শনিবার, ২৭ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

দেশ-বিদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

দেশ-বিদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম

স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়

একটি রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য চারটি মূল উপকরণের মধ্যে নির্দিষ্ট ভূখন্ড, জনসংখ্যা ও সরকারের সঙ্গে অন্যতম উপাদান সার্বভৌমত্ব তথা স্বাধীনতা। তবে স্বাধীনতা লাভ কোনো সহজ বিষয় নয়। বিশ্বের আদিকাল থেকে দুর্বলদের পরাধীন করে নিজের সুনাম, প্রতিপত্তি ও সম্পদ বৃদ্ধির নগ্ন ইতিহাস ঠাঁই পেয়েছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। জেনেভায় জন্ম নেওয়া অষ্টাদশ শতকের রাজনৈতিক দার্শনিক রুশো তাঁর জগৎখ্যাত সামাজিক চুক্তি দর্শনে বলেছেন, ‘মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলিত’। আর এই শৃঙ্খলিত জীবনের যাতনার কথা ফুটে উঠেছে কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বাধীনতা হীনতায়’ কবিতায়। কবির মতে “স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কেও বাঁচিতে চায়? দাসত্ব শৃংখলা কে পরিবে পায় হে কে পরিবে পায়? কোটি কল্প দাস থাকা নরকের প্রায় হে, নরকের প্রায়, দিনেকের স্বাধীনতা, স্বর্গ সুখ তায় হে স্বর্গ সুখ তায়।” এক সময় ব্যক্তির স্বাধীনতাও হরণ করে দাসপ্রথা চালু হয়। এরপর সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বাধীনতা হরণ করে চলে উপনিবেশিকতার শৃঙ্খল।

তবে সেই উপনিবেশিকতার খোলস ভেঙে স্বাধীনতা লাভের জন্য বহু জাতিকে বেছে নিতে হয়েছে সংগ্রামের পথ। যদিও আলোচনা ও পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে কিংবা নিজ দেশে গণআন্দোলনের মুখে কিছু দেশ স্বাধীন হয়েছে; কিংবা রাজতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে বা স্বাধীনতায় ফিরেছে, তবে সেই তুলনায় যুদ্ধ করে তথা রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশের সংখ্যাই বেশি। যার অন্যতম স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ।

 

ভিয়েতনাম ১৯৫৪ সাল এবং ১৯৭৫ সাল

পৃথিবীর তথাকথিত পরাশক্তি বা শক্তিশালী দেশসমূহের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, মতপার্থক্য শক্তি প্রদর্শন ও আধিপত্যবাদ নীতি একটি চিরায়ত সত্য ঘটনা। এসব কারণে বিংশ শতকে পৃথিবী প্রত্যক্ষ করছে দুটি বিশ্বযুদ্ধসহ অসংখ্য রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। পরাশক্তির এই মরণঘাতী প্রতিযোগিতার করুণ শিকার পৃথিবীর অসংখ্য নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় জনপদ, যার অন্যতম ভিয়েতনাম।

১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সালে শুরু হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দীর্ঘ ৬ বছর পর ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর শেষ হয়। এই যুদ্ধে জাপান, জার্মানি, ইতালিসহ অন্যান্য মুষ্টিমেয় দেশের সমন্বয়ে গড়া অক্ষশক্তি পরাজিত হয় ব্রিটেন, আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের সমন্বয়ে গড়া মিত্রবাহিনীর কাছে। এই পরাজয়ের সূচক বা আনুষ্ঠানিকতা হয় ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ সালে জাপানের টোকিও শহরের বে নামক স্থানে। এই আত্মসমর্পণের দলিলে পরাজিত জাপান এবং বিজয়ী মিত্রবাহিনীর বিভিন্ন দেশ স্বাক্ষর করে। ঠিক এই দিনেই অর্থাৎ ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ তারিখে ভিয়েতনামের বিপ্লবী নেতা এবং পরবর্তীকালের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হো চি মিন ভিয়েতনামের হেনয় শহরে ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব ভিয়েতনাম প্রতিষ্ঠা তথা ভিয়েতনামের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে লাউস, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া অর্থাৎ বৃহত্তর ইন্দোচীনকে একটি  ভৌগোলিক অক্ষরেখা (১৬ ডিগ্রি অক্ষাংশ) বরাবর বিভক্ত করা হয়। এতে ভারত উপমহাদেশ সংলগ্ন দক্ষিণাংশ তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক অ্যাডমিরাল মাউন্ট ব্যাটেনের অধীন করা হয়। এই অংশে থাকা জাপানি সেন্যরা মাউন্ট ব্যাটেনের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং উত্তরে থাকা সৈন্যরা চীনের বিপ্লবী ও সামরিক নেতা চিয়াং কাই শেকের কাছে আত্মসমর্পণ করে। দক্ষিণের চায়না হো চি মিন কর্তৃক ভিয়েতনাম প্রতিষ্ঠা সমর্থন করলেও উত্তরে থাকা ব্রিটিশরা তা মেনে নিতে পারেনি। ফলে প্রতিষ্ঠার মাত্র ২০ দিনের মাথায় অর্থাৎ ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশদের সম্মতিতে ফ্রান্স হো চি মিনের শাসন ব্যবস্থা তথা স্বাধীন ভিয়েতনামের অবসান ঘটায় এবং ফ্রান্স কর্তৃক এই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা দেয়।

এই ঘোষণার পর ফ্রান্সের দখলদার বাহিনী ও তাদের মিত্রদের বিরুদ্ধে তথা দক্ষিণের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে হো চি মিন বাহিনী। পরের বছর (১৯৪৬ সাল) ফ্রান্সে উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা হলেও তা বিফল হয়। এর ফলে একদিকে ফ্রান্স ভিয়েতনামের উত্তর ও দক্ষিণ, উভয় অংশে প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তার করে। অন্যদিকে ভিয়েতনাম বাহিনী হো চি মিন ও তার প্রধান সামরিক কমান্ডার ভো নগিয়েন গিয়াপের নেতৃত্বে আত্মগোপনে বা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়। শুরু হয় ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের স্বাধীনতা সংগ্রাম।

প্রথম দিকে মূলত প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ধীরগতিতে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে গেরিলা লড়াই করতে থাকে হো চি মিন বাহিনী। পরবর্তী পুঁজিবাদী ফ্রান্সেকে সমর্থন দেয় আমেরিকা। অন্যদিকে হো চি মিনের পাশে দাঁড়ায় সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট শক্তি তথা চীন, রাশিয়া ও পূর্ব জার্মানি। উভয়পক্ষের সামরিক প্রশিক্ষণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ ও কূটনৈতিক তৎপরতায় এক মৃত্যুকূপে পরিণত হয় ভিয়েতনাম।

১৯৪৯ সালে গেরিলা প্রলেপের বাইরে প্রকাশ্যেই নেমে পড়ে হো চি মিন বাহিনী। গেরিলা যুদ্ধের পাশাপাশি শুরু হয় নিয়মিত যুদ্ধ। ফ্রান্স ভিয়েতনামের বিভিন্ন অঞ্চলে শক্তিশালী ঘাঁটি তৈরি করে এবং বিমানশক্তি বাড়িয়ে আকাশ থেকে আক্রমণ চালাতে থাকে। অন্যদিকে হো চি মিন ও জেনারেল গিয়াপের বাহিনী বনে-জঙ্গলে বিচরণ করে বিমানের চোখ ফাঁকি দেয় এবং চীন ও রাশিয়া থেকে পাওয়া অস্ত্র দিয়ে বিমান ধ্বংসেও পারদর্শী হয়ে ওঠে। এ সময় তারা স্থলভাগে ফ্রান্স ও দুর্গে আসা যাওয়ার পথে অ্যাম্বুশ বা আক্রমণ করে ফ্রান্সের খাবার ও যুদ্ধ সরঞ্জাম সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। ফলে ডিয়েন বিয়েন ফু নামক ফ্রান্স দুর্গ পতনের পর ১৯৫৪ সালের ২১ জুলাই আন্তর্জাতিক জেনেভা সম্মেলনের মাধ্যমে কার্যত ভিয়েতনামের উত্তরাংশের স্বাধীনতা মেনে নেয় ফ্রান্স। তবে ভিয়েতনামের দক্ষিণ অংশ নিয়ে নতুনভাবে ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুরু হয় আমেরিকার বিরুদ্ধে, যা চলে ২০ বছর (১৯৫৫-১৯৭৫ সাল পর্যন্ত)। এক পর্যায়ে আমেরিকানরাও ভিয়েতনাম ছাড়াতে বাধ্য হয়। তবে সার্বিক বিচারে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে পরিচালিত সংগ্রামকেই ভিয়েতনামের স্বাধীনতা সংগ্রাম ধরা হয়। ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ সালে হো চি মিন স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়ে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেন এই প্রেক্ষিতে ২ সেপ্টেম্বর ভিয়েতনামের জাতীয় দিবস ও স্বাধীনতা ঘোষণার দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়।

 

সুইডেন ১৫২৩ সাল

শীতপ্রধান দেশ সুইডেনের ইতিহাস বেশ পুরনো। ধারণা করা হয়, আজ থেকে প্রায় তিন হাজার বছর আগে থেকেই সুইডেনে মানুষ বসবাস শুরু করে। এক সময় ডেনমার্কের রানী মার্গারেটার অনুগত্য মেনে ডেনমার্ক, নরওয়ে ও সুইডেন একটি ইউনিয়ন হিসেবে সংঘবদ্ধ ছিল। এ অঞ্চলের শাসক দ্বিতীয় ক্রিস্টিয়ান ১৫১৩ থেকে ১৫২৩ সাল পর্যন্ত নরওয়ে এবং ১৫২০ থেকে ১৫২১ সাল পর্যন্ত সুইডেন শাসন করেন। সুইডেনে তার অনুসারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আর্চ বিশপ গুস্তাভ ট্রলি। ১৫২০ সালে ক্রিস্টিয়ানোর অভিষেক উপলক্ষে সুইডেনে অবস্থিত স্টকহোমের রাজপ্রসাদে এক অভ্যর্থনা ও রাষ্ট্রীয় সভায় বিভিন্ন দল ও মতের নেতাদের জড়ো করা হয়।

অনুষ্ঠানের পরবর্তী কয়েকদিনে (৭ থেকে ৯ নভেম্বর ১৫২০) মতপার্থক্য, অর্থনৈতিক সংকট এবং ব্যক্তিত্বের সংঘাতকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্যে ও গোপনে প্রায় ১০০ জন নেতা-কর্মীর শিরন্ডেদ কিংবা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। ইতিহাসে এই হত্যাকান্ড স্টকহোম রক্তস্নান বা স্টকহোম ব্লাড বাথ নামে কুখ্যাত। এই করুণ ঘটনার করুণ শিকার হয়েছিলেন সুইডেনের জনপ্রিয় নেতা এরিক জনসন ভাসা। তারই পুত্র গুস্তাভ এরিকসন এই হত্যাকান্ডের পর তার পিতার দায়িত্ব ও এলাকার শাসনভার বুঝে নেন এবং দ্বিতীয় ক্রিস্টিয়ান ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন।

১৫২১ সালের জানুয়ারি মাসে এই যুদ্ধ শুরু হয়। গুস্তাভ তার পিতার হত্যাকারী ক্রিস্টিয়ানার সৈন্যদের চোখ ফাঁকি দিতে কৃষকের বেশ ধারণ করেন এবং পাশের রাজ্য ডালারনায় আশ্রয় নেন। ক্রিস্টিয়ানার নির্মমতার বর্ণনা শুনে ডালারনার উত্তরাঞ্চলের মোরা এলাকার কিছু মানুষ তাকে সমর্থন দেয়। পরে বার্জস্লাগেন এলাকার আরও কিছু মানুষ যোগ দিলে গুস্তাভের বিপ্লবী সৈন্যসংখ্যা হাজারে দাঁড়ায়। এই বিপ্লবী ও বিদ্রোহীদের দমন করতে ক্রিস্টিয়ানা ১৫২১ সালের এপ্রিলে একদল প্রশিক্ষিত সৈন্য পাঠায়। কিন্তু গুস্তাভের বাহিনী তাদের সমূলে ধ্বংস করে। ফলে তাদের মনোবল বেড়ে যায়। এরপর একে একে বিভিন্ন এলাকার মানুষ গুস্তাভকে সমর্থন দিতে থাকে।

এরপর ক্রিস্টিয়ানার বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের ক্রমাগত চাপ বাড়তে থাকে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে যুদ্ধ হতে থাকে। এ সময় ক্রিস্টিয়ানা নিজ রাজ্যে ডেনমার্কের সরাসরি সমর্থন পায়। সেই আমলে টাকা খরচ করে বিভিন্ন দেশ থেকে সৈন্য ভাড়া করা যেত। ক্রিস্টিয়ানা ও ডেনমার্ক ক্রমাগত ভাড়া করা সৈন্য ও যুদ্ধ সরঞ্জাম জোগান দিতে এক সময় হিমশিম খেতে থাকে। এভাবে ফালুন ব্রুনব্যাক ফেরি ভাসতেরাস উপসালা ও কালমার এলাকায় একে একে বড় আকারের যুদ্ধ হয়। এসব যুদ্ধে বহু ক্ষয়ক্ষতি হলেও গুস্তাভ বাহিনীর আধিপত্য বাজায় থাকে। বিশেষত কালমার এলাকায় যুদ্ধ জয়ের মধ্য দিয়ে গুস্তাভ বাহিনী সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে যায়। কেননা এই কালমার এলাকায় জড়ো করা হয়েছিল জার্মান থেকে ভাড়া করে আনা দুর্ধর্ষ সৈনিকদের। তাদের প্রতি আদেশ ছিল আক্রমণের শিকার হলে জার্মানরা যেন এলাকায় থাকা সুইস বংশোদ্ভূত বর্জুয়া শ্রেণিকে গণহারে হত্যা করে। তাদের ঘরবাড়ি, প্রাসাদ তথা গোটা এলাকা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং বাস্তুহারাদের পাশ্ববর্তী একটি দ্বীপে পুনরায় সংঘটিত হয়। কিন্তু এই খবর আর গোপন থাকে না। ২৭ মে ১৫২৩ তারিখে আক্রমণের আগের রাতে সুইস বর্জুয়াদের এলাকা থেকে সরিয়ে তীব্র আক্রমণ চালায়। দিনব্যাপী যুদ্ধের পর সন্ধ্যায় সমগ্র কালমার গুস্তাভ বাহিনীর দখলে চলে আসে। আট দিনের মাথায় কালমার প্রসাদের পতন হয়। ফলে বাকি থাকে শুধু রাজধানী স্টকহোম দখল। এদিকে ৬ জুন ১৫২৩ তারিখে এই যুদ্ধের রূপকার ও বিপ্লবী নেতা গুস্তাভ এরিকসন ভাসা সুইডেনের নতুন রাজা নির্বাচিত হন।

স্টকহোম দখলের প্রস্তুতি হিসেবে প্রথমে শহরটিকে ঘিরে ফেলা হয়। এবং সব ধরনের সরবরাহ বন্ধ করা হয়। ফলে ডেনমার্ক থেকে উদ্ধারকারী অতিরিক্ত সৈন্য আসার যে স্বপ্ন ক্রিস্টিয়ানা দেখেছিলেন তা আর পূরণ হয়নি। অবরুদ্ধ স্টকহোমের সেনারা জার্মানিতে ফেরত যেতে চাইলে তাদের সব অস্ত্র, গোলাবারুদ ও যুদ্ধ সরঞ্জাম রেখে যাওয়ার শর্তে অনুমতি দেওয়া হয়। যুদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হওয়ায় জার্মানরা সবকিছু রেখে চলে যায়। ফলে ১৭ জুন মিড সামারস ইভ অনুষ্ঠানের পূর্বক্ষণে গুস্তাভ বিজয়ীর বেশে স্টকহোমে প্রবেশ করেন। তার রাজা নির্বাচিত হওয়ার দিনটিকে অর্থাৎ ৬ জুনকে সুইডেনের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়।

 

কিউবা ১৮৯৭ সাল

একটা সময় ছিল যখন সমগ্র পৃথিবীর এক বিরাট অংশ স্পেনের রাজাদের হুকুমে চলত। বিশেষত ‘আমেরিকাস’ নামে পরিচিত উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার ভূখন্ড তথা পৃথিবীর প্রায় সমগ্র পশ্চিমাঞ্চলেই স্পেনের রাজাদের দখলে ছিল। উত্তর আমেরিকা অঞ্চলে অবস্থিত কিউবা পঞ্চদশ শতাব্দী থেকেই স্পেনের অধীন ছিল। ১৮৯৮ সালে ‘স্পেনিশ আমেরিকান’ যুদ্ধে আমেরিকার অধিকাংশ অঞ্চল স্পেনের দখল মুক্ত হয়। এবং স্পেনের নির্বাচিত শাসকদের অপসারণ করা হয়। ফলে অনেক দেশই মুক্তির স্বাদ পায়। তবে কিউবা এবং পোর্টোরিকো থেকে স্পেন সরে গেলেও সেখানে আমেরিকার শাসন ও প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় স্পেনের সমর্থন নিয়ে গড়ে ওঠা বর্জুয়া শ্রেণির প্রভাব কমতে থাকে এবং দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘটে। বর্জুয়াদের অনেকেই তখন স্পেন ও আমেরিকায় পাড়ি জমায় এবং কিউবাকে আমেরিকার প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে বিভিন্ন বিপ্লবী সংস্থা, সংঘ এবং বিদ্রোহী বাহিনী গড়ে তোলে। অন্যদিকে স্পেন দীর্ঘদিন ধরে সেখানে থাকা তাদের নাগরিক ও সমর্থকদের নিরাপত্তার স্বার্থে কিউবায় প্রায় ২০ হাজার সৈন্য রেখে দেয় এবং স্পেন ও কিউবার প্রায় ৬০ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ দেয়।

কিউবার বামপন্থি ঘরনার বিপ্লবী নেতা জোসে মার্টিকে ১৮৭৮ সালে স্পেনে নির্বাসন দেওয়া হলেও তিনি তিন বছরের মাথায় কৌশলে আমেরিকায় প্রবেশ করেন এবং আমেরিকায় আশ্রয় নেওয়া বা নির্বাসিত হওয়া কিউবার নাগরিকদের সংগঠিত করেন। এ সময় কিউবায় অভিযানের প্রস্তুতি শুরু হয় এবং নৌযান ও অস্ত্রশস্ত্রের মজুদ গড়ে তোলা হয়। ১৮৯৫ সালের ২৫ মার্চ জোশে মার্টি কিউবাকে স্বাধীন করার জন্য পাঁচ দফা বিশিষ্ট ঘোষণাপত্র প্রকাশ ও বিতরণ করেন। এর ফলে সমগ্র কিউবায় বিপ্লবী দলও আন্দোলন গড়ে ওঠে। শুরু হয় সশস্ত্র বিপ্লব।

নৌপথে গোপনে আমেরিকা থেকে অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম আসতে থাকে। সেই সঙ্গে নির্বাসিত নেতা ও সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য প্রশিক্ষিত সামরিক কমান্ডাররাও কিউবার বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান নেয়। এই সুযোগে স্পেন পুনরায় সাম্রাজ্যবাদ ও দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য প্রায় এক লাখ সৈন্য পাঠায় কিউবায়। ১৮৯৭ সালে কিউবায় স্পেনের সৈন্যসংখ্যা বেড়ে প্রায় দুই লাখ ৪০ হাজার এবং স্বেচ্ছাসেবক তথা মিলিশিয়ার সংখ্যা ৬০ হাজারে পৌঁছে। অপরদিকে বিপ্লবীরা আমেরিকা থেকে ২৮টি জাহাজে অস্ত্র, গোলা বারুদ ও যুদ্ধ সরঞ্জাম আনার জন্য ছয়বার প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ হয়। স্পেন ও আমেরিকার নৌবাহিনী এ সময় সমুদ্র ও উপকূলীয় এলাকায় তীক্ষè নজর রাখতে থাকে। এতদসত্ত্বেও সংগঠিত হতে থাকে বিদ্রোহী ও বিপ্লবীরা। প্রথম দিকে কিছুটা ব্যর্থতা ও সমন্বয়হীনতা থাকলেও পরবর্তীতে তাদের গেরিলা যোদ্ধাদের কাছে পরাজিত হতে থাকে স্পেনের সৈন্যরা। স্পেন বনাম কিউবার বিপ্লবীদের সংগঠিত কিউবার প্রথম মুক্তিসংগ্রাম প্রচেষ্টাকে রুখে দিয়েছিলেন স্পেনের জেনারেল আরসিনিও। এ যাত্রায় বিপ্লবীরা আরসিনিও এবং তার সেনাদের পরাস্ত করে। তিন মাসের মধ্যে বিপ্লবীরা বড় বড় শহর, বন্দর ও গ্রামে স্পেনের দুর্গ, ঘাঁটি বা তাদের সমর্থকদের লোকালয় ঘেরাও করে ফেলে। এভাবে চারদিকে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে কিউবার প্রায় ১০ শতাংশ অর্থাৎ দেড় লক্ষাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। বাস্তুচ্যুত হয় প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ মানুষ। কিউবার এই সাফল্য ফিলিপাইনের স্বাধীনতা আন্দোলনে উসকে দেয়। দুটি দেশে যুদ্ধ চালাতে গিয়ে স্পেন সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে চাপের মধ্যে পড়ে। তথাপি মান-সম্মানের কথা বিবেচনা করে স্পেন যুদ্ধ চালাতে থাকে এবং টাকার বিনিময়ে কিউবা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য আমেরিকাকে গোপনে প্রস্তাব দিলে আমেরিকা তা ফিরিয়ে দেয়। একের পর এক যুদ্ধে পরাজিত হওয়ায় স্পেনের নীতিতে পরিবর্তন আসে এবং তারা কিউবায় তাদের পছন্দের সরকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু বিপ্লবীরা তা প্রত্যাখ্যান করে এবং বারটোলোমি মাসোকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা করে ১৮৯৭ সালের ১০ অক্টোবর।

১৮৯৮ সালের শুরুতে স্পেনের অনুগত একদল কিউবার নাগরিক রায়ট বা দাঙ্গা শুরু করে এবং স্পেনের মদদে এই গণহত্যা ও নির্মমতা প্রকাশকারী সংবাদপত্রের অফিস ও প্রেস জ্বালিয়ে দেয়। এতে শঙ্কিত আমেরিকার প্রতিনিধি বা রাষ্ট্রদূতের অনুরোধে ওয়াশিংটন মার্কিন রণতরী ইউএসএস মাইনিকে কিউবার উপকূলে মোতায়েন করে। ১৮৯৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এই রণতরীতে রহস্যজনক বিস্ফোরণ ঘটে। এতে প্রায় ২৬০ মার্কিন নৌসেনা নিহত হয় এবং রণতরীটি ডুবে যায়। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ম্যাক কিনলের পক্ষ থেকে শান্তি  প্রচেষ্টার উদ্যোগ নেওয়া হলেও বিপ্লবীরা তা প্রত্যাখ্যান করে। নৌ বিস্ফোরণ এবং কিউবায় থাকা মার্কিন নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বোগ প্রকাশ করে মার্কিন মিডিয়া। এতে চাপে পড়ে মার্কিন সরকার। এমনি এক প্রেক্ষাপটে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কিউবায় মার্কিন সেনা প্রেরণ এবং গৃহযুদ্ধ অবসানে প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের অনুমতি চায় তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ম্যাক কিনলে। কংগ্রেসেও তা অনুমোদন করে। ফলে মার্কিন রণতরী এবং বিপুল মার্কিন সেনার উপস্থিতি ঘটে কিউবায়। শুরু হয় স্পেনের সৈন্যদের বিরুদ্ধে মার্কিন সেনাদের সম্মুখ লড়াই। কিউবার সৈন্যরাও তখন মার্কিনিদের সঙ্গে হাত মিলায়। এতে একে একে পতন হতে থাকে স্পেনের দুর্গ ও অন্যান্য স্থাপনা। এ সময় মার্কিনিদের কাছে ফিলিপাইন ও পোর্টরিকোর নিয়ন্ত্রণও ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় স্পেন। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে স্পেন শান্তিচুক্তির প্রস্তাব করে। এক্ষেত্রে কিউবা ১৮৯৭ সালের ১০ অক্টোবর বিপ্লবী সরকার গঠন এবং গেরিলা ও সামরিক বাহিনীকে বেসরকারি প্রশাসনের অধীনস্থ করার ঘটনাকে বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা দেয়। এই ১০ অক্টোবরকে তাই কিউবার স্বাধীনতা দিবস হিসেবে গণ্য করা হয়।

 

রোমানিয়া ১৮৭৭ সাল

মূল লড়াইটা ছিল মূলত তুরস্কভিত্তিক অটোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে রাশিয়ার। রোমানিয়া তখন রাশিয়ার হয়ে লড়াই করে অটোমানদের বিরুদ্ধে। ২৪ এপ্রিল ১৮৭৭ থেকে ০৩ মার্চ ১৮৭৮ পর্যন্ত বছরব্যাপী চলা এই যুদ্ধ ইতিহাসে পরিচিতি পেয়েছে “রুশো-টার্কিস ওয়ার (১৮৭৭-৭৮)” নামে। তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যে এই যুদ্ধ শুরুর প্রাথমিক দিকে অর্থাৎ ১৬ এপ্রিল ১৮৭৭ সালে রাশিয়া ও রোমানিয়া একটি চুক্তির মাধ্যমে জোটবদ্ধ হয়। এই চুক্তি বলে রাশিয়া রোমানিয়ার নির্দিষ্ট ভূখন্ডের ওপর দেশটির পূর্ণ অধিকার স্বীকার করে নেন। বিনিময়ে রাশিয়ার সৈন্যরা রোমানিয়ার ভূখ- ব্যবহার করে তুরস্কে আক্রমণের অনুমতি পায়। প্রাথমিকভাবে রোমানিয়া তুরস্ক তথা অটোমানদের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করতে এক লাখ ২০ হাজার সৈন্য নিয়ে রোমানিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিরক্ষা বলয় তৈরি করে। ২৪ এপ্রিল ১৮৭৭ তারিখে রাশিয়া অটোমানদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শুরু করে এবং রাশিয়ার সৈন্যরা রোমানিয়া অতিক্রম করে তুরস্কে আক্রমণ চালায়। রাশিয়ার অনুরোধে রোমানিয়ার সৈন্যরাও এ সময় রাশিয়ার সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দেয়।

যুদ্ধ চলাকালেই ১০ মে ১৮৭৭ তারিখে তৎকালীন প্রিন্স কেরল (প্রথম) রোমানিয়ায় উপস্থিত হয়ে রোমনিয়ার স্বাধীনাতার বিষয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। ফলে ১০ মে তারিখটিকে রোমানিয়ার স্বাধীনতা দিবস গণ্য করা শুরু হয়। ২১ মে ১৮৮৭ তারিখে রোমানিয়ার সংসদে স্বাধীন রোমানিয়ার ঘোষণাপত্র পাস হয় এবং পরদিন প্রিন্স কেরল (প্রথম) তা স্বাক্ষর করেন। এরপর রোমানিয়া অটোমানদের বার্ষিক ৯ লাখ ১৪ হাজার মুদ্রা লিউ প্রদান স্থগিত করে। তদুপরি একই পরিমাণ মুদ্রা অটোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ব্যয় করে।

প্রথম দিকে অটোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে রাশিয়া বেশ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এ সময় রাশিয়ার সেনাপ্রধান গ্র্যান্ড ডিউক নিকোলাই নিকোলাইভিচের অনুরোধে রোমানিয়ার সৈন্যরাও রাশিয়ার সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দেয় এবং অটোমান অধিকৃত বুলগেরিয়ার প্লেভনা অঞ্চলে অবস্থিত অটোমান সৈন্যদের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। এক পর্যায়ে অটোমানদের দ্বারা সুরক্ষিত প্লেভনা অঞ্চল কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এ সময় বেশ কিছু খন্ড যুদ্ধে অটোমানরা পরাজিত হয় এবং পাল্টা আক্রমণ করতে গিয়ে ধরাশায়ী হয়। চূড়ান্ত বিচারে অটোমান সেনাপতি ওসমান পাশা দীর্ঘ অবরোধ, যুদ্ধ সরঞ্জামসহ সব ধরনের সরবরাহ বন্ধ হওয়ার প্রেক্ষাপটে আত্মসমর্পণ করেন এবং রোমানিয়া ও রাশিয়ার সম্মিলিত বাহিনীর সেনাপতি মিহাইল কেরচেজের হাতে নিজ তরবারি তুলে দেন। ১০ ডিসেম্বর ১৮৭৭ সালে রাশিয়া ও রোমানিয়া বাহিনী অটোমানদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। এই বিজয় পরবর্তীতে সার্বিয়া ও বুলগেরিয়ার স্বাধীনতা অর্জনেও বিশেষ অবদান রাখে।

 

বাংলাদেশ ১৯৭১

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার জন্য বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭, এই ১৯০ বছর বাংলাদেশের ভূখন্ড ব্রিটিশদের অধীনে ছিল। ধাপে ধাপে পরিচালিত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এ দেশের মানুষও অংশ নেয় এবং আত্মাহুতি দেয়। ১৫ আগস্ট ১৯৪৭  সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে ও ভারত এবং পাকিস্তান নামে দুটি দেশ জন্ম নেয়। ভৌগোলিক দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও কেবল ধর্মের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশকে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান নাম ধারণ করে পশ্চিম পাকিস্তানের অংশ হতে হয়। শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের ওপর প্রভুসুলভ আচরণ করে। যা চলে প্রায় ২৪ বছর (১৯৪৭ থেকে ১৯৭১)। এ সময় বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শত জেল, জুলুম ও জরিমানা সহ্য করে এবং মৃত্যুর ভয়কে উপেক্ষা করে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য বাঙালি জাতিকে প্রস্তুত করতে থাকেন। কারণ সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও পশ্চিম পাকিস্তানের কুচক্রি রাজনীতিবিদ ও সামরিক জান্তারা কখনো সমগ্র পাকিস্তান দূরে থাকা; শুধু বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তানের) শাসন বাঙালিদের হাতে ছাড়তে কখনো রাজি ছিল না। এমন কি বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে পাশে দাঁড়ানোর মতো নজরও ছিল না পশ্চিমাদের। শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধানের সব পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেস কোর্স ময়দানে ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম”। মূলত এই ঘোষণার মধ্য দিয়েই স্বাধীনতা সংগ্রামের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।

পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের কুখ্যাত ও হিংস্র অভিযান শুরু করে পশ্চিম পাকিস্তানের সৈনিকরা। সমগ্র দেশে তারা একদিকে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী ঘাঁটি, পুলিশের ব্যারাক, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস নামক সীমান্ত রক্ষীদের ব্যারাক, ছাত্রাবাস, বস্তি, তথা শহর-বন্দর গ্রামসহ সর্বত্র নির্বিচার গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতন শুরু করে। অন্যদিকে তারা বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায় এবং সব বিদেশি সাংবাদিকবে বের করে দেয়। প্রাণভয়ে এ সময় কোটি কোটি বাঙালি ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়। দেশের ভিতরে এবং ভারত থেকে তখন পাকিস্তানি ও তাদের দোসরদের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা শুরু হয়।

এপ্রিলেই বঙ্গবন্ধুর পূর্ব নির্দেশ ও পরিকল্পনা মোতাবেক প্রবাসী সরকার, মুক্তিবাহিনী ও গণমাধ্যম সৃষ্টি করা হয়। ভারত ও রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় শুরু হয় আমজনতার মধ্য থেকে মুক্তিযোদ্ধা তৈরির কাজ। পাশাপাশি সেনাবাহিনীর তিনজন মেজরের (জিয়া, সফিউল্যাহ ও খালেদ মোশাররফ) নেতৃত্বে তৈরি হয় জেড, এস ও কে ফোর্স। মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশ ভূখ-কে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে ক্রমাগত গেরিলা আক্রমণ চালাতে থাকে। এতে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দোসরদের চলাচল ও সরবরাহ ব্যবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। অন্যদিকে তিনটি ফোর্সের সৈন্যরা পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এবং অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে একই সঙ্গে গেরিলা কায়দায় আক্রমণ ও নিয়মতান্ত্রিক যুদ্ধ শুরু করে। এতে ক্রমেই শক্তি হারাতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা। বহির্বিশ্বেও ক্রমাগত প্রকাশ পেতে থাকে পশ্চিমাদের নৃশংসতা। ফলে তাদের আন্তর্জাতিক সমর্থনও সীমিত হয়ে পড়ে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন ক্রমেই বাড়তে থাকে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষে তৈরি হয় সীমিত শক্তির নৌ কমান্ডো ও বিমান বাহিনীর ছোট্ট বহর। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এ সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করতে থাকে। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলও অনুপ্রেরণা জোগায় এবং যুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে। এক কথায় মুষ্টিমেয় পাাকিস্তানি দোসর ছাড়া প্রায় পুরো জাতি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে থাকে।

৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ভারত সরাসরি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং মিত্রবাহিনী শিরোনামে ভারতীয় সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী মুক্তিযোদ্ধা ও তিনটি ফোর্সের প্রশিক্ষিত বাংলাদেশি সৈন্যদের নিয়ে বাংলাদেশে অভিযান শুরু করে। তারা ভারতের বিভিন্ন অবস্থান থেকে চারদিক থেকে বাংলাদেশে অগ্রযাত্রা শুরু করে এবং দ্রুত ঢাকা দখলের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যায়। ভারত এ সময় বাংলাদেশ আসার আকাশসীমা ও সাগরপথও অবরুদ্ধ করে দেয়। এভাবে ১৪ দিনব্যাপী প্রচন্ড যুদ্ধে একে একে পরাজিত হয় পাকিস্তানি সৈন্যরা। ফলে মিত্র বাহিনীর কাছে প্রকাশ্যে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় শক্তিশালী বাহিনী নামধারী পাকিস্তানিরা। তত দিনে প্রাণ হারায় প্রায় ৩০ লাখ বাঙালি, সম্ভ্রম হারায় প্রায় ২ লাখ নারী, হারিয়ে যায় বহু বুদ্ধিজীবী এবং ধ্বংস হয় দেশের সব অবকাঠামো। সেই শূন্য থেকে যাত্রা করা বাংলাদেশ ৫০ বছরের মাথায় আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল।

 

লেখক :  নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর