বৃহস্পতিবার, ২২ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

৫ উপায়ে পুরুষরা নারীকে এগিয়ে নিতে পারে

আনজু ফেরদৌসি

সিমন দ্য বোভোয়ারের একটি বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করি। তিনি বলেছেন, নিজের পুরুষত্ব নিয়ে নিরাপত্তাহীতায় ভোগা একজন পুরুষ নারীর প্রতি সবচেয়ে বেশি অহম, আক্রমণাত্দক অথবা ঘৃণাপূর্ণ ভাব প্রকাশ করে থাকে। হাজার বছর ধরে নারীর সামাজিক বা শারীরিক নিষ্পেষণের মূল কারণটি তিনি একটি বাক্যে বলে দিয়েছেন। বাংলাদেশের পুরুষদের সোশ্যাল মিডিয়া বা নিউজ মিডিয়ার ফোরামে যে কোনো নারীবিষয়ক আলোচনায় নারীর প্রতি যে মধ্যযুগীয় মনোভাব ফুটে উঠে সেটা মন এবং চোখের জন্য খুব পীড়াদায়ক। ২০১৪ সালেও এদেশের পুরুষ নারীদের দেখে মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণায়। তারা এখনো মনে করে নারী কখনো পুরুষের সমান নয়, তাই আইন-কানুনেও নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে দেখা উচিত। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অসংখ্যবার প্রমাণ করে দেখানো হয়েছে যে, নারী-পুরুষের মধ্যে বাহ্যিক শারীরিক কিছু পার্থক্য ছাড়া অন্য কোনো পার্থক্য নেই। বিজ্ঞানের প্রমাণকে বাংলাদেশি পুরুষ আজও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বলছে, নারী-পুরুষ সমান হতে পারে না। তাই নারীর উত্তরাধিকার সূত্রে বাবার সম্পত্তির অর্ধেক পাওয়া 'জাস্টিফাইয়াবল'। কিছু অবিবেচক পুরুষ তাদের অপরিণামদর্শিতাকে আরেকটু চড়িয়ে উঁচু গলায় প্রশ্ন তোলে, বিভিন্ন উন্নত দেশে কেন নারীরা এখনো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রাষ্ট্র শাসক বা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নেই? এটা বোঝা এত কঠিন কেন যে, হাজার বছরের পুরুষ শাসিত সমাজের নারীবিরোধী অবকাঠামো মাত্র কয়েক দশকে শুধু নারী কেন কারও পক্ষেই ভাঙা সম্ভব নয়? তারপরও সময়ের বিচারে বলতে হয় যে, উন্নত দেশে নারীর অগ্রগতি পুরুষদের তুলনায় ঈর্ষণীয় বটে। সব সমস্যার মতোই নারীর সমস্যা শুধু একজন নারীর পক্ষেই প্রকৃতপক্ষে বোঝা সম্ভব। একজন পুরুষের পক্ষে তাদের সমস্যার প্রকৃতি বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু নারীর সমস্যাকে সমাধানের লক্ষ্যে সহানুভূতিশীল পুরুষের সদিচ্ছা অপরিহার্য। কারণ সমস্যার মূলে রয়েছে পুরুষ তথা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের সমাজে নারীবাদী পুরুষ খুঁজে পাওয়া দুর্লভ রত্নের মতোই।

যাদের পাওয়া যায় তাদের সিংহভাগই নারীর অধিকার বিষয়ে পুরাপুরি সৎ নয়। এরা তাদের কমফোর্টজোনের বাইরে নারীর অধিকার বিস্তৃত করতে রাজি নয়। অথচ নারীর অধিকার নিশ্চিত করে, তাকে ক্ষমতায়ন করা শুধু সমাজ নয়, পুরুষের নিজের জীবনের মান বৃদ্ধিতে অতি প্রয়োজন। একটি পরিবারের পুরো দায়ভার একজন পুরুষকে করে তোলে সেই পরিবারটির একজন প্রয়োজনের ক্রীতদাস। তাতে হয়তো সে পরিবারের অন্যান্য সদস্যের উপর হম্বিতম্বি করার অধিকার পায়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার জীবনমানের কোনো হেরফের হয় না। একমাত্র নারীর ক্ষমতায়নই এই অবস্থার পরিবর্তন করতে পারে। এখানে আমি পাঁচটি উপায় বলার চেষ্টা করছি। যেভাবে বাংলাদেশের পুরুষ নারীকে ক্ষমতায়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ১। উত্তরাধিকার সূত্র আইনটি পরিবর্তন করা : সংবিধান অনুসারে বাংলাদেশ একটি সেক্যুলার দেশ। এর আইন-কানুনও একই কারণে সেক্যুলার বা সিভিল আইন অনুসরণ করে চলে। শুধু দুটি ধর্মীয় আইন এই সিভিল আইনের মধ্যে আইন প্রণয়নকারী পুরুষরা ঢুকিয়ে দিয়েছে। একটি উত্তরাধিকার সূত্র এবং অন্যটি পুরুষের বহুবিবাহ সংক্রান্ত আইন। একটি সেক্যুলার দেশে এই দুটি আইন বহাল রাখা শুধু সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো নয়, এটি মেয়েদের প্রতি অবিচার এবং অন্যায়। সম্পদহীনতা নারীকে মানসিক এবং সামাজিকভাবে পঙ্গু করে তোলে। পুরুষের পাশাপাশি কাজ করার জন্য নারীকে তৈরি করতে এই পঙ্গুত্বের অবসান জরুরি। অন্যদিকটি হলো- এই আইন দুটি সাক্ষ্য বহন করে বাংলাদেশের মেয়েদের প্রতি পুরুষদের স্থায়ীভাবে নৈতিক লঙ্ঘনের ইতিহাস, যা বাংলাদেশের পুরুষদের প্রতি নারীর বিশ্বাস চিরতরে নষ্ট করে দেয়। যেহেতু পুরুষ এই আইনটি নারীদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে, এটা সংশোধনের দায়িত্ব তাদের ওপরই বর্তায়। ২। বহুবিবাহ রোধ করা : পুরুষের বহুবিবাহ নারীকে হীনমন্যতার মধ্যে ডুবিয়ে দেয়। নিজেকে পুরুষের মতো যোগ্য ভাবার পথে এটি একটি বড় অন্তরায়। নারীর মেরুদণ্ড চিরতরে ভেঙে দিতে এর চেয়ে ভয়াবহ অস্ত্র আর কিছু হতে পারে না। এটি রোধ করা আশু প্রয়োজন। ৩। ধর্মীয় অনুশাসন মেয়েদের ওপর চাপিয়ে না দেওয়া : প্রচলিত ধর্মীয় অনুশাসন নারীর ক্ষমতায়নের পথে শুধু বাধাই নয় বরং নারীকে উল্টা পথে হাঁটতে পুরুষকে প্ররোচিত করে। এটা নারী এবং পুরুষের তথা সামাজিক উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অত্যন্ত সচেতনভাবে পুরুষকে লক্ষ্য রাখতে হবে ধর্মীয় কোনো অনুশাসন যেন নারী উন্নয়নের পথে বাধা হতে না পারে। ধর্মীয় গোড়া অনুশাসন মেয়েদের শুধু ঘরের মধ্যে আটকেই রাখে না, তাদের যে কোনো উদ্যোগকে 'হাতুড়ি পেটা' করে নষ্ট করে দেয়। নারীদের অলস, অযোগ্য ও ভোঁতা করে শুধু একটি মাংসপিণ্ড হিসেবে তৈরি করে। এছাড়াও ধর্মীয় গোড়া অনুশাসন নারী শুধু একজন মানুষ নয়, পুরুষের আধা-প্রাণী- এই ধারণা একজন পুরুষের মধ্যে শিশু বয়স থেকে শিক্ষা দেয়।৪। মেয়েদের মুক্ত চলাচল নিশ্চিত করা : সমাজের প্রতিটি স্তরে নারীর অবাধ যাতায়াত নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। মনে রাখা দরকার যে, অভিজ্ঞতা বা এক্সপোজার মানুষকে যে কোনো পরিবেশের জন্য উপযুক্ত করে তোলে। 'নারী যে মানুষ, অবলা প্রাণী নয়'- এই ধারণাটি মেইনস্ট্রিম সমাজব্যবস্থায় নিয়ে আসতে হবে।

৫। Mansplaningবন্ধ করতে হবে : ম্যান্সপ্লানিংয়ের প্রকৃত বাংলা শব্দ আসলে নেই। থাকলেও আমার জানা নেই। তবে এটা দিয়ে যা বোঝায় তা হলো- পুরুষ অনেক সময় বড়াই করে যে, সে নারীর নিজের জীবন বা নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে নারীর চেয়ে বেশি জানে। একটি সরল উদাহরণ দেই : একটি ছেলেকে তার এক বান্ধবী বলল, ছেলেটি এমন নোংরাভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছিল, আমাকে আড্ডা থেকে চলে আসতে হলো। তার বন্ধুটি সঙ্গে সঙ্গে বলল, ছেলেটি না হয় একটু তাকিয়েছে, তাতে কি হলো? সে তো আর বাঘ-ভালুক নয়। এখানে ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটির হয়ে তার মানসিক অবস্থার বিচার করে ফেলল। এটাই ম্যান্সপ্লানিং। বাংলাদেশের নারীদের ক্ষেত্রে শিশুকন্যা থেকে একজন নারী হয়ে জীবনাবসানের আগ পর্যন্ত তার কাছের পুরুষটি (বাবা, ভাই, স্বামী) এই কাজটি করে। পুরুষ জানে না এই কাজটি একজন নারীকে মানসিকভাবে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করে। প্রখ্যাত অভিনেত্রী Bette Davis কম কষ্টে বলেননি, ‘When a man gives his opinion, he’s a man. When a woman gives her opinion, she’s a bitch.’

বর্তমান সমাজে"মহিলা বা নারী শব্দকে একটি গালি হিসেবে দেখা হয়, আর মেয়েদের পুরা অস্তিত্বের প্রতি পুরুষের মনোভাবটি এখানেই প্রকট হয়ে ওঠে। এই মনোভাব পুরুষকে তাদের নিজের প্রয়োজনে বদলাতে হবে। হাজার বছর ধরে পুরুষ এই কাজটি করেছে একান্তই কুসংস্কার, পূর্ব ধারণা, পক্ষপাত আর অজ্ঞতা থেকে। যাতে পুরুষের কোন উপকার হয়নি। পুরুষ নিজেকে করেছে প্রয়োজনের ক্রীতদাস। একমাত্র পুরুষই পারে তার কুসংস্কার এবং অজ্ঞতা থেকে বের হয়ে আসতে।

-লেখক : কলামিস্ট।

 

 

সর্বশেষ খবর