সোমবার, ৭ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

আমরা কেমন মুসলমান

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

আমরা কেমন মুসলমান

ইসলাম মায়া-মমতা, প্রেম-ভালোবাসা, দয়া-দানের ধর্ম। ইসলামের মূলমন্ত্র ‘পরার্থে জীবন’। নবীজী (সা.) এবং তাঁর প্রিয় সাহাবিরা জীবনভর এ মূলমন্ত্রেরই বাস্তবায়ন করে গেছেন।  হায়! আজ তাদের উত্তরসূরি বিশ্ব মুসলমানের দিকে তাকালে আঁতকে উঠতে হয়। মুসলমানের এই আদর্শ? ভোগবিলাস আর স্বার্থপরতায় গা ভাসিয়ে দেওয়া ভণ্ড মুসলমানের জন্য কি পৃথিবী গড়ে গেছেন নবীজী (সা.)? আজ প্রতিটি মুসলমানের ভিতর ‘আমি’র বসবাস। আমির জন্য অন্যের অসুবিধা, এমনকি অন্যকে খুন করতেও প্রস্তুত মুসলমান। আজকের কোনো একটি জাতীয় পত্রিকার প্রথম বা শেষ পাতায় চোখ বুলালেই আমার কথার প্রমাণ পেয়ে যাবেন। হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, অন্যায়, অনাচার, ব্যভিচার, মিথ্যা, সুদ, ঘুষ কী করছে না মুসলমান নামধারীরা!

একদা মানুষের মাঝে দয়ামায়া বলতে কিছুই ছিল না। নজীবী এসে শেখালেন মানুষকে ভালোবাস। নিজের পাশেই জায়গা করে দাও প্রতিবেশীকে, বিপন্ন মানুষকে। এ একটি গুণে মুগ্ধ হয়েই ইসলামের প্রতি হুমড়ি খেয়ে পড়ল জগতের মানুষ। গড়ে উঠল প্রেমের সাম্রাজ্য। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! দেড় হাজার বছর পর সেই জাতিই দয়ামায়ায় অন্যদের থেকেও বর্বর ও নিষ্ঠুর হয়ে পড়েছে। আরও স্পষ্ট করে বললে, একটি ছোট্ট ইহুদি মেয়ের চেয়ে মুসলমান আজ দয়ামায়া চর্চায় পিছিয়ে পড়েছে। ঘটনাটি খুলেই বলি তাহলে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। হিটলারের ভয়ে সব ইহুদি গা-ঢাকা দিচ্ছে। যে যেভাবে পারছে আত্মগোপন করছে। কেউবা দেশ ছেড়েও পালাচ্ছে। দুটি ইহুদি পরিবার আত্মগোপন করেছে জার্মানের একটি অফিসের পেছনের দিকের মাটির নিচের গুদাম ঘরে। এমন আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা তখন কম ছিল না। ইহুদি পরিচয়ে যে কারোর জন্য এসব গোপন জায়গায় থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হতো সম্পদশালী অন্য ইহুদিদের খরচে। এসব বিষয় জানতে পেরেছি আনা ফ্রাংক নামে একটি কিশোরীর ভাষ্য থেকে। মেয়েটি ওই দুই পরিবারের একজন। তার রোজনামচায় উঠে এসেছে হিটলারের নির্মম অত্যাচারের চিত্র এবং গোপন আশ্রয়গুলোর দুর্বিষহ জীবন। খাবার, পানি, গোসল, ঘুম কোনোটাই ঠিকমতো হতো না তাদের। এমন পরিস্থিতিতেও এক ইহুদি আরেক ইহুদির জন্য নিজের বুক পেতে দিয়েছে হাসি মুখে। পরার্থের জীবন চর্চা করেছে দুঃখে-সুখে।

পৃথিবীতে যতগুলো বিখ্যাত রোজনামচা আছে আনা ফ্রাংকের রোজনামচা তার মধ্যে অন্যতম। মাত্র ১৩ বছরের কিশোরীর বিশ্লেষণে উঠে আসা যুদ্ধের নানা বিষয় মন নাড়া দেবে যে কারোরই। যুদ্ধ কিংবা হিটলারের নির্যাতনের সূক্ষ্ম বর্ণনার জন্য নয়, নির্যাতিত মানুষের প্রতি ছোট্ট মেয়েটির দরদ-ভালোবাসার অপূর্ব দৃষ্টান্তগুলোই দারুণভাবে স্পর্শ করবে পাঠককে। মেয়েটি লিখেছে, সে ও তার পরিবার গোপন আশ্রয়ে অন্যদের তুলনায় অনেকটা রাজার হালেই আছে। যারা বাইরে আছে, থাকার জায়গা নেই, খাবার নেই তাদের অবস্থা কী— তা ভেবেই এখন দিন কাটে আনার। সে শপথ নেয়, পরিস্থিতি ভালো হলে সে যুদ্ধাহতদের সেবা করে জীবন পার করবে। ছোট্ট একটি গুদাম ঘরে দুটি পরিবার কোনোরকম দিন কাটায়। তারপরও নতুন কোনো সদস্য যদি আসে তাতেই এ দুরবস্থায় সবাই দারুণ খুশি হয়। স্বেচ্ছায় আশ্রয় দেয় তাকে। ভাগাভাগি করে নেয় নিজেদের জিনিস। আর এতেই সবার আনন্দ। বেশি আনন্দ আনা নামের ছোট্ট মেয়েটির।

ছোট্ট আনা তার ধর্মের লোকদের প্রতি যে দরদ দেখিয়েছে মুসলমানদের মাঝে তার ছিটেফোঁটাও আছে কিনা? অন্য মুসলমানদের কথা আমরা কখনো ভেবেছি কি নিজের মতো করে? আর যদি হয় যুদ্ধের মতো ভয়াবহ সময় তখন? কে কত গা বাঁচাবে এ চিন্তায় অস্থির থাকব আমরা, আরেকজনের কথা ভাবব কখন? আনার পরিবার প্রমাণ করে দিয়েছে, ইসলামের সব বৈশিষ্ট্য তারা পালন করে যা অন্যের জন্য উপকারী। আর আমরা মুসলমানরা ক্রমেই স্বার্থপর থেকে আরও স্বার্থপর হয়ে উঠছি। নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরে দিব্যি ভাবনাহীন জীবন কাটাচ্ছি। তাই এখন আমরা নিজ সন্তান, ভাই, মা-বাবার হাতে নিজেরাই খুন হই প্রতিদিন। আমাদের ঘরে শান্তির পায়রাটি হয়ে গেছে অচিন পাখি। ছিঃ মুসলমান। হে মুসলিম ভাই, এ অবস্থা চলতে থাকলে সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন কোরআনের ঘোষণা অনুযায়ী এক ঝটকায় আমাদের অস্তিত্ব দুনিয়া থেকে মুছে দিয়ে আল্লাহ অন্য কোনো জাতিকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করে দেবেন। আল্লাহ আমাদের কোরআনের মুসলমান হওয়ার তৌফিক দিন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসিসরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর