, লিভার ট্রান্সপ্লান্টের মতো জরুরি চিকিৎসার জট খুলতে শুরু করেছে। ক্যান্সার চিকিৎসায় এখনো রয়েছে প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবলের সংকট। স্বাস্থ্যবীমা না থাকায় চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে অসহায় অবস্থায় পড়তে হচ্ছে মানুষকে।

ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রাইভেট হসপিটালস সোসাইটি অব বাংলাদেশের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডাঃ আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী বলেছেন, ‘প্রায়ই বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের সৃষ্ট ঝামেলার কথা শোনা যায়। এর অন্যতম প্রধান কারণ বিল। অথচ উন্নত দেশে, এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও রয়েছে স্বাস্থ্যবীমা, যা রোগীদের বিলের বোঝা কমাতে পারে। তাই সরকারের কাছে আবেদন- স্বাস্থ্যবীমা বাধ্যতামূলক করা হোক।’

উন্নত বিশ্বের প্রায় সব আধুনিক চিকিৎসাসেবা বাংলাদেশে রয়েছে। হৃদরোগ চিকিৎসায় বাংলাদেশ এখন গর্ব করে। একসময় একটা এনজিওগ্রাম করার জন্য রোগীকে বিদেশে যেতে হতো। ভারতে গিয়ে এনজিওগ্রাম করাতে ভিড় করত বাংলাদেশের রোগী। বর্তমানে দেশে ৫০টির বেশি কার্ডিয়াক সেন্টার রয়েছে। প্রতি বছর কয়েক লাখ রোগী হৃদরোগের উন্নত ও সর্বাধুনিক চিকিৎসা দেশেই পাচ্ছে। গত এক যুগে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে যুগান্তকারী উন্নতি হয়েছে। সরকারি হাসপাতাল স্থাপন, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সংখ্যাবৃদ্ধিসহ বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ, রোগ নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠান ও আধুনিক হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ল্যাবএইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডাঃ এ এম শামীম বলেছেন, ‘দেশে কিডনি ও লিভার ট্রান্সপ্লান্ট নিয়ে জটিলতা আছে। আমরা এ সেবা দিতে আগ্রহী। দক্ষ চিকিৎসক, উন্নত প্রযুক্তি সবই আছে। আইনি জটিলতার কারণে রোগীরা সেবা নিতে পারছে না, অন্য দেশে যাচ্ছে।’ ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল ও সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাকিফ শামীম বলেছেন, ‘ক্যান্সার চিকিৎসায় আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ-সুবিধা এখন দেশেই রয়েছে। দেশে চিকিৎসা নিয়ে মানুষ সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে যাচ্ছে। প্রতিদিনই অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে দেশে গড়ে উঠছে নতুন নতুন হাসপাতাল।’

মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু হার হ্রাস পেয়েছে। সীমাবদ্ধ সম্পদ ও বিপুল জনগোষ্ঠী নিয়ে এ অর্জন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের এ অর্জনের জন্য তিনটি জাতিসংঘ পুরস্কারসহ ১৬টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত। এর মধ্যে এমডিজি অ্যাওয়ার্ড, সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব অর্জনে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডাঃ শেখ দাউদ আদনান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবা খাতে সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার সেবা দিয়ে যাচ্ছে। সরকারি হাসপাতালের সঙ্গে সেবার মান প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করে তুলতে বেসরকারি হাসপাতাল প্রয়োজন। এতে মানুষের বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকে কোন প্রতিষ্ঠান ভালো সেবা দিচ্ছে এবং সে কোথায় সেবা নিতে চায়। মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান দেশের জন্য প্রয়োজন।’

সর্বশেষ খবর