রবিবার, ১৪ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

সাদ্দামের উত্থান-পতন

তানভীর আহমেদ

সাদ্দামের উত্থান-পতন

ইরাকের ২৪ বছরের শাসক

ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের জš§ উত্তর-ইরাকের তিকরিত শহরের আউজা এলাকায়। তার শৈশব খুব সাজানো ছিল না। জšে§র পর বাবা নিরুদ্দেশ হলেন। তার মা আবার বিয়ে করেন। সৎ বাবার ঘরে সাদ্দামের জীবন সুখকর ছিল না। সাদ্দাম এরপর বাগদাদে তার মামার বাড়িতে বেড়ে ওঠেন। রাজনীতিতে তিনি সক্রিয় হন তার মামার সূত্র ধরে। সাদ্দামের মামা বাথ পার্টির সক্রিয় নেতা ছিলেন। ১৯৫৭ সালের কথা। তখন সাদ্দামের বয়স মাত্র ২০ বছর। এই তরুণ বয়সেই তিনি বাথ পার্টির সদস্য হন। দলে তার অংশগ্রহণ ও কর্মপরিধি বাড়তে থাকে। ১৯৬৩ সালে বাথ পার্টি সরকার উৎখাত করে ক্ষমতা গ্রহণ করে। তবে সেটি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৬৮ সালে বাথ পার্টি আবার ক্ষমতা দখল করে। এটি সাদ্দামের জন্য মাইলফলক ছিল। কারণ  সেবার সাদ্দামকে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর ১৯৭৯ সালে ইরাকের প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করলে সাদ্দাম প্রেসিডেন্টের কার্যভার গ্রহণ করেন। ইরাকের ভাগ্য লেখার মানসে ক্ষমতায় বসেন তিনি। তার শাসনামলে ইরাকের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়। সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নতি ঘটে। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত সাদ্দামের নেতৃত্বে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালিত হয়। ইরানের বিরুদ্ধে প্রায় নয় বছর দীর্ঘস্থায়ী এ যুদ্ধে উভয় দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়। এই যুদ্ধে কোনো দেশই চূড়ান্ত সফলতা পায়নি। ইরাক-ইরান যুদ্ধে ইরাককে পেছন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব ইন্ধন জুগিয়েছিল। এই যুদ্ধে সাদ্দামের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। অভিযোগটি ছিল ১৯৮৮ সালে কুর্দি শহর হালাফজায় অভিযান পরিচালনা করে কুর্দিদের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে পাঁচ হাজার কুর্দির মৃত্যু ঘটান। এরপর সময়ের পালাবদলে সাদ্দাম ১৯৯০ সালে কুয়েত দখল করে নেন। এবার দাবার দান উল্টে যায়।  যুক্তরাষ্ট্র কুয়েতের পক্ষ নেয়। কারণ আর কিছুই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করে সামরিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ হাসিল। যুক্তরাষ্ট্রের জমজমাট অস্ত্রবাণিজ্যের কথা কে না জানে। ইরাক-কুয়েত যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনী কুয়েতের পক্ষে প্রত্যক্ষ অংশ নিলে ইরাক পরাজিত হয়। এ যুদ্ধ-পরবর্তী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধকালীন প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশ কুয়েত সফরে এলে তাকে বীরোচিত সংবর্ধনা দেওয়া হয় এবং বিপুল অঙ্কের অর্থের উপহারসামগ্রী দেওয়া হয়। ইরাকের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর চেষ্টা সবার সামনে চলে আসে। ইরাকের কাছে ব্যাপক মানববিধ্বংসী রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্র রয়েছে এমন মিথ্যা অভিযোগ দাঁড় করায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। তাদের নেতৃত্বাধীন বাহিনী ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে সাদ্দামের বাহিনী পরাজিত হয়। সাদ্দাম আত্মগোপনে চলে যান। ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন সেনারা সাদ্দামের নিজ শহর তিকরিত থেকে তাকে আটক করে। সাদ্দামকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। বিশেষ আদালতে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়, তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছে অভিযোগে তিনি ১৯৮২ সালে ১৪৮ নাগরিককে ফাঁসি দিয়েছিলেন।

 

ফিরদৌস চত্বরে শুধুই শূন্যতা

২০০২ সালের এপ্রিল মাসে সাদ্দামের ৬৫তম জন্মদিনে বাগদাদ নগরীর ফিরদৌস চত্বরে ভিড় করেছিল তার ভক্তরা। ইরাকিরা আনন্দ উদপাযন করেছিল এখানেই। কারণ আর কিছুই নয়, সেদিন উন্মোচিত হয় সাদ্দামের ৩৯ ফুট উঁচু ব্রোঞ্জের মূর্তি। কংক্রিটের স্তম্বের ওপর দাঁড়ানো ওই মূর্তি ছিল সাদ্দামের শৌর্য আর অহংকারেরই প্রতীক। ইরাক আর সাদ্দাম দুই-ই যেন একাকার। সময় আর ক্ষমতার পালাবদল প্রকৃতি যখন ঘটাতে থাকে সেটা অনেকেই  টের পায় না। সাদ্দামও পাননি। দাবার দান যখন উল্টে গেল তখন বিদ্রোহী জনতাকে উসকে দিল যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন। ইরাকে মার্কিন সেনারা এলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে। গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হলে সাদ্দামের অনুগতরাও ভোল পাল্টে ফেলল। ইরাকে স্বাধীনতা চাই রব উঠল। সেটাকেই কাজে লাগালেন মার্কিন সেনারা। ফিরদৌস চত্বরে মাত্র এক বছর আগে যেখানে সাদ্দামের মূর্তি দেখে মানুষ উল্লাস করেছিল সেখানেই ক্ষোভ নিয়ে জড়ো হলো ভাড়াটে জনতা। ইরাকের বহু সাধারণ নাগরিকও তাদের সঙ্গ দিল। একটু দূরেই এক হোটেলে এসেছিলেন আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোর পক্ষ থেকে সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদকিরা। রবার্ট ফিস্কের ভাষায়, ইতিহাসের দ্বিতীয় সেরা সাজানো ফটোগ্রাফির আয়োজন ছিল এখানে। ইরাকি জনতার একাংশ সাদ্দামের মূর্তি ভাঙতে উদ্যত হলো। মার্কিন সেনারা উত্তেজিত জনতার মাঝেই মূর্তির কাছে পৌঁছান। মেরিন করপোরাল এডওয়ার্ড চিন মই দিয়ে উঠে সাদ্দামের মূর্তির মুখ আমেরিকার পতাকা দিয়ে ঢেকে দেন। তখনই শুরু হয় শোরগোল। পক্ষে-বিপক্ষে ভাগ হয়ে জনতারা হইচই শুরু করলেও মার্কিন সেনাদের অস্ত্রের মুখে তা খুব একটা কাজে লাগেনি। তবু এক ইরাকি মহিলা চিৎকার করে বলেছিল, মার্কিন পতাকা সরাও, ইরাকি পতাকা দিয়ে ঢাকো। সে কথা কেউ কানে তোলেনি। সবার সামনেই লোহার শেকল দিয়ে টেনে মাটিতে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় সাদ্দামের মূর্তি। মূর্তি মাটিতে গুঁড়িয়ে পড়ার পরই বিশ্ববাসী দেখল মার্কিন সেনাদের আসল চেহারা। সাজানো অভিযোগ আর নাটক দিয়েই সাদ্দামের পতন হলো। তবে ইরাকি জনগণকে যে স্বাধীনতার স্বাদ ও গণতন্ত্রের সুবাতাস বইয়ে দেওয়ার স্বপ্ন তারা দেখিয়েছিল তা ছিল পুরোটাই ধোঁকা। এক মাসের ব্যবধানে ফিরদৌস চত্বরে তৈরি হলো এক ইরাকি পরিবারের মূর্তি, তারা ইসলামী শাসনে স্বাধীনতার আনন্দে ডুবে আছে- এমন মূর্তি স্রেফ সিমেন্ট, বালুতেই গড়তে পারল মার্কিনিরা। আদতে নির্যাতন, দুর্নীতি আর দারিদ্র্যতায় ইরাক ডুবল। জঙ্গি সংগঠনগুলো দুর্বিষহ করে তুলল ইরাকিদের জীবন।

 

যুক্তরাষ্ট্রের তেল আর অস্ত্র ব্যবসায় পুড়ল ইরাক

মধ্যপ্রাচ্যের তেলের দিকে নজর যুক্তরাষ্ট্রের বহু আগে থেকেই। বিশ্ব চলে তেলের দামে। তেল অর্থনীতি চালায়। বিশ্বের প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর একটি ইরাক। খুব সহজ অঙ্ক, ইরাক-ইরান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের পক্ষ নিয়ে লড়েছিল। তখন ইরাক-যুক্তরাষ্ট্র গলায় গলায় ভাব। কিন্তু সেই বন্ধুত্বে ফাটল ধরল যখন সাদ্দাম হোসেন তার দেশের তেল দেশের উন্নয়নেই লাগাতে চাইলেন। ইরাকের তেল শুধু নিজের দেশের জন্য নয়, মধ্যপ্রাচ্যে জাতীয়করণের মাধ্যমে সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে ছিলেন সাদ্দাম। তখনই বাধল ঝামেলা। ইরাককে অস্থিতিশীল করতে কুয়েত-ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি চেহারা বদলে ফেলল। কুয়েতের পক্ষ নিল যুক্তরাষ্ট্র। তেলের জন্যই যুক্তরাষ্ট্রের এই খেলাটা টের পেয়ে যান সাদ্দাম। যুক্তরাষ্ট্রও সেটা আর গোপন করেনি। কুয়েত যুদ্ধে ইরাক পরাজিত হলে সাদ্দামের বিদায়ঘণ্টা বাজানোই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। পাশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে  গৃহযুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদ ছড়ালে তাদের অস্ত্র ব্যবসাটাও জমে ওঠে। বিশ্বের এক নম্বর অস্ত্র তৈরি ও বিক্রির দেশটির জন্য তাই স্বাধীনতা, গণতন্ত্র আর শান্তিরক্ষার জন্য আগ্রাসন সব একই কথা। মধ্যপ্রাচ্যে তেল জাতীয়করণের পেছনে সাদ্দামের অবদান অনেক। তিনিই প্রথম তেল জাতীয়করণ করেছিলেন এবং একই পথ ধরে বাকি আরব রাষ্ট্রগুলোও তেল জাতীয়করণ করে। ফলাফলে তেল থেকে প্রাপ্ত মুনাফা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নিজেরাই ব্যবহার করতে পারছে এবং অবকাঠামো গড়ে তুলছে। তবে তেলের এই রমরমা বাজারের প্রথম সারির ক্রেতা পশ্চিমারা। যে কারণে তেলের বাজারে হস্তক্ষেপ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে তারা। মধ্যপ্রাচ্যের এই দামি তেলের দখল নেওয়া ও রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ানো, দুইয়ে দুইয়ে চার হয়ে যায়। সে বাজার দখলে পথে অন্যতম বাধা ছিলেন সাদ্দাম হোসেন। তাছাড়া ইরাক-কুয়েত যুদ্ধে বেসামরিক ইরাকি নিহত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এই সাফল্যও ইরাক আগ্রাসনে মার্কিনিদের উৎসাহিত করে। ইরাক জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মার্কিন সেনারা সাদ্দামের পতন ঘটায়। অনেকেই বলেন, তাদের কী লাভ? লাভ এটাই, শেষ পর্যন্ত ইরাকিদের প্রাণের বিনিময়ে মধ্যপ্রাচ্যের তেল ও রাজনৈতিক প্রভাব দুটিই হাসিল করে তারা।

 

সাদ্দামের ফাঁসিতে কেঁদেছিল মার্কিন সেনারা

জীবনের শেষ দিনগুলোতে তাকে পাহারা দিয়েছিলেন ১২ জন মার্কিন   সেনা; যারা সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসির সময় কেঁদেছিলেন। এমনকি এদের একজন পরে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। তারা দাবি করেন, গ্রেফতার হওয়ার পর তারা এক পর্যায়ে সাদ্দাম হোসেনের বন্ধু হয়ে ওঠেন। তারাই ছিলেন সাদ্দামের একমাত্র সঙ্গী। মার্কিন ৫৫১ নম্বর মিলিটারি পুলিশ কোম্পানির ওই ১২ জন সেনা সদস্যকে  ‘সুপার টুয়েলভ’ বলে ডাকা হতো।

তাদেরই একজন, উইল বার্ডেনওয়ার্পার একটি বই লিখেছেন, ‘দ্য প্রিজনার ইন হিজ প্যালেস, হিজ অ্যামেরিকান গার্ডস, অ্যান্ড হোয়াট হিস্ট্রি লেফট আনসেইড’ নামে। বাংলা করলে বইটির নাম হতে পারে- নিজের প্রাসাদেই এক বন্দী, তার আমেরিকান প্রহরী, ইতিহাস যে কথা বলেনি। বার্ডেনওয়ার্পার স্বীকার করেছেন যে, তারা যখন সাদ্দাম হোসেনকে জল্লাদদের হাতে তুলে দিলেন ফাঁসির জন্য, তখন তাদের ১২ জনেরই চোখে পানি এসে গিয়েছিল। প্রহরীদেরই একজন, অ্যাডাম রজারসন উইল বার্ডেনওয়ার্পারকে বলেছিলেন, সাদ্দামের ফাঁসি হয়ে যাওয়ার পরে আমার মনে হচ্ছে আমরা ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। নিজেদেরই এখন তার হত্যাকারী বলে মনে হচ্ছে। এমন একজনকে মেরে  ফেললাম আমরা, তিনি  যেন আমাদের খুব আপনজন ছিলেন।

সাদ্দামের ফাঁসির পরে যখন তার মরদেহ বাইরে নিয়ে আসা হয়েছিল, তখন সেখানে জমা হওয়া লোকজন মৃতদেহের ওপরে থুতু ছিটিয়েছিল। ওই ঘটনা দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল আমেরিকান সেনারা। বার্ডেনওয়ার্পার লিখছেন, ওই নোংরামি দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন তারা সবাই, বিশেষ করে যে ১২ জন তার  শেষ সময়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। তাদেরই মধ্যে একজন ওখানে জমা হওয়া লোকজনের কাছে হাতজোড় করে তাদের থামাতে চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু দলের বাকিরা তাকে টেনে সরিয়ে নেয়। ওই ১২ জনের অন্যতম স্টিভ হাচিনসন সাদ্দামের ফাঁসির পরেই আমেরিকার  সেনাবাহিনী থেকে ইস্তফা দেন। বইটিতে আরও লেখা হয়েছে, ফাঁসির কয়েক মিনিট আগে স্টিভ হাচিনসনকে কারাকক্ষের বাইরে ডেকে াঠান সাদ্দাম হোসেন। লোহার শিকগুলোর মধ্য দিয়ে হাতটা বের করে নিজের হাতঘড়িটা দিয়ে দেন স্টিভকে। হাচিনসন আপত্তি করেছিলেন। তবে সাদ্দাম কিছুটা জোর করেই ঘড়িটা স্টিভের হাতে পরিয়ে দেন।                                                                                               

 

আদালতে কী বলেছিলেন সাদ্দাম

সাদ্দাম হোসেন বিভিন্ন সময় বিচারকের সামনে যেসব জবাব দিয়েছিলেন তারই কিছু অংশ-

আমি সাদ্দাম হোসেন আল মাজিদ, প্রেসিডেন্ট অব ইরাক। আপনাকে (বিচারককে) একজন ইরাকি ধরে আমি কথা বলছি। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমি ইরাকের প্রেসিডেন্ট ছিলাম যখন কুয়েতে আক্রমণ চালানো হয়। দুঃখজনকভাবে একজন ইরাকির থেকেই আমার ওপর এই অভিযোগ আসল, এটা কি ন্যায়বিচার হলো? সেই কুয়েত যারা বলেছিল, সব ইরাকি মেয়েদের রাস্তার দশ দিনারের পতিতা বানাবে। আমি ইরাকের সম্মান রক্ষা করেছি এবং কুয়েতের ওপর ইরাকের ঐতিহাসিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি।

... কোন সংবিধান দ্বারা আমার বিচার হবে, যে সংবিধান সাদ্দাম হোসেন সাইন করেছিল, নাকি সেই সংবিধান যা আমেরিকানদের দ্বারা লিখিত?

... তারা মিথ্যাবাদী। তারা ঘোষণা দিল, আমাদের দেশে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে। এখন বলছে তারা পায়নি। কিন্তু সাদ্দাম মিথ্যা বলে নাই, আমি এখনো আমাকে করা আঘাতের চিহ্ন দেখাতে পারি। ইরাক কখনই মিথ্যাবাদীদের গ্রহণ করেনি, আজও করব না।

 

শেষ দিনগুলো তার যেভাবে গেল

সাদ্দাম বাগদাদের কারাগারে বন্দী থাকাকালীন জীবনের শেষ দিনগুলোতে নানা কাজে সময় পার করেছিলেন। তিনি কারাগারের বাগানে সময় দিতেন, কখনো কখনো মাফিন খেতেন, কখনো বা রেডিওতে মেরিজে ব্লিজের গান শুনে কাটিয়েছিলেন। তিনি আমেরিকান শিল্পীদের পারিবারিক ব্যাপার নিয়ে গাওয়া গানগুলো শুনতে পছন্দ করতেন। কারাগারে তার নিরাপত্তায় থাকা ১২ সেনার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল। তাদের সঙ্গেই নানা বিষয়ে আড্ডা দিতেন তিনি। সেই সেনা সদস্যরা তাকে ভদ্রলোক ও নরম মনের মানুষ বলে আখ্যা দেন। কারাগারের বাগান তার প্রিয় জায়গা ছিল। বিচার চলাকালীন তিনি আদালতে যে কয়েকবার আত্মপক্ষ সমর্থন করেছিলেন প্রতিবারই দরাজ কণ্ঠে কথা বলেন। তিনি নিজেকে সব সময়ই নির্দোষ এবং আদালত ও বিচারের ওপর অনাস্থার কথা জানিয়েছিলেন। তাকে কথা বলার সময় প্রায়ই থামিয়ে দেওয়া হতো। আদালতে তাই বেশিরভাগ সময়ই শ্রোতা হয়ে থাকতে হয়েছিল তাকে। স্পষ্টভাষী সাদ্দাম হোসেন ফাঁসির আগেও নিজেকে নির্দোষ ও মার্কিনিদের সাজানো অভিযোগের কথা বলে যান।

 

পশ্চিমাদের ত্রাস

সাদ্দাম হোসেন। ইরাকের সাবেক রাষ্ট্রপতি। এ পরিচয়ের চেয়ে বড় ছিল- তিনি পশ্চিমাদের ত্রাস। বলা হয়ে থাকে, পশ্চিমা বিশ্বের পাতানো ফাঁদে প্রাণপ্রদীপ নিভেছে তার। সাদ্দাম জুলাই ১৬, ১৯৭৯ থেকে এপ্রিল ৯, ২০০৩ পর্যন্ত ইরাকের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ইরাকের রাষ্ট্রপতি ও বাথ পার্টির প্রধান হিসেবে সাদ্দাম হোসেন আরব জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষ ও আধুনিক ইরাক গড়ে তোলার পথে পা বাড়ান। সাদ্দাম একদলীয় শাসন কায়েম করেন, যা ভালোভাবে নেয়নি সভ্যরাষ্ট্রগুলো। সাদ্দাম ইরানের সঙ্গে ৯ বছরের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন।

এরপর ১৯৯১ সালে সাদ্দাম উপসাগরীয় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। সাদ্দাম ইরাকের স্থিতিশীলতার বিরোধী সব পক্ষকে নির্মূল করার উদ্যোগ নেন। ইরাকি শিয়া মুসলমান, কুর্দি ও ইরাকি তুর্কি জনগণ এর বিরোধিতা করে স্বাধীনতা দাবি করে। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করে। সাদ্দাম ব্যাপক ধ্বংসাত্মক জীবাণু অস্ত্র তৈরি করছেন এই অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ইরাকে আগ্রাসন ঘটায়। কিন্তু তাদের এই অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন ছিল। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এমন কোনো অস্ত্রের সন্ধান পাওয়া যায়নি। ১৩ ডিসেম্বর ২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেন আমেরিকান সেনাদের কাছে ধরা পড়ে। পরে আমেরিকা ইরাকি সরকারের হাতে সাদ্দাম হোসেনের বিচার করে। সাদ্দামের বিরুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার করা হয়। তিনি মৃত্যুদ-প্রাপ্ত হন। ২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ইরাকি সময় সকাল ৬টা ৬ মিনিটে তার ফাঁসি কার্যকর হয়।

 

সেই প্রাসাদ এখন জাদুঘর

সাদ্দাম ইরাক শাসন করেছিলেন ২৪ বছর। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করার জন্য তিনি যেমন আলোচিত ছিলেন তেমনি সমালোচিত ছিলেন বিলাসী খরচের জন্য। ২৪ বছরে তিনি ৭০টিরও বেশি প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। বিলাসী আয়োজনে একেকটি প্রাসাদ ছিল একটির চেয়ে আরেকটি স্বপ্নপুরি। বড় প্রাসাদগুলোর মধ্যে বসরার প্রাসাদটি ঘিরে সবেচেয়ে বেশি আলোচনা ছিল। সেই প্রাসাদটি এখন জাদুঘরে পরিণত করা হয়েছে এবং খুলে দেওয়া হয়েছে জনসাধারণের জন্য। ইরাকের ইতিহাস এমনিতেই সমৃদ্ধ। সেই ঐতিহ্যের ধারক বহু প্রত্নসামগ্রী রাখা হয়েছে এই প্রাসাদে। বসরায় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এবং জাদুঘর প্রকল্পের পরিচালক কাহ্তান আল-ওবেইদ এই প্রাসাদটিকে জাদুঘর বানানোর পরিকল্পনা করেন। তবে যুদ্ধের কারণে প্রাসাদটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী যখন বসরায় মোতায়েন ছিল তখন এই প্রাসাদটিকে তারা ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু জাদুঘর তৈরির জন্য সেখানে ব্যাপক সংস্কার কাজ শুরু হয়। প্রায় তিন বছর ধরে প্রাসাদটি সংস্কার শেষে জনগণের জন্য খুলে  দেওয়া হয়। সাদ্দামের অন্য প্রাসাদগুলোও বিভিন্ন সরকারি কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। নেই সেই আগের বিলাসী জাঁকজমক।

 

ধুলায় মিশে গেছে সাদ্দামের কবর

সাদ্দামের কবর নিয়ে রয়েছে রহস্য। ফাঁসি কার্যকরের পর সাদ্দামকে দাফন করা হয়েছিল তার নিজ গ্রাম আল-আওজাহতে। ইরাকি শিয়া মিলিশিয়া বাহিনী সেখানে হামলা করে পুরো কবর ধসিয়ে দেয়। এই ঘটনার পর পরই কিছু আন্তর্জাতিক মিডিয়া দাবি করে, সাদ্দামের মৃতদেহ এর আগেই কবর থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তবে কোথায় সরিয়ে ফেলা হয়েছে সেটা পুরোপুরি গোপন রাখা হয়। এক পক্ষ ধারণা করেন, কবর ধসিয়ে দেওয়ার আগেই তার দেহ জর্ডানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তবে এসব ধারণা বেশিরভাগই কল্পনাপ্রসূত বলেই মনে করা হয়। এর পক্ষে জোরালো কোনো প্রমাণ কেউ দেখাতে পারেনি। তবে সাদ্দামের কবরকে ঘিরে যে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছিল তা পুরোপুরি ধংস করে আইএস। ইরাকের তিকরিত শহর থেকে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটকে (আইএস) হটাতে প্রচ- লড়াইয়ের সময় কবরসহ স্তৃতিসৌধটি ধুলায় মিশে যায়।

 

 

সাদ্দামের পতনেই জন্ম নেয় আইএস

সাদ্দামের একনায়কতন্ত্র, ইরাকে রাসায়নিক ও জীবাণুঅস্ত্র আছে, এই অভিযোগের ধুয়া তুলে ইরাকে অনুপ্রবেশ করে মার্কিনিরা। মার্কিনিদের যুদ্ধাস্ত্রের আঘাতে ইরাকের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিধ্বস্ত হয়। নারী, শিশুসহ বেসামরিক মানুষ মারা পড়ে এই যুদ্ধে। অর্থনীতি পুরোমাত্রায় ভেঙে পড়ে। সাদ্দামকে গ্রেফতার করে মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। তারপর ইরাকে দেখা দেয় বিদ্রোহী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর। কখনো তাদের বলা হয়েছে সাদ্দামের অনুগত বাহিনী, কখনো বলা হয়েছে বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। এক পর্যায়ে বিশ্ববাসী দেখল আইএসের জন্ম। ইসলামিক স্টেট নাম দিয়ে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তৎপরতা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে নানা দেশে। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, যিনি সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতে জর্জ বুশের প্রধান সঙ্গী ছিলেন, স্বীকার করেছেন ইরাকে সামরিক হামলার কারণেই ইসলামিক স্টেটের উদয় হয়েছে। সাক্ষাৎকারে ব্লে­য়ার বলেছেন, সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতা থেকে সরাতে যারা জড়িত ছিলেন ইরাকের আজকের পরিস্থিতির জন্য তাদেরও কিছু দায়ভার আছে। কারণ যুদ্ধ শেষে পরিস্থিতি কোন দিকে যেতে পারে সে বিষয়ে তাদের বোঝার কিছু ভুল হয়েছিল। ইরাক যুদ্ধের কারণে ইসলামিক স্টেটের উত্থান ঘটেছে বলে যে ধারণা করা হয় তার মধ্যে কিছু সত্যতা আছে বলেও তিনি স্বীকার করেছেন।

ঘটনা এখানেই শেষ নয়। নিত্য নতুন পর্যালোচনায় উঠে আসতে শুরু করেছে সাদ্দাম আমলের শতাধিক সেনা কর্মকর্তা এখন আইএসের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তেমনই একজন আল-আনি। ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিগোষ্ঠীর কমান্ডার। আইএস সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছে। অথচ এক সময় তিনি ইরাকি সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আইএসের পঞ্চম ডিভিশনের কমান্ডার। ইরাকি বাহিনীর এমন বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রয়েছেন। আরও অনেক ইরাকি সাবেক সেনা কর্মকর্তা আইএসে যোগ দিয়েছেন। আইএস মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ে এর পরই। ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনে জন্ম নেওয়া এই জঙ্গিগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে আবার মার্কিনিরাই লড়াই চালাচ্ছে! বিশ্বের প্রধান সামরিক শক্তিধর দেশগুলো প্রায়ই অভিযোগ করে আসছে মার্কিনিরা ইচ্ছা করেই আইএসকে বাঁচিয়ে রাখছে। তবে গেল কয়েক বছরে রাশিয়া আইএস নির্মূলে অভিযান শুরু করলে চিত্র পাল্টাতে শুরু করে। একে একে আইএসের দখলকৃত অঞ্চল উদ্ধার করা হয়। ইরাক থেকে আইএসের বিষবীজ উপড়ে ফেলার প্রক্রিয়ার পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে আইএসের সন্ত্রাসী হামলার হুমকি মোকাবিলায় শক্ত হয়েছে শান্তিপ্রিয় দেশগুলো।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর