মৃত্যুর পর যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা না হয়, ইউএনওর কাছে লিখিত আবেদন করেছেন জামালপুরের মেলান্দহের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন। আর চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমান লজ্জাশরমে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে তার নাম বাদ দিতে আবেদন করেছেন সেখানকার ইউএনওর কাছে। স্বাধীনতার ৪৭ বছরে এসে মহান বিজয়ের মাসে ঘটনা দুটি দেশের দুই প্রান্তের। ধরন দুই রকমের। তবে মেসেজ প্রায় একই।
আনোয়ারার মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমানের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের নয় বছর পর। তার মা-বাবার বিয়েই হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পর, ১৯৭৮ সালে। মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় কীভাবে ঢুকেছে তার নাম তিনি নিজেই জানেন না। এতে যারপরনাই বিব্রত হয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে তার নাম বাদ দিতে আবেদন করেছেন স্থানীয় প্রশাসনের কাছে। খাঁটি মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেনের বিষয় একটু আলাদা। সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইতে জাল-জালিয়াতির প্রতিবাদে এই সিদ্ধান্ত তার। বিজয়গাথা ডিসেম্বরের ১৩ তারিখে মেলান্দহের ইউএনওর কাছে লেখা চিঠিতে তিনি মৃত্যুর পর যেন তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া না হয় সেই আরজির সঙ্গে এনেছেন আরেকটি বিষয়। ভুয়াদের দাপটে ভবিষ্যতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের কী দশা হতে পারে, সেই শঙ্কার কথা উল্লেখ করেছেন একাত্তরের এই বীর।
সংবাদ দুটি বাংলাদেশের জন্মদানে সম্পৃক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থা, অবস্থান, মান-সম্মান, বর্তমান-ভবিষ্যতের দর্পণের মতো। মুক্তিযোদ্ধা কে? কাকে বলে মুক্তিযোদ্ধা? কী তার সংজ্ঞা? মানদণ্ডই কী? এসব প্রশ্নের নিষ্পত্তি হয়নি স্বাধীনতার এত বছর পরও। আর সংখ্যার অবস্থা সংজ্ঞার চেয়ে আরও ভয়াবহ। কে যে মুক্তিযোদ্ধা নন, এটাই এখন মোটা দাগের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নিয়ে অঙ্কবাজি স্বাধীনতার পর থেকেই। কমবেশি সব সরকারই এই গণিত উৎসব করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বানিয়েছে রাজনীতির পণ্য। আবার মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেও পণ্য হতে পেরে ধন্য। অভাব, স্বভাব বা পরিস্থিতিদৃষ্টে এ রেসে ভিড়েছেন খাঁটি মুক্তিযোদ্ধার কেউ কেউ। দুনিয়ার কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের তুলনা মানায় না। পুরোটাই বাস্তবতার নিষ্ঠুরতা। এ নিষ্ঠুরতাই মুক্তিযোদ্ধাদের অভাব-অনটনে অপমান-অপদস্থ হয়ে জীবন সাঙ্গ করার জায়গায় এনে ঠেকিয়েছে। এমন নিয়তি বা পরিণতির দৃষ্টান্ত বিশ্বের অন্য কোনো দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের নেই। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার এমন উৎপাদন ও উৎপাতের তথ্যও আর কোথাও নেই। অথচ শুধু মুক্তি আর স্বাধীনতা ছাড়া এই মুক্তিযোদ্ধারা আর কিছু চাননি। হাত পাতেননি কারও কাছে। ৯০ ভাগ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা গ্রামীণ সাধারণ ঘরের সন্তান। কষ্টকর জীবনযাপন করলেও কখনো কারও কাছে হাত পাতার স্বভাব তাদের ছিল না। অথচ স্বাধীন, সামর্থ্যবান হওয়ার পর কী দশা তাদের?
রাজনৈতিক মতলবে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা বদল ও চূড়ান্ত না হলেও এ মুহূর্তে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৩১ হাজার ৩৮৫। মুক্তিযোদ্ধাদের হাত পাতা, সম্মানের বদলে সম্মানীসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা লেনদেনে অভ্যস্ত এবং লোভী করার কাজে কোনো সরকারই কমতি করেনি। দাতার বদলে মুক্তিযোদ্ধার ছেলে-নাতিদেরও গ্রহীতার কাতারে এনেছে। বার বার যাচাই-বাছাইয়ের নামে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে নানা বিভেদও পাকাপোক্ত হয়েছে। আর সম্মানের বদলে সম্মানী প্রার্থী তো বেড়েছেই। প্রতিটি নতুন তালিকায়ই মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়েছে। আগের সরকারের তালিকা থেকে কিছু বাদ পড়লেও সংখ্যা কমেনি। সুযোগ-সুবিধাও কমেনি। এসব তালিকায় সর্বনিম্ন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৭০ হাজার ৮৯৬। সর্বোচ্চ ২ লাখেরও বেশি। পাঁচবারের পর এখন ছয় নম্বর তালিকায় ঢুকতে নতুন প্রার্থী ১ লাখ ৩৪ হাজারের মতো। তারা আগের ২ লাখ ৩১ হাজার ৩৮৫ জনের সঙ্গে যোগ হলে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়াবে ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৩৮৫-তে। কিন্তু এ যাত্রায় গণ্ডগোল পেকে তা এখন আদালতি বিষয় হয়ে গেছে। সারা দেশে এ নিয়ে দুর্নীতি, অনিয়মসহ বিভিন্ন অভিযোগে ৪৯১টি মামলা হয়েছে। মামলাবাজির বাইরে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাগত তথ্যের ছড়াছড়ি। ধরনেও রকমফের। গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকার মধ্যে রয়েছে— মুক্তিবার্তা লাল বইয়ে ১ লাখ ৫৪ হাজার। বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলে ৪৪ হাজার। আর মহাজোট সরকারের সময় ১১ হাজার। এর মধ্যে প্রায় ৬০ হাজারের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। যাচাই-বাছাই কমিটি আচ্ছা রকমের ফ্যাসাদে পড়েছে জোট সরকারের আমলের ৪৪ হাজার, অভিযুক্ত ৬০ হাজার আর নতুন ১ লাখ ৩৪ হাজার আবেদন নিয়ে।
স্বাধীনতার পর সেক্টর কমান্ডার ও সাবসেক্টর কমান্ডারদের বিভিন্ন প্রকাশনায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৩৪ হাজার ৮০০। তার মধ্যে নিয়মিত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা ২৪ হাজার ৮০০। আর অনিয়মিত বাহিনীর ১ লাখ ১০ হাজার। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টর বিলুপ্তির পর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রশিক্ষণ ও রেকর্ড সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠান ইবিআরসিতে স্থানান্তরিত দলিলে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৭০ হাজার ৮৯৬। এতে আগের তালিকার বাকি মুক্তিযোদ্ধাদের হদিস নেই। এটিই পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে সংরক্ষিত করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এটি ভারতীয় তালিকা নামে পরিচিত।
স্বাধীনতার এই ৪৬ বছরে কতবার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা হয়েছে? সব মুক্তিযোদ্ধা জানেনও না। বিভিন্ন তথ্য-সাবুদে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধা নির্ধারণের প্রথম উদ্যোগটি স্বাধীনতার পরের বছর ১৯৭২ সালে। তখন বীর মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী স্বাক্ষরিত সনদপত্র এবং কিছু ভাতাও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে সেই সনদপত্রকে মূল্যহীন করে অসম্মান করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে, ওসমানীকে। এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের মানদণ্ড নিয়ে প্রজ্ঞাপন ও নির্দেশনা আর থামেনি। এ সিরিজে ১৯৭৮ সালের পর মুক্তিযোদ্ধার তালিকার কাজে হাত দেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তিনি এর দায়িত্ব দেন অমুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের শিরোমণি তৎকালীন সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদকে। ওই তালিকায় ১৯৮৬ সালে এরশাদের শাসনামলে ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৮ জনের নাম প্রকাশ করা হয়। আর প্রচার হয় এরশাদের আলোচিত স্লোগান ‘মুক্তিযোদ্ধারা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সন্তান’। এরশাদ পতনের পর ১৯৯৪ সালে বিএনপির শাসনামলে আবার তালিকা। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভোটার তালিকায় নাম ওঠে ৮৬ হাজার জনের। এরপর আবার মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের পালা। ১৯৯৬-২০০১ আমলে মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত হয় ১ লাখ ৮২ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম। মুক্তিযোদ্ধারা একে বলেন ‘লাল বই’। যাতে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৫৪ হাজার।
২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে আবার হাত দেয় মুক্তিযোদ্ধা তালিকায়। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বাড়তি সম্মান দেওয়া হয়। তবে আগের নীতি বাদ। মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে বাদ রেখে ইউএনও এবং ডিসিদের নিয়ে উপজেলা ও জেলা যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হয়। আগের যে কোনো দুটি তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদেরই সুপারিশ করে কমিটি। তাদের সুপারিশের ব্যক্তিরাই হয়ে যান মুক্তিযোদ্ধা। ২০০৩ ও ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় মুক্তিযোদ্ধা তালিকার দুটি গেজেট। একটির নাম বিশেষ গেজেট। যেখানে সামরিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৩৯ হাজার। অন্যটি সাধারণ। এতে মুক্তিযোদ্ধা ১ লাখ ৫৯ হাজার। দুয়ে মিলে তখন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৮ হাজারে। তখন মোটমাটে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়ে ৪৪ হাজার। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেটিকে ডাকা হয় ভুয়া তালিকা নামে। তবে মহাজোট সরকার এগোয় বিএনপির নীতিমালাতেই। ওই নিয়মেই তারা মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেয় ৩৩ হাজার ৩৮৫ জনকে। এতে সর্বসাকল্য গণিতে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৩১ হাজার ৩৮৫ -তে। এর মধ্যে বিভিন্ন বাহিনীর ৫০ হাজার ৮৭২ জন। আর বেসামরিক ১ লাখ ৮০ হাজার ৫১৩ জন।
ঢাকের কাঠি বানিয়ে এভাবেই গাণিতিক হারে বাড়ছে মুক্তিযোদ্ধা। সঙ্গে সম্মানীও। আর সম্মানের পতন জ্যামিতিকেও হার মানিয়ে চলেছে। সঙ্গে বোনাস হিসেবে রয়েছে তামাশা। আসল-নকল মুক্তিযোদ্ধা সব এক কাতারেই। মুক্তিযুদ্ধের পরে জন্ম নেওয়া ব্যক্তির নামেও মুক্তিযোদ্ধার সনদ! ৪৬ বছরে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিকীকরণের ষোলোকলা পূরণ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ও যোদ্ধাদের নিয়ে রাজনৈতিক খেলাটা খুব মজার। খেলারামদের জন্য নিশ্চিত লাভজনক। দাতা-গ্রহীতা দুদিকেই। ক্ষমতা বদলে মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা, সংখ্যা বদলানোর ধারা এভাবে আর দু-এক বার বাড়লে অঙ্কটা কোথায় উঠবে আল্লাহ মালুম। জাতির গর্ব ও আত্মশক্তিকে খেলো করে হাসির পাত্রে আর উপচে না ফেললে হয় না? মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের নামে ভোটের আগের রাতের মতো লেনদেন, নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করতে ডিও লেটার, তদবির বাণিজ্য কি আর না করলেই নয়?
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।