সোমবার, ১৬ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

সরকার পতনে আন্দোলনের যৌক্তিকতা

মেজর মো. আখতারুজ্জামান (অব.)

সরকার পতনে আন্দোলনের যৌক্তিকতা

এ কষ্ট কারও সঙ্গে শেয়ার করা যাচ্ছে না। সরকারের নেতা, পাতি নেতা, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী সবাই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বলছেন বিএনপি নির্বাচনে যাবেই। বিএনপির নেতারাও বলে বেড়াচ্ছেন বিএনপিও নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত! ৩০০ আসনের প্রতিটিতে নাকি বিএনপির একাধিক প্রার্থী চূড়ান্ত করে ফেলা হয়েছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই নাকি প্রার্থীদের নিয়ে বিএনপি নির্বাচনে নেমে যাবে!! কথাটি কতটুকু সত্যি তা কারও কাছ থেকে জিজ্ঞাসা করারও উপায় নেই।  দলের চেয়ারপারসন জেলে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশান্তরিত। যার ফলে তাদের কারও সঙ্গে দলের সিংহভাগ নেতা-কর্মীর যোগাযোগ নেই। যাদের আছে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতার চরম ঘাটতি। একেক নেতা একেক রকম করে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের খবরাখবর বাজারে ছড়াচ্ছে অথচ প্রকৃত তথ্য জানার কোনো উপায় নেই। বিএনপির সব নেতা-কর্মীর মধ্যে ব্যাপক চাপা গুমোট অবস্থা। পদধারী নেতাদের সঙ্গে কথা বললে তারা কিছু দিনের মধ্যেই আন্দোলন শুরু করে দিচ্ছেন বলে বাগাড়ম্বর করেন। তারা বলছেন অপেক্ষা শুধু মোক্ষম সময়ের। তবে পদধারী নেতারা প্রকাশ্যেই কর্মীদের সামনে স্বীকার করে বেড়াচ্ছেন যে, এই সরকারের বিরুদ্ধে নাকি বেশি দিন আন্দোলন চালানো সম্ভব নয়। আন্দোলন করতে হবে স্বল্প সময়ের জন্য। তাই তারা অপেক্ষা করছে মোক্ষম সময়ের জন্য এবং এই মোক্ষম সময়ের জন্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নাকি অপেক্ষা করতেও বলেছেন এবং সময় হলে তিনিই নির্দেশ দেবেন তখন আমরা সবাই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ব।

এখন এই অর্থহীন কথাগুলোর সত্য-মিথ্যা যাচাই করা বা আলোচনা করা বা কারও সঙ্গে শেয়ার করার কোনো সুযোগ নেই। তারা সবাই দেশমাতার মুক্তি আন্দোলনের কথা মুখে মুখে বলছে কিন্তু নিজেদের মধ্যে আলোচনা চলছে নির্বাচন প্রস্তুতির। দলের কর্মীরা দিকভ্রান্ত। কর্মীরা কার কথা শুনে কোন দিকে যাবে? দলের তৃণমূল নেতারা সামনে দেশমাতার মুক্তি ছাড়া অন্য কোনো এজেন্ডা নিয়ে চিন্তা করতে রাজি না। অন্য কোনো অংক তৃণমূল নেতা-কর্মীরা বোঝে না। কিন্তু তারা সবাই প্রায় নেতৃত্বহীন। নেতারা বিভিন্ন হিসাব নিয়ে ব্যস্ত!!! নেতাদের যোগাযোগ নেই, দলের চেয়ারপারসন জেলে বন্দী থাকার কারণে, যোগাযোগ নেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দূরদেশে থাকার কারণে। যেসব নেতার টাকা আছে, সামর্থ্য আছে দূরদেশে যোগাযোগ করার জন্য তারা উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশে। সব কিছুই বা সবাই, শত্রু মিত্র সবাই তাদের নিয়ন্ত্রণে। রাজনীতি তাদের কাছে ব্যবসার পণ্য। যে যেভাবে পারে সেই পণ্য বাজারজাত করছে। তারা পদের পাগল। মেম্বার, চেয়ারম্যান, মেয়র, সংসদ সদস্য তাদের কাছে স্বপ্নের পরী। সেই পরী ধরার জন্য তারা রাজনীতির আকাশে বিচরণ করে। তারা শুধু পরী চায়। রাজনীতি কি, কেন বা কার জন্য তার ধার তারা ধারে না। আজকে আমাদের চরম দুর্ভাগ্য এই পরী লোভী স্বপ্নচারীরা আমাদের নেতা যাদের আমরা বিগত সময়কাল থেকে দলে বিভিন্ন স্তরে ও অঙ্গসংগঠনে টাকা ছড়িয়ে পদ দখল করার বাণিজ্যে উৎসাহিত করেছি।

দলে এখন মূল আলোচনা দেশমাতার মুক্তি আন্দোলন ও নির্বাচন নিয়ে। তিন ভাগে বিভক্ত এই আলোচনা। প্রথম ভাগে সব নেতার মূল বক্তব্য হলো— দেশমাতার মুক্তির আন্দোলন ও একই সঙ্গে নির্বাচন। দ্বিতীয় ভাগে হলো আন্দোলন ফান্দোলন বাদ দিয়ে এখনই নির্বাচনে নেমে পড়া। আর তৃতীয় ভাগ হলো সরকারের সঙ্গে দরকষাকষি করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গোষ্ঠী বা শক্তির মধ্যস্থতায় বর্তমান সংসদ ভেঙে নির্বাচনে যাওয়া।

তবে যারা আন্দোলনের কথা বলেন, তাদের বক্তব্য হলো শুধু দেশমাতার মুক্তির কথা বললে তাদের মতে দেশের জনগণ সেই আন্দোলনে এগিয়ে নাও আসতে পারে। তাই তারা দেশমাতার মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে সরকার পতনের আন্দোলন ও অন্যান্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো নিয়ে একটি ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলা যাতে একসঙ্গে দেশমাতার মুক্তি এবং সরকারের পতনও করানো যায়। লক্ষ্য খুবই আদর্শিক কিন্তু বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন ও সময়সাপেক্ষ। করতে পারলে খুবই ভালো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই গণআন্দোলন করে তুলতে হলে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ইস্যুর প্রয়োজন পড়ে এবং সেই ইস্যু গণআন্দোলন গড়ে তোলার জন্য শুধু জনসমর্থন নয়, তা বাস্তবায়নের জন্য একটি অতি নিবেদিত তরুণ ও পেশাজীবী সংগঠন দরকার। যে কোনো সফল আন্দোলনের জন্য প্রথমেই দরকার তরুণ বা ছাত্রসমাজের ভূমিকা। একটি চৌকস এবং আক্রমণাত্মক সেনাবাহিনীর জন্য যেমন প্রয়োজন তরুণ টকবগে সৈনিক তেমনি আন্দোলনের জন্য দরকার শিক্ষারত তরুণ ছাত্রের যারা প্রতিদিন তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকে ফলে অতি সহজে ছাত্রদের রাস্তায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়। তাছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠরত ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সরাসরি সম্পৃক্তা থাকে ফলে ছাত্রদের বিপদে আপদে যেমন শিক্ষকরা শক্তিশালী ভূমিকা রাখে তেমনি ছাত্রদের আন্দোলনও উপদেশ পরামর্শ দিয়ে ছাত্রদের আন্দোলনের সঠিক পথে পরিচালিত করে থাকে। ক্যাম্পাস বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে বা অছাত্ররা সব সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা গোয়েন্দাদের নজরে নজরে থাকে, যার ফলে সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে তারা সব সময় যোগাযোগ রাখতে পারে না। এ ছাড়া অছাত্ররা সামাজিক অপরাধ ও রাজনৈতিক নেতা-নেতৃত্বের লেজুড়বৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ে যার ফলে পাঠরত ছাত্ররা কখনই অছাত্রদের নেতৃত্ব বা কর্তৃত্ব মেনে নেয় না। ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বের অত্যাবশ্যক শর্ত হলো নেতা-কর্মীদের অবশ্যই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়মিত ছাত্র হতেই হবে যার কোনো বিকল্প নেই। সরকারি দলে বাবা দাদা ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মী হতে পারে কিন্তু সরকারবিরোধী কোনো ছাত্র প্রতিষ্ঠানে কোনো অবস্থাতেই অছাত্র ছাত্রনেতা বা কর্মী হওয়ার সুযোগ নেই। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত বিরোধী রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের অছাত্রদের যুব বা অন্য সমমর্যাদার সংগঠনে ছড়িয়ে দিয়ে শুধু পাঠরত ছাত্রদের দিয়ে ছাত্র সংগঠন না সংগঠিত করা হবে ততদিন পর্যন্ত অছাত্রদের ছাত্র সংগঠন দিয়ে কোনো ধরনের আন্দোলন করানো তো দূরের কথা বরঞ্চ এই অছাত্রদের ছাত্র সংগঠন আন্দোলনের প্রতিবন্ধক হিসেবে যে কোনো আন্দোলনের ক্ষতি করবে। তাই বর্তমানে সরকারবিরোধী মূল রাজনৈতিক দলের সহযোগী ছাত্র সংগঠনের যে সাংগঠনিক ও নেতৃত্বের অবস্থা তাতে সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন তো দূরের কথা দেশমাতার মুক্তি আন্দোলন করানোও সম্ভব নয়। এটি বর্তমান প্রেক্ষাপটে চরম বাস্তবতা।

আন্দোলনের জন্য অপরিহার্য যে শক্তি তা হলো শ্রমিক তথা শ্রমজীবী মানুষের সংগঠন। আজকের আর্থ-সামাজিক ও শ্রম বাজারের আলোকে এখন শুধু মিল কারখানায় কর্মরত শ্রমিকরাই শ্রমজীবী নয়। মিল কারখানার পাশাপাশি রয়েছে বিশাল বিশাল সেবা ও কর্ম করার প্রতিষ্ঠান যেখানে কায়িক পরিশ্রমের শ্রমজীবীর পাশাপাশি বিশাল পরিমাণ সেবাদানকারী ও কর্মজীবী মানুষ যারা দেশের আর্থ-সামাজিক ও উৎপাদনের বিশাল কর্মযোগ্যে নিয়োজিত। এই বিশাল কর্মজীবী মানুষ সরাসরি কোনো রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে না কিন্তু তারা রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি। যারা পরোক্ষভাবে দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। এই বিশাল কর্মজীবীরা সরাসরি রাজনীতি না করলেও রাজনীতিতে রয়েছে তাদের বিশাল প্রভাব। প্রতিটি কর্মজীবী প্রতিষ্ঠানের রয়েছে তাদের নিজস্ব পেশাভিত্তিক সংগঠন। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন কোনো কোনোটি এত শক্তিশালী যে সরকারকেও তাদের কথা শুনতে হয়, না হলে সত্যিকার অর্থেই সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। তাছাড়া গার্মেন্টভিত্তিক মেগা শিল্প প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান যেখানে লাখ লাখ শ্রমজীবী নারী-পুরুষ কাজ করে। এই বিশাল শ্রমজীবীরা প্রত্যক্ষভাবে কোনো রাজনৈতিক দল না করলেও সরকারের ভারসাম্য রক্ষায় এদের বিশাল প্রভাব রয়েছে। তাছাড়া সরকারের দরকষাকষি করার মতো রয়েছে তাদের প্রভাবশালী সংগঠন যাদের সঙ্গে আপস করে চলতে সরকার বাধ্য হয়। এই কর্মজীবী ও শ্রমজীবীদের পাশাপাশি রয়েছে দেশব্যাপী বিস্তৃত বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন যেমন মত্স্যজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, মোটরযান শ্রমিক, কুলি মজদুর এমনি অজস্র পেশাজীবী সংগঠন যারা যে কোনো আন্দোলনের পক্ষে বিশাল একটি সহায়ক শক্তি।

বর্তমানে দেশের বিশাল অর্থনৈতিক কার্যক্রমের কারণে দেশে গড়ে উঠেছে ব্যবসাভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠন। ছোট ছোট বাজারের দোকানদার সমিতি থেকে শুরু করে এফবিসিসিআই নামে বিশাল ক্ষমতাশালী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। রয়েছে ব্যাংক মালিকদের পরাক্রমশালী ক্ষমতাধর সমিতি যেখানে সরকারবিরোধীদের টুঁ শব্দ করার ক্ষমতা নেই। এ ব্যাংক মালিকদের পরোক্ষ সমর্থন বা ইশারা ছাড়া সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলনে সফলতার চিন্তা যদি কেউ করে তাহলে সে বোকার স্বর্গে বাস করছে বলেই মনে হবে। সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলন করতে হলে অবশ্যই এ অসীম ক্ষমতাধর ব্যাংক মালিকদের সংগঠনসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সঙ্গে একটি দফা-রফায় আসতেই হবে। শুধু রাজনৈতিক শক্তি দিয়ে আন্দোলনে সফলতা আনা এখন খুবই কঠিন বলেই অনেকের ধারণা।

একটি শক্তিশালী গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হলে যে পটভূমিকা ও আন্দোলনের ইতিবাচক রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক অবস্থার প্রয়োজন পড়ে তা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির অনুকূলে নেই। এ মুহূর্তে সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলন বা এমনকি দেশমাতার জন্য ন্যূনতম আন্দোলন করতেও অন্য কোনো রাজনৈতিক দল এগিয়ে আসবে না। তাদের সঙ্গে আন্দোলনের ব্যাপারে আলোচনা করা মানে এ ক্রান্তিকালের মহামূল্যবান সময় নষ্ট করা। কাজেই আন্দোলন ও নির্বাচন একসঙ্গে হবে না এবং এ মুহূর্তে হওয়ার সুযোগ নেই।

বর্তমান অবস্থায় আন্দোলন ও নির্বাচন একসঙ্গে চালিয়ে যাওয়া বাস্তবসম্মত কর্মসূচি নয় বলেই অনেকে মনে করে। তাই আন্দোলনের কথা আপাতত স্থগিত রেখে নির্বাচনের পথে হাঁটতে হবে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে। কারণ সরকার চাচ্ছে বর্তমান সংসদ রেখে নির্বাচন দিতে যা কোনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না। সংসদ রেখে যে নির্বাচন হবে সে নির্বাচনে যাওয়ার চেয়ে না যাওয়া হাজার গুণ ভালো। কারণ তখন সরকারের সঙ্গে আঁতাত না করে নির্বাচনে জয়লাভের সম্ভাবনা নেই। সংসদ বহাল রেখে নির্বাচনে যাওয়া মানে হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটতে যাওয়া এবং নিজেকে রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া করে দেওয়া। তার চেয়ে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়া অনেক বেশি বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কাজেই সংসদ বহাল রেখে যে নির্বাচন হবে সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে অনেকে চাইবে না যদিও রাজনীতিতে লোভী মানুষের ভিড় বেশি!

বাকি থাকল তৃতীয় পথ অর্থাৎ সংসদ ভেঙে যদি সরকার নির্বাচন দেয় তাহলে সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা যায় কিনা। অনেকে মনে করেন দেশ ও জাতির স্বার্থে এবং গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার জন্য নির্বাচনে যাওয়া যায় যদি সরকার চলমান সংসদ ভেঙে দিয়ে আগামী বছরের প্রথমদিকে নির্বাচন দেয়। তবে সরকারকে অবশ্যই অঙ্গীকার করে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে ওই নির্বাচনে সরকার সব সরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিরপেক্ষ রাখবে এবং বিরোধী দলকে আজ থেকে নির্বাচন শেষ হওয়ার পরবর্তী এক মাস কোনো হয়রানি করবে না এবং এ সময়ে পুলিশ কোনো রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করতে পারবে না। যদি গ্রেফতার করার প্রয়োজন হয় তাহলে সে লক্ষ্যে প্রতিটি থানায় বিপরীতমুখী দুই দল বা জোটের স্থানীয় সভাপতি দিয়ে দুই সদস্যবিশিষ্ট কমিটি করে দিতে হবে, যারা দলীয় কর্মীদের যথাযথ প্রত্যয়ন দেবে এবং তাদের উভয়ের যৌথ পূর্বানুমতি নিয়ে প্রয়োজনে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারবে। সবার কাছে নিরাপদ এমন একটি অবস্থা সরকার তৈরি করে দিলে জনগণ মনে করে অনেকেই নির্বাচনে আসবে এবং তখনই শান্তিপূর্ণভাবে জনগণের ভোটে ক্ষমতার পালাবদল সম্ভব হবে।

আন্দোলন নয়, আলোচনার মাধ্যমেই জাতীয় সব সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। বন্দী অবস্থায় দেশমাতা খালেদা জিয়ার আজকে পাঁচ মাসের বেশি সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনোভাবেই দেশমাতাকে মুক্ত করে আনা যাচ্ছে না। এর জন্য ব্যক্তিগতভাবে কেউ দায়ী নয়। বিভিন্ন বাস্তবতায় দেশমাতার জেলে যাওয়াতে দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা ও পরবর্তী নেতৃত্বের দূরে থাকার কারণে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তা পূরণ করার মতো কোনো সাহসী নেতা না থাকার কারণে দেশমাতার মুক্তি বিলম্বিত হচ্ছে। কোনো নেতা স্থানীয়ভাবে একা দায়িত্ব নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রভাবশালী সংগঠন বা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে দায়িত্ব নিয়ে কথা বলতে বা আলোচনা করতে পারছে না, যার কারণে অনেক ব্যক্তি বা সংগঠন দেশমাতার মুক্তির ব্যাপারে কোনো ভূমিকা রাখতে এগিয়ে আসছে না। যার ফলে সমমনা বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। এখন এমন কোনো নেতা নেই যিনি সাহস করে বলবেন দলের চেয়ারপারসন কারারুদ্ধ হওয়ার কারণে দেশে অনুপস্থিত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দিয়ে এখন চলবে না। দেশে একজন পূর্ণ ক্ষমতাশালী নেতৃত্ব দরকার যিনি তার প্রজ্ঞা, মেধা, সাংগঠনিক ক্ষমতা ও বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা শক্তির সঙ্গে দায়দায়িত্ব নিয়ে দেশমাতার মুক্তি নিশ্চিত করতে নিজ দায়িত্বে কর্মসূচি দিয়ে এগিয়ে যেতে পারবেন। রাজনীতি হলো কৌশল এবং বুদ্ধির খেলা। এখানে মুহূর্তে মুহূর্তে নতুন কৌশল নিয়ে এগোতে হয় সেখানে অনুপস্থিত নেতা যতই মেধা বা বুদ্ধিশালী হোক না কেন, তা কাজে আসবে না। নির্বাসিত নেতার প্রতি দলের কারও আনুগত্যের অভাব নেই। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি করা সময়ের দাবি। দলে অনেক দক্ষ, মেধাবী ব্যক্তি যারা নেতা ও দলের প্রতি বিশ্বস্ত আছেন এমন কাউকে সর্বময় ক্ষমতাসহ দায়িত্ব দিলে অবশ্যই একটি ফলাফল আসবে বলে অনেকের বিশ্বাস। দেশমাতার অজস্র সমর্থনকারী আছে যারা জীবন দিতেও পিছপা হবে না, কিন্তু নির্দেশের অপেক্ষায় তারা কিছু করতে পারছেন না। মাঝখান দিয়ে সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই পাঁচ মাস চলে গেছে। আগামী সাত মাসের মধ্যে যদি কোনো কিছু ইতিবাচক না করা যায় তাহলে দেশমাতাকেও মুক্ত করা যাবে না এবং তারেক রহমানও অদূর ভবিষ্যতে দেশে হয়তো আর আসতে পারবেন না। সব শেষ হয়ে যাবে। জিয়ার নাম মুছে যাবে। হয়তো আমাদের আবার নতুন করে শুরু করতে হবে কিন্তু সে সুযোগও পাব কিনা তারও নিশ্চয়তা নেই। তাই জনগণ মনে করে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের ধ্যান-ধারণা একটি প্রতিক্রিয়াশীল অশান্তিপূর্ণ রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, যা কখনই আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কাম্য হতে পারে।  এ তথাকথিত আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাজনীতি আর ফায়দা লুটে পুলিশ, প্রশাসন ও আমলা। এ মরণ খেলার অবসান জনগণ চায়।  জনগণ মনে করে সরকার পরিবর্তন শুধু নির্বাচনের মাধ্যমেই হওয়া উচিত।  তাই সংসদ ভেঙে দিয়ে সরকার একটি অর্থবহ নির্বাচন দেবে, যা অংশগ্রহণমূলক হবে বলে জনগণের প্রত্যাশা।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর