কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা-কর্মীরা কেন রুখে দাঁড়াতে পারেননি তার কারণ জানতে রাজধানীর এলাকাভিত্তিক নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছেন দলটির শীর্ষ নেতারা।
গতকাল ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে ছিল দ্বিতীয় বৈঠক। এতে দলটির সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের উপস্থিতিতেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন মাঠপর্যায়ের নেতারা।
তারা বলেন, আওয়ামী লীগের পদ-পদবি নিয়ে অনেকেই দুর্দিনে গা-ঢাকা দিয়েছে। তাদের আত্মীয়স্বজনরা কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত হওয়াসহ বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এসব নেতার গত সাড়ে পনেরো বছরে অনেক টাকা হয়েছে। তারা টাকা বাঁচাতে চান। সে কারণে মাঠে নামেননি। তারা শেখ হাসিনাকে অনিরাপদ রেখে নিজে নিরাপদ থাকতে চান।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। আজ বৃহস্পতিবার তেজগাঁও কার্যালয়ে তৃতীয় দিনের মতো বৈঠক হবে। তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বেলা সাড়ে ১১টায় শুরু হওয়া বৈঠক ২টা পর্যন্ত চলে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে বৈঠকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, মাহবুব-উল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, ডা. দীপু মনি, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, বি এম মোজাম্মেল হক, মির্জা আজম, এস এম কামাল হোসেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, কৃষি সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী, স্বাস্থ্য সম্পাদক ডা. রোকেয়া সুলতানা, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, উপ দপ্তর সম্পাদক সায়েম খান, কেন্দ্রীয় সদস্য সাহাবুদ্দিন ফরাজী, আনোয়ার হোসেন, আনিসুর রহমান, পারভিন জামান কল্পনা, সানজিদা খানম, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বেনজির আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক পনিরুজ্জামান তরুণ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী, সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান, ঢাকা-৪ আসনের এমপি মশিউর রহমান সজল, ঢাকা-৫ আসনের এমপি ড. আওলাদ হোসেন, ঢাকা-১৮ আসনের এমপি খসরু চৌধুরী প্রমুখ। বৈঠকে ওবায়দুল কাদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে গত কয়েক দিনের চিত্র ও সাংগঠনিক পরিস্থিতি তুলে ধরার আহ্বান করেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, দক্ষিণখান থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ কে এম মাসুদুজ্জামান মিঠু বলেন, আন্দোলনের শুরু থেকেই আমরা মাঠে ছিলাম। আজকে অনেক নেতা পদ-পদবি নিয়ে বাড়িতে বসে ছিলেন। তাদের আত্মীয়স্বজন বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। তারা এখন আত্মীয়স্বজনদের বাঁচাতে মরিয়া। এসব ব্যক্তির কারণে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিরাপদ না। আজকে যারা শেখ হাসিনাকে অনিরাপদ রেখে নিজেকে রাখতে চান, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।
ঢাকা-১৮ আসনের একটি থানার নেতা বলেন, এখন টাকার বিনিময়ে কমিটি করা হচ্ছে। টাকা দিয়ে যারা পদ-পদবি নেবে তারা কখনো দলের দুর্দিনে মাঠে থাকবে না। এ সময় উপস্থিত অধিকাংশ নেতা-কর্মীই টাকার বিনিময়ে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের থানা-ওয়ার্ডে কমিটি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের কাছে। ঢাকা উত্তর সিটির ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইসহাক মিয়া বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন যখনই সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নিল, তখন থেকেই আমরা মাঠে সক্রিয় ছিলাম। বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা সংঘবদ্ধ ছিল। আমরাও চেষ্টা করেছি তাদের প্রতিহত করতে।
ডেমরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবু ও মাতুয়াইল ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শান্তনু খান শান্ত বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরুতেই ঢাকা-৫ আসনের এমপি মশিউর রহমান মোল্লা সজলের নেতৃত্বে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। ডেমরাকে নিরাপদ রাখা গেলেও শনিরআখড়া এলাকায় বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডারদের কারণে দু-এক দিন আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই। পরে আবার তাদেরকে পরাস্ত করি। ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল কালাম আজাদ অনু বলেন, শুরু থেকেই যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ মুন্নার নেতৃত্বে যাত্রাবাড়ী এলাকায় আমরা অবস্থান নেই। যাত্রাবাড়ীতে সন্ত্রাসীরা আমাদের প্রতিরোধের কারণে টিকতে পারেনি। দক্ষিণের ৬৩ নম্বরের কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম দিলুর কার্যালয় ভাঙার বর্ণনা করেন। এ সময় কিছু নেতার নিষ্ক্রিয়তা ও সমন্বহীনতার অভিযোগ তোলেন।
দক্ষিণ আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, গত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগের অনেক নেতার গায়ে তেল জমে গেছে। তারা অনেক টাকার মালিক হয়েছেন। সে কারণে মাঠে নামেননি। কর্মীরা ঠিকই ঝুঁকি নিয়েছে। দুর্দিনে কর্মীরাই ঝুঁকি নেয়। নেতাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার গায়ে তেলজমা নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও খারাপ আচরণ করেন। দুর্দিনের কর্মীদের চেয়ে হাইব্রিড টাকাওয়ালা ও চকচকে চেহারা তাদের ভালো লাগে। সবার বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শোনে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। পরে তিনি বলেন, সহিংসতার সময় নেতা-কর্মীদের মাঠে রাখতে না পারাটাই দলীয় সাংগঠনিক ব্যর্থতা। উত্তরার দিকে গ্রুপিং রাজনীতি চলছে, যাত্রাবাড়ীর দিকে গ্রুপিং রাজনীতি চলছে, যে কারণে সেখানে কেউ রুখে দাঁড়াতে পারেনি। গ্রুপিং রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। দলের মধ্যে যে কোন্দল রয়েছে তা মিটিয়ে ফেলতে হবে। সবার শেষে উপস্থিত নেতা-কর্মীদের শপথ করান ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, আপনারা আজ প্রতিজ্ঞা করে যান, আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকবেন কি না। জবাবে সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। অনুষ্ঠানে ওবায়দুল কাদের বলেন, সহিংসতার সঙ্গে জড়িত সবাইকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ। এই দায়বদ্ধতা পূরণে অপশক্তিকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। এই সহিংসতার সঙ্গে জড়িত সবাইকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। দেশবিরোধী এই অপশক্তি বিভিন্ন ধরনের গুজব সৃষ্টি করছে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এ সময় দক্ষিণখান থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ কে এম মাসুদুজ্জামান মিঠু, উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কাউন্সিলরদের মধ্যে আকাশ কুমার ভৌমিক, রুহুল আমিন, ইসহাক মিয়া, আফসার আলীসহ ২০ জন নেতা ও কাউন্সিলর বক্তৃতা করেন।
আহত নেতা-কর্মীদের দেখতে হাসপাতালে নাছিম-কামাল : কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীদের হাতে অনেক আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ নেতা-কর্মী আহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দলটির নেতা-কর্মীরা। কেউ কেউ নিহত হয়েছেন। আহত নেতা-কর্মীরা রাজধানীসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। গতকাল আহত নেতাদের দেখতে বিভিন্ন হাসপাতালে যান আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন। তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মাকসুদুর রহমান মাকসুদ ও চট্টগ্রামের এক যুবলীগ নেতা, যিনি বর্তমানেও আইসিসিইউতে রয়েছেন, তাদেরকে দেখতে যান। এ ছাড়াও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু আহমেদ মন্নাফী রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নেতা-কর্মীদের দেখতে যান।