বুধবার, ১ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

মহান মে দিবস

মহান মে দিবস
ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ১৮৮৬ সালের মে মাসে আমেরিকার শিকাগো শহরের রাজপথ শ্রমিকের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। এখন শ্রমিকের অধিকার আদায়ে সহযাত্রী হয়েছে দেশ-বিদেশের অসংখ্য শ্রমিক সংগঠন। এমনই কিছু শ্রমিক সংগঠন আর মে দিবসের গোড়ার কথা লিখেছেন- মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

 

দেশে দেশে মে দিবস

বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক শ্রমদিবস উৎসাহের সঙ্গে পালিত হয়ে থাকে। দেশে দেশে শ্রমিক সংগঠনগুলো শ্রমজীবীদের সঙ্গে নিয়ে এটি পালন করে। অধিকাংশ দেশের সরকার এই দিনটির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সরকারি ছুটির দিন ও সাধারণ ছুটির দিন। আলজেরিয়ায় এ দিনটি পেইড ব্যাংক হলিডে হিসেবে পালন করে। এ দিন কাজ না করেও বেতন পান শ্রমজীবীরা। কেনিয়ায় এ দিনটি পাবলিক হলিডে। শীর্ষস্থানীয় শ্রমজীবীদের সংগঠনগুলো এদিনে দেশের শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সভা, মিছিল ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকায় মে মাসের প্রথম দিনটি সরকারি ছুটির দিন। ১৯৯৪ সাল থেকে তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে এটি পালন করে আসছে। শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে তারা কাজ করে থাকে। এ দিনটিকে কেন্দ্র করে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে শ্রমিক সংগঠনগুলো। শ্রমিকদের দেখভালের জন্য কানাডার সুনাম রয়েছে। কানাডায় শ্রমিক দিবস পালিত হয় সেপ্টেম্বরের দিকে। ১৮৯৪ সালে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড থম্পসন সেপ্টেম্বরের প্রথম সোমবার শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। সেই দিনটিকেই তারা এখনো গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে আসছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সেপ্টেম্বরের প্রথম সোমবার শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করছে। তবে ২০১২ সালের পয়লা মে ওয়াল স্ট্রিটের শ্রমজীবীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে জমায়েত হয়ে এ নিয়ে মিছিল করে। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর একটি চীন। চীনে মে মাসের প্রথম দিনটি সাধারণ ছুটি হিসেবে পালন করা হয়। ২০০৮ সালের আগে তিন দিন ছুটি পালনের রীতি থাকলেও সেটি আর টেকেনি। তারা অবশ্য পয়লা মের পরিবর্তে বছরের আরও দুটি সাধারণ ছুটির সঙ্গে মিলিয়ে এই শ্রমদিবসের ছুটি উপভোগ করে থাকে। এতে সাপ্তাহিক ছুটিও যোগ করে নেওয়া হয়।

চীনের বেশির ভাগ সরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ২৯ এপ্রিল সাধারণ ছুটি গ্রহণ করে থাকে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও যথাযোগ্য মর্যাদায় শ্রমদিবস পালন হয়ে থাকে। বেশ বড় পরিসরে ভারতের ছোট-বড় সব ধরনের শ্রমিক সংগঠন এ দিনে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও অধিকার আদায়ের বিভিন্ন দিক সভা ও মিছিলের মাধ্যমে তারা সরকারের সামনে তুলে ধরে। জাপান সরাসরি মে মাসের প্রথম দিনটি মে ডে হিসেবে ছুটি ঘোষণা না করলেও তারা শ্রমিক দিবসের ছুটি বছরের অন্য ছুটির ভিতরে যোগ করে নেয়। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন শহরের কেন্দ্রস্থলে সভা ও মিছিলের আয়োজন করে শ্রমিক অধিকার আদায় ও সুবিধা উন্নয়নের নানা দিক তুলে ধরে।                       

                                                                                                                                                                        -রকমারি ডেস্ক

 

ইতিহাসের পাতায়...

১ মে পৃথিবীর ৮০টি দেশে মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উপলক্ষে সরকারি ছুটি থাকে। এই ৮০টি দেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং স্বার্থরক্ষায় এই দিনে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়। এই দিনে শ্রমিকদের নিয়ে যারা ভাবেন, তারা স্মরণ করেন ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে ঘটে যাওয়া এক করুণ কাহিনি। তবে এই করুণ কাহিনির সূত্রপাত আরও আগে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে ইংল্যান্ডের সমাজবিজ্ঞানী ও সমাজ সংস্কারক রবার্ট ওয়েন সর্বপ্রথম শ্রমিকদের আট ঘণ্টা শ্রম, আট ঘণ্টা মনোরঞ্জন এবং আট ঘণ্টা বিশ্রামের তত্ত্ব দিয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন। কিন্তু দ্রুত শিল্পায়ন আর অধিক মুনাফার জন্য শিল্প মালিকরা শ্রমিকদের কাজের কোনো সময় বেঁধে দিতে রাজি ছিলেন না। এ সময় শ্রমিকরা সপ্তাহের ছয় দিনে দৈনিক ১০ থেকে ১৪ ঘণ্টা, এমনকি তারও বেশি সময় কাজ করতে বাধ্য হতো। তাই শ্রমিক সংগঠন এবং প্রতিবাদী শ্রমিকরা সর্বোচ্চ আট ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে ইউরোপজুড়ে আন্দোলন ছড়িয়ে দেন। শিল্পসমৃদ্ধ আমেরিকার শিকাগো শহরে ১৮৮৬ সালের এপ্রিল শেষে এই আন্দোলন প্রবল গতি লাভ করে। এর ২ বছর আগে ১৮৮৪ সালের অক্টোবরেই আমেরিকার ফেডারেশন অব অর্গানাইজড ট্রেডস অ্যান্ড লেবার ইউনিয়ন সময় বেঁধে দিয়েছিল ১ মে ১৮৮৬ তারিখের মধ্যে আট ঘণ্টা শ্রমের বিষয়টিকে মানদন্ড হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এর সমর্থনে ১ মে ১৮৮৬ আমেরিকাজুড়ে হরতাল ও বিক্ষোভ কর্মসূচি দেওয়া হয়। প্রথম তিন দিনে মিছিল আর বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে আমেরিকার শিকাগো শহর। পরদিন ৪ মে ঘটে হৃদয়বিদারক অধ্যায়। এদিন সন্ধ্যায় হালকা বৃষ্টি উপেক্ষা করে মিছিল বের করেন আন্দোলনত শ্রমিকরা। এরপর হে মার্কেট চত্বরে শুরু হয় বক্তৃতা পর্ব। ওই সময় শেষ বক্তা হিসেবে ভাষণ দেন আমেরিকার সমাজ সংস্কারক ও শ্রমিক নেতা স্যামুয়েল ফিলডেন। রাত সাড়ে ১০টায় তার বক্তৃতা শেষ হতেই এগিয়ে আসে পুলিশ বাহিনী এবং সভাস্থল ছেড়ে সবাইকে চলে যেতে হুকুম দেয়। এমনি এক মুহূর্তে পুলিশের এগিয়ে আসা পথে ঘরে তৈরি একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। এতে ঘটনাস্থলেই এক পুলিশ সদস্য নিহত হন। আহত হন আরও ৬৬ জন। যার মধ্যে ছয়জন পুলিশ সদস্য পরবর্তী সময় মারা যান। অন্যদিকে বোমা বিস্ফোরণের পর উভয়পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় শুরু হয় বলে পুলিশ দাবি করলেও ঐতিহাসিকদের মতে এ সময় পুলিশই শ্রমিকদের ওপর গুলি ছোড়ে এবং নিজেদের গুলিতেই তারা মারা যায়। মুহূর্তেই ফাঁকা হয়ে যায় হে মার্কেট চত্বর, কিন্তু রাস্তায় পড়ে থাকে শ্রমিকের রক্তাক্ত লাশ। যদিও বলা হয় এতে চারজন শ্রমিক নিহত এবং ৬০ জন আহত হন। কিন্তু প্রকৃত সত্য অনেকটাই আড়ালে ঢাকা পড়ে। কিন্তু আড়ালে থাকে না তথাকথিত বিচার কাজ। আন্দোলনকারী শতাধিক শ্রমিককে এ সময় গ্রেফতার করা হয়। এরপর শুরু হয় বিচারের পালা। বিচার শেষে জুরিবোর্ড আটজন প্রতিবাদীকে মৃত্যুদন্ড প্রদানের পক্ষে মত দিলেও বিচারক সাতজনকে মৃত্যুদন্ড এবং একজনকে ১৫ বছরের কারাদ- প্রদান করেন। উচ্চ আদালতও একই রায় বহাল রাখে। আমেরিকার অঙ্গরাজ্য ইলিনয়ের গভর্নর রিচার্ড জেমস প্রতিবাদী শ্রমিক নেতা ফিলডেন এবং স্ত্রোয়ারের মৃত্যুদন্ড মওকুফ করে ১০ নভেম্বর ১৮৮৭ যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করেন। এরপর শুরু হয় বাকি পাঁচজনের মৃত্যুর প্রহর গনার পালা। কিন্তু এ দিনই ঘটে আরেক বিষাদময় ঘটনা। লিঞ্জ নামের এক সাজাপ্রাপ্ত বিপ্লবী শ্রমিক কৌশলে চুরুট বা মোটা সিগারেটের মতো দেখতে বিশেষ ধরনের হাতে তৈরি বোমা (ব্লাস্টিং ক্যাপ) সংগ্রহ করেন। চুরুটের মতোই তা মুখে পুরে তিনি এতে বিস্ফোরণ ঘটান। মুহূর্তেই লিঞ্জের মুখের বিরাট অংশ আলগা হয়ে খসে পড়ে। তারপরও ছয় ঘণ্টা বেঁচে ছিলেন বিপ্লবী শ্রমিক লিঞ্জ।

পরদিন ১১ নভেম্বর ১৮৮৭ অবশিষ্ট চার বিপ্লবী শ্রমিক এঞ্জেল, ফিসার, পারসন্স এবং স্পাইসকে নেওয়া হয় ফাঁসির মঞ্চে। ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগুতে এগুতে তারা শ্রমিকদের অধিকারের কথা নিয়ে রচিত গণসংগীত ও বিপ্লবী গান গেয়ে যান। ফাঁসিতে ঝোলানোর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে স্পাইস বলে যান, ‘এমন একদিন আসবে যেদিন আমাদের নীরবতা (মৃত্যু) তোমরা যে কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে চাও, তার চেয়েও শক্তিশালী হবে।’ বৃথা যায়নি সংশপ্তক শ্রমিক নেতা স্পাইসের গর্জন। বিশ্বে আজ শ্রমিকের আট ঘণ্টা শ্রমের দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশে দেশে ১ মে স্মরণ করা হয় হে মার্কেটের বীর সেই শ্রমিকদের।

 

 

শ্রমজীবীদের সংগঠন

 

ডব্লিউআরসি

ডব্লিউআরসি হচ্ছে ওয়ার্কার্স রাইট কনসোর্টিয়াম। ২০০১ সাল থেকে সব শ্রমিক বিশেষত পোশাক শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে আসে নতুন সংগঠন ওয়ার্কার্স রাইট কনসোর্র্টিয়াম (ডব্লিউআরসি)। এই সংগঠনের উদ্যোক্তা আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের ইউনিফর্ম বা পোশাক আসে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে। অথচ ছাত্রছাত্রীরা জানত না তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লোগো বসিয়ে যে পোশাক গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রিগুলো তৈরি করে, কেমন আছে এসব গার্মেন্টের শ্রমিকরা। তাই ডব্লিউআরসি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রমিকদের মধ্যে যারা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পোশাকসহ অন্যান্য সামগ্রী তৈরি করে, তাদের অবস্থা অনুসন্ধান ও প্রকাশ, কারখানায় যে কোনো শোষণ বা অন্যায় বন্ধ করা এবং শ্রমিক সংগঠন করার অধিকার নিশ্চিত করে থাকে। সংগঠনের অন্যান্য কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে বাধ্যতামূলকভাবে অতিরিক্ত শ্রম বা ওভারটাইম রোধ করা, শিশুশ্রম বন্ধ করা, কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ দূর করা, নিরাপদ কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করা ইত্যাদি। সংগঠনটি নিয়মিতভাবে বিভিন্ন ফ্যাক্টরির ওপর প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। যেসব ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকদের ওপর অবিচার করা হয়, তাদের পণ্য কোনো ব্র্যান্ড শপ বা ইউরোপে বাজারজাত রোধ করতেও ভূমিকা রাখে ডব্লিউআরসি। বর্তমানে ইউরোপের দুই শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাংগঠনিক তৎপরতা রয়েছে। সংগঠনটির ওয়েবসাইট খুললেই পাওয়া যায় বাংলাদেশের পোশাক শিল্প কারখানায় সংঘটিত দুর্ঘটনার ছবি ও রিপোর্ট।

 

সিসিসি

সিসিসি হচ্ছে ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন। ১৯৮৯ সালের কথা। নেদারল্যান্ডসের ঝলমলে মার্কেট, সুপার শপ, মেগাশপ আর ব্যান্ডেড শপের মালিকরা জানতেন না কোথায় কি পরিবেশে তৈরি হচ্ছে তাদের দোকানের বাহারি সব পোশাক। এমনি এক প্রেক্ষাপটে ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইনের (সিসিসি) জম্ম। এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য নারী শ্রমিক অধ্যুষিত গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে কাজের পরিবেশ উন্নয়ন, শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন এবং শ্রমিকদের ওপর যে কোনো ধরনের অন্যায় প্রতিহত করা। বিভিন্ন দেশে ভোক্তা সংগঠন, নারী সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, মানবাধিকার সংগঠন এবং এনজিওদের নিয়ে এক প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে কাজ করে সিসিসি। এ ধরনের প্রায় ৩০০টি সংগঠন বর্তমানে সিসিসির সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে সংগঠনটি ক্রেতা বা ভোক্তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে দৃষ্টি দিয়েছে। এর মধ্য দিয়েই তাদের মূল লক্ষ্য অর্থাৎ পোশাক কারখানায় নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি এবং যে কোনো অন্যায় রোধে সচেষ্ট রয়েছে সিসিসি।

 

আইএলও

আইএলও হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্র্গানাইজেশন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে ১৯১৯ সালে ভার্সাইল চুক্তি অনুসারে। এই চুক্তির অংশ হিসেবেই ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) জম্মলাভ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বনেতারা অনুধাবন করেন সত্যিকারের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি। আর সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো শ্রমিক। সুতরাং শ্রমিকরা যদি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়, তবে সমাজে শান্তির পরিবর্তে সংঘাত আসতে বাধ্য। এই অনুধাবন থেকেই জম্ম নেয় লিগ অব ন্যাশনস যা পরবর্তীতে বর্তমান জাতিসংঘে রূপ নেয়। আর লিগ অব ন্যাশনস তথা জাতিসংঘের একটি এজেন্সি হিসেবে এগিয়ে চলেছে আইএলও। জাতিসংঘের প্রায় সবকটি সদস্য দেশ আইএলওর সদস্য। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় আইএলওর সদর দফতর অবস্থিত। জাতিসংঘের অন্যান্য অঙ্গ সংগঠন থেকে আইএলওর সাংগঠনিক কাঠামো কিছুটা ভিন্ন। সরকার, মালিক এবং শ্রমিক শ্রেণির প্রতিনিধি দ্বারা আইএলও পরিচালিত হয়। বর্তমানে আইএলও শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় নানা ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তৎপরতার মধ্যে রয়েছে দৈনিক ও সাপ্তাহিক সর্বোচ্চ কাজের সময় নির্ধারণ, ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা, যে কোনো বিপদ থেকে শ্রমিকদের রক্ষা করা, শিশু-কিশোর ও নারী শ্রমিকদের সুরক্ষা, প্রবাসী শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা, মজুরির ক্ষেত্রে সমতা বিধান, শ্রমিক সংগঠন করার অধিকার নিশ্চিত করা এবং কর্মমুখী ও কারিগরি প্রশিক্ষণে সহায়তা করা ইত্যাদি। জম্মলগ্ন থেকেই আইএলওকে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। অনেক দেশের সরকারই আইএলওর কর্মপরিধি ও এখতিয়ারের সীমারেখা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। অনেকেই আইএলওর নির্দেশনা বা পরামর্শ মেনে চলাকে অত্যন্ত ব্যয়বহুল মনে করেন। মাঝে মামলা-মোকদ্দমাও কম হয়নি। এমনকি ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস পর্যন্ত গড়ায় কোনো কোনো বিষয়। তবে কোনো কিছুই দমিয়ে রাখতে পারেনি আইএলওর অগ্রযাত্রাকে। জেনেভার সদর দফতরে গবেষণা ও প্রকাশনা কেন্দ্র থেকে শ্রমিক স্বার্থরক্ষা ও  শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিপুলসংখ্যক বই, লিফলেট, পোস্টার, গবেষণাপত্র, প্রতিবেদন ইত্যাদি প্রকাশিত হয়। সরেজমিন কাজ করার জন্য রয়েছে আঞ্চলিক কেন্দ্র এবং দেশে দেশে রয়েছে কান্ট্রি অফিস। শ্রমিক স্বার্থরক্ষায় আইএলও আজ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান। শ্রেণিসংঘাত ঘুচিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা, শ্রমিকদের ন্যায্যবিচার নিশ্চিত করা এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কারিগরি সহায়তা প্রদানের জন্য ১৯৬৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করে আইএলও।

 

এফডব্লিউএফ

এফডব্লিউএফ হচ্ছে ফেয়ার ওয়্যার ফাউন্ডেশন। ফেয়ার ওয়্যার ফাউন্ডেশন (এফডব্লিউএফ) নেদারল্যান্ডসভিত্তিক একটি স্বাধীন অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন। এই সংগঠনটি কোম্পানি এবং পোশাক তৈরির কারখানাগুলোকে পোশাক শ্রমিকদের জন্য উন্নত কাজের পরিবেশ সৃষ্টিতে এই সংগঠনের সঙ্গে সংযুক্ত বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থিত ৮০টি সদস্য কোম্পানি ১২০টি ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরি করে। আর ৮০টিরও বেশি দেশের ২০ হাজার আউটলেট বা দোকানে বিক্রি হয় এই পোশাক। এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকার ১৫টি তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী দেশে এফডব্লিউরএফের কার্যক্রম বিস্তৃত। মূলত পোশাক তৈরি কারখানাগুলো শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা ও কল্যাণে যে পদক্ষেপ নেয়, তা বেগবান ও শক্তিশালী করতে সচেষ্ট এফডব্লিউএফ। এই লক্ষ্যে আট ধারা বা কোড অব কন্ডাক্ট নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন : স্বেচ্ছায় চাকরিতে যোগদান, বৈষম্যহীন চাকরি, শিশুশ্রম বন্ধ করা, সংগঠন করার অধিকার, ন্যায্য ন্যূনতম মজুরি, অতিরিক্ত পরিশ্রম রোধ, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি এবং আইনসম্মতভাবে শ্রমিকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক সৃষ্টি ইত্যাদি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের একাধিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে এফডব্লিউএফ পোশাক শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। সাভারের রানা প্লাজায় ধস এবং পোশাক শ্রমিকদের ক্ষয়ক্ষতিতে তাদের ওয়েবসাইটে দুঃখ ও সমবেদনা জানিয়েছে এফডব্লিউএফ।

 

বিআইএলএস

বিআইএলএস হচ্ছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ। ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ বা বিলস নামে বেশি পরিচিত। শ্রমিক এবং শ্রমিক সংগঠনগুলোকে সহায়তা করা এবং তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় সদা সচেষ্ট থাকে বিলস। বর্তমানে দেশের ১৩টি প্রধান শ্রমিক সংগঠন বিলসের সঙ্গে জড়িত। বিলস বিশ্বাস করে, ন্যায়ভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় শ্রমিক সংগঠনগুলোকে সক্ষম করে তোলা প্রয়োজন। যাতে তারা এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখতে পারে। এই লক্ষ্যে পরিচালিত বিলসের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে প্রশিক্ষণ, গবেষণা, তথ্য আদান-প্রদান ও শ্রমিকের অধিকার রক্ষা। বিলস একদিকে ন্যায়সঙ্গত এবং শ্রমিকবান্ধব নীতি প্রণয়নে সরকারকে সহায়তা করে, অন্যদিকে ট্রেড ইউনিয়গুলোর সঙ্গে সুশীল সমাজ ও সরকারের সেতুবন্ধ রচনায় সহায়তা করে। দেশ-বিদেশের একাধিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় বিলসের কার্যক্রম বা প্রকল্প পরিচালিত হয়। এসব প্রকল্পের মধ্যে ডেনমার্কের এলওএফটিএফ-এর সহায়তায় মানবসম্পদ উন্নয়ন ও নীতি-নির্ধারণে সহায়তাভিত্তিক প্রকল্প, যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইউলিসনের সহায়তায় সমাজের ব্যাপক অংশকে ট্রেড ইউনিয়নের আওতায় আনা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারিকরণ রোধ প্রকল্প ইতাদি। এছাড়াও ভিন্ন ভিন্নভাবে পোশাক শ্রমিক, চিংড়ি ঘেরের শ্রমিক, গৃহ শ্রমিক, নারী শ্রমিক, শিশু শ্রমিকদের জন্য বিলসের মাধ্যমে প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে। আর সব ক্ষেত্রে বিলসের পাশে রয়েছে বিদেশি একাধিক দূতাবাস ও সাহায্য সংস্থা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর