পতাকা হচ্ছে একটি জাতি রাষ্ট্রের মুক্তি এবং সার্বভৌমত্বের প্রতীক। এই পতাকা অর্জনের জন্যই যুগে যুগে আন্দোলন-সংগ্রাম, সশস্ত্র যুদ্ধ, আত্মদান সংঘটিত হয়েছে। পতাকা মুক্তি ও স্বাধীনতার সর্বোচ্চ অহংকার। আর ২ মার্চ স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন দিবস হচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অহংকার।
উপমহাদেশের তিনটি রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ‘লাল সবুজের’, ভারতের জাতীয় পতাকা ‘তিরাঙ্গা’ আর পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা ‘চাঁদ তারা’ (Flag of the Crescent and Star) নামে পরিচিত।
ভারতের জাতীয় পতাকা নির্ধারণের আগে সেটা ছিল Swaraj Flag। মহাত্মা গান্ধীর প্রস্তাবে এবং অনুমোদনে ১৯২১ সালে Pingali Venkayya তার নকশা করেন। তখন এটার টাইটেল ছিল Jhande ka Swarup (Design of the Flag) আর পাকিস্তানের পতাকার ডিজাইনার হচ্ছেন সৈয়দ আমীর উদ্দিন কিদ ওয়াই। আর বাংলাদেশের পতাকার পরিকল্পনা করা হয় সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে এবং অনুমোদনে।
ব্রিটিশ উপনিবেশিকের বিরুদ্ধে অবিভক্ত ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্যে প্রথম ‘স্বরাজ পতাকা’ উত্তোলিত হয় ১৯২৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর মধ্য রাতে লাহোরের রাভি নদীর তীরে— যা উত্তোলন করেছেন জওহরলাল নেহরু। আর পাকিস্তান উপনিবেশিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলার প্রথম পতাকা উত্তোলন করা হয় ১৯৭১ সালের ২ মার্চ মধ্যদুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জনসমুদ্রের মাঝে— যা উত্তোলন করেছেন আ স ম আবদুর রব।
ভারতীয় দীর্ঘ মুক্তি-সংগ্রামের বাঁকে বাঁকে বন্দে মাতরম লেখাসহ অনেকবার পতাকার প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর প্রস্তাব ও অনুমোদনে চরকাযুক্ত তিরঙ্গা পতাকা চূড়ান্ত করা হয়, যা পরবর্তীতে রাভি নদীর তীরে উত্তোলন করা হয়। আর বাংলাদেশে একটি পতাকাই সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে এবং অনুমোদনে আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ, মার্শাল মনি, হাসানুল হক ইনু বাঙালি জাতির জন্য স্বাধীনতার পতাকা তৈরির পরিকল্পনা করেন। বাংলাদেশের পতাকার পরিকল্পনা হয় ১৯৭০ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর কক্ষে। বাংলাদেশের পতাকার পরিকল্পনার পর পরিকল্পনা মোতাবেক লাল সূর্যের বৃত্তের ওপর পূর্ববাংলার মানচিত্র আঁকেন শিব নারায়ণ দাস এবং কাপড় দিয়ে পতাকা তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন কামরুল আলম খান খসরুসহ অন্যান্য ব্যক্তিত্ব, যা পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে ২ মার্চ উত্তোলিত হয়। বাংলাদেশ নির্মাণে বহু গোপন সশস্ত্র সংগঠনের কর্মকাণ্ড ছিল কিন্তু কারও কোনো পতাকার প্রস্তাবনা ছিল না।
‘স্বরাজ পতাকা’ উত্তোলনের ১৭ বছর পর ১৯৪৭ সালে ভারত শাসন আইনের অধীনে গ্রহণের আদেশানুসারে (Adoption Order) এ ভারতের স্বাধীনতা গ্রহণ করা হয়। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের নয় মাসের মাঝেই সশস্ত্র মুক্তি-সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করা হয়। উপমহাদেশের Swaraj Flag-এ মহাত্মা গান্ধী চরকা যুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে ভারত স্বাধীন হওয়ার কয়েক দিন আগে Constituent Assembly-তে ২২ জুলাই ১৯৪৭ সালে সেই Pingali Venkayya’i পতাকা Adopted করে গ্রহণ করা হয়। তখন মহাত্মা গান্ধীর চরকার পরিবর্তে অসোকা চক্রা প্রতিস্থাপন করা হয়। ভারতের স্বরাজ পতাকা অনেকবার পরিবর্তিত হওয়ার পরও জাতীয় পতাকার মূল নকশাকারী হিসেবে Pingali Venkayya-কেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
অথচ বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকার পরিকল্পনায়, উত্তোলনে, নির্মাণে সব কিছুতেই নিউক্লিয়াস ও ছাত্রলীগ নেতারা জড়িত ছিলেন। সুতরাং লাল সবুজের পতাকার সূর্যের মাঝে সোনালি মানচিত্র বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিলেই তাকে নকশাকারক বলা যায় না। আজ এটি একটি ভুল ইতিহাস চর্চা করা হচ্ছে।
পাকিস্তানের চাঁদ তারা পতাকা গ্রহণ করা হয় Constituent Assembly-তে ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট। যার ডিজাইন করেছিলেন সৈয়দ আমির উদ্দিন কিদওয়াই। যা ১৯০৬ সালে পাকিস্তান মুসলিম লীগের পতাকাকে ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। ২ মার্চ প্রত্যেক বাঙালি জাতির জীবনে ঐতিহাসিক দিন। এ দিন বাঙালি জাতি তার কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের পতাকা উড়তে দেখল জমিনের উপরে। স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের নির্দেশে ১ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ সময় সিদ্ধান্ত হয় ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র-গণসমাবেশ অনুষ্ঠানের আর এই ছাত্র গণসমাবেশে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নিউক্লিয়াস। এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে স্বাধীনতা উন্মুখ বাঙালি জাতির পক্ষে আ স ম আবদুর রব স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। এ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন নূরে আলম সিদ্দিকী। পতাকা উত্তোলন করার সময় পাশেই ছিলেন শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখনসহ ছাত্রলীগের অন্য নেতারা। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় লাখ লাখ ছাত্র-জনতার সম্মুখে তৎকালীন ডাকসু ভিপি আ স ম আবদুর রব স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে বাঙালির স্বাধীন আবাসভূমি অর্থাৎ বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় অনিবার্য করে তোলেন। জাতীয় পতাকা হচ্ছে সার্বভৌমত্বের প্রতীক। ২ মার্চ পতাকা উত্তোলন ছিল উপনিবেশিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক মৃত্যুপরোয়ানা।
১৯৭১ সালের ২ মার্চ পতাকা উত্তোলন করার সময় আ স ম আবদুর রব বলেছেন, আজ থেকে এটাই স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা যা লাখো জনতা করতালি দিয়ে গ্রহণ করে।
৩ মার্চ ইশতেহার ঘোষণা করা হয় যা শাজাহান সিরাজ পাঠ করেন বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে পল্টন ময়দানে। ইশতেহারে বলা হয়, ৫৪ হাজার ৫০৬ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগোলিক এলাকার ৭ কোটি মানুষের আবাসিক ভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশ’। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ সংগীতটি গৃহীত হয়। উপনিবেশবাদী পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ব্যবহার ও উত্তোলনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। ‘জয় বাংলা’ বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হিসেবে নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ ২ মার্চ যে পতাকা উত্তোলিত হলো তাকেই জাতীয় পতাকা হিসেবে ব্যবহার করার নির্দেশনা থাকে ইশতেহারে। এর পর থেকেই সারা দেশে এই পতাকা উত্তোলিত হতে থাকে। ২৩ মার্চ ঢাকার সর্বত্র এই পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২৩ মার্চ ‘জয় বাংলা বাহিনী’ সামরিক কুচকাওয়াজের মাধ্যমে পতাকা উত্তোলন করে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ’ নেতাদের পক্ষে আ স ম আবদুর রব ধানমন্ডি ৩২-এ গিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাতে সেই পতাকা তুলে দেন এবং বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে উড়িয়ে ও গাড়িতে লাগিয়ে দেন। পরবর্তীতে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ মুজিবনগরে প্রবাসী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে এই পতাকাই উত্তোলিত হয়েছিল এবং গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়েছে। এই পতাকা দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে শহীদদের পবিত্র দেহ জড়িয়ে চিরকালের জন্য চিরদিনের মতো চিরনিদ্রায় শায়িত করা হতো। এই পতাকা দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর দেশবাসী বিজয় উৎসব পালন করে। পরবর্তীতে স্বাধীনতার পর তৎকালীন সরকার লাল বৃত্তের মাঝে বাংলাদেশের সোনালি রঙের মানচিত্র উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্তের সময় বঙ্গবন্ধু বিখ্যাত শিল্পী কামরুল হাসানের পরামর্শ নেন। এখন কামরুল হাসানকে পতাকার নকশাকারক বলা হচ্ছে, যা একেবারেই অযৌক্তিক ও অনৈতিক।
’৫২-এর প্রেরণার পর ২ মার্চ পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ ইশতেহার পাঠ, ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সমগ্র জাতিকে সংগ্রামী ও বিপ্লবী আগুনে পুড়িয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে পৌঁছে দেয়, জাতির মাঝে রাষ্ট্রের অনিবার্যতা স্পষ্ট হয়, জাতির অন্তরে বিপুল শক্তির জন্ম হয়।
আ স ম আবদুর রব একটি জাতি রাষ্ট্র বিনির্মাণের লক্ষ্যে মুক্তিপাগল মানুষের পক্ষে পতাকা উত্তোলন করেছেন ২ মার্চ দিনদুপুরে লাখো জনতার সামনে, যে ছবি দৃশ্যমান। অথচ এ স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন নিয়ে সরকার বা কারও কারও নীরবতা লক্ষণীয়। নীরবতার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর একটি উক্তি যথার্থ উত্তর হতে পারে। বঙ্গবন্ধুর উক্তিটি হচ্ছে ‘পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে।
পতাকা উত্তোলন মুক্তি সংগ্রামের মৌলিক স্বাক্ষর। সত্য কখনো পরিবর্তিত হয় না, সত্য কখনো মরে না। একদিন আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক রাজনৈতিক বিপ্লব ঘটবে— তখন সর্বত্র শোনা যাবে মুক্তি ও সত্যের বাণী।
লেখক : গীতিকবি
ই-মেইল : [email protected]
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        