শনিবার, ১৯ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

কেমিক্যাল পল্লী হবে কবে

এক যুগেও আলোর মুখ দেখছে না বিসিক কেমিক্যাল পল্লী কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের মরণফাঁদে পুরান ঢাকার বাসিন্দারা

রুহুল আমিন রাসেল

প্রায় এক যুগ আগে পুরান ঢাকার নিমতলীতে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে প্রাণ হারান ১১৭ জন। এরও এক দশক পর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আরেক অগ্নি-ট্র্যাজেডিতে ঝরে যায় ৭১ তাজা প্রাণ। গত এপ্রিলে আরমানিটোলায় অগ্নিকান্ডে আরও চার মৃত্যু দেখেছে পুরান ঢাকার বাসিন্দারা। এভাবে প্রতিবার বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ দাহ্য কেমিক্যালে সংঘটিত অগ্নিকান্ডের পর নড়েচড়ে বসে সরকার। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর। বাস্তবে প্রায় এক যুগেও সরেনি গুদাম, হয়নি বিসিকের কেমিক্যাল পল্লী। প্রশ্ন উঠেছে, কবে হবে পল্লী, কবে সরবে গুদাম? আর কত দিন মৃত্যু উপত্যকায় বসবাস করবেন পুরান ঢাকাবাসী!

জানা গেছে, নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর দাহ্য কেমিক্যাল গোডাউন সরাতে কয়েক দফা নির্দেশ দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। গোডাউন সরাতে ব্যবসায়ীদের কয়েক দফা সময়ও বেঁধে দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। তবে এরপর চলে গেছে প্রায় এক যুগ। এখনো বহাল তবিয়তে আছে দাহ্য কেমিক্যাল গুদাম। এমন পরিস্থিতিতে পুরান ঢাকায় মানুষের জীবন যেভাবে ঝুঁকিপূর্ণ, তা দূর করতে দাহ্য কেমিক্যাল গোডাউন দ্রুত সরানোর জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের পরামর্শ, সেখানকার মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে পুরান ঢাকার সংস্কার প্রয়োজন।

এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, ‘কোনো ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে দাহ্য কেমিক্যাল ব্যবসা চলতে পারে না। যে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ স্থানই মানুষের জন্য কাম্য নয়। নিরাপদও নয়। আর দাহ্য কেমিক্যালের গোডাউন তো অনেক বিপজ্জনক। এর দায় কেউ এড়াতে পারে না। এখন পুরান ঢাকা থেকে দাহ্য কেমিক্যাল গোডাউন দ্রুত সরানোর ব্যবস্থা করা সবার জন্য জরুরি। সরকারের উচিত হবে দ্রুত জমি দিয়ে ব্যবসায়ীদের সহায়তা করা। নইলে কেমিক্যাল কারখানা সরানো যাবে না।’

এফবিসিসিআইর সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিপজ্জনক দাহ্য কেমিক্যালের গোডাউন বাসা-বাড়িতে হতে পারে না। দাহ্য পদার্থের গোডাউন সরাতে কেমিক্যাল পল্লী জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা হোক। দেশের উন্নয়নে যেমন শিল্পের বিকল্প নেই, তেমনি শিল্প-কারখানার প্রয়োজনে কেমিক্যালের বিকল্প নেই। কেমিক্যাল প্রয়োজন ব্যবসার স্বার্থেই। আমার বিশ্বাস, কোনো কেমিক্যাল ব্যবসায়ী চান না, তিনি নিজে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা করবেন, আবার সেখানে বসবাস করবেন। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ অনুযায়ী দ্রুত কেমিক্যাল পল্লী তৈরির কাজ সমাপ্ত করে তা ব্যবসায়ীদের হাতে বুঝিয়ে দেওয়া হোক।’

জানা গেছে, বিসিক কেমিক্যাল পল্লী বাস্তবায়নে ১ হাজার ৬৪৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয় উল্লেখ করে সংশোধন করা হয়েছে প্রকল্পটি। এখানে ২ হাজার ১৫৪টি প্লট তৈরি করা হবে। ফলে ঢাকা মহানগরীর, বিশেষ করে পুরান ঢাকার কেমিক্যাল কারখানা ও গুদামগুলো পরিবেশবান্ধব ও অপেক্ষাকৃত কম জনবহুল স্থানে স্থানান্তর করা সম্ভব হবে। এখানে সব ধরনের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা থাকবে। কর্মসংস্থান হবে প্রায় ২০ হাজার লোকের। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) অবদান রাখবে। এ লক্ষ্যে দুর্ঘটনা রোধসহ আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল কারখানা ও গোডাউন অপসারণের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত বিসিক কেমিক্যাল পল্লী স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ জন্য ‘বিসিক কেমিক্যাল পল্লী’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে, ৩১০ একর ভূমি অধিগ্রহণ, ১৭৮ দশমিক ৯০ বর্গমিটার অফিস ভবন নির্মাণ, ৪৬ দশমিক ৫০ বর্গমিটার পাম্প ড্রাইভার কোয়ার্টার, দুটি মেইন গেট, একটি ফায়ার সার্ভিস ইউনিট, শিল্পনগরীর ৫ হাজার ৭৩০ মিটার সীমানাপ্রাচীর, ৩২৬ বর্গফুট পুলিশফাঁড়ি, তিনটি নলকূপ স্থাপন, ৩১ হাজার ৩২৫ মিটার পানির লাইন, ৩১ হাজার ৯৪০ মিটার বিদ্যুৎ লাইন, ৬ হাজার মিটার গ্যাসলাইন, দুটি জেটি, একটি সিইটিপি ও ডাম্পিং ইয়ার্ড, ইনসিনেরেটর এবং ১৮৫ দশমিক ৮৬ বর্গমিটার পুকুর পাড়ে প্যালাসাইটিং নির্মাণ করা হবে।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) পরিচালক (প্রকৌশল ও প্রকল্প বাস্তবায়ন) মোহাম্মদ আতাউর রহমান সিদ্দিকী বলেন, ‘বিসিক কেমিক্যাল পল্লী নির্মাণে কেরানীগঞ্জ-সংলগ্ন সিরাজদীখানে ৩০৮ একর জমি মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বুঝে পেয়েছি। আশা করছি, ২০২২ সালের জুনে বিসিক কেমিক্যাল পল্লী পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে।’

শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৪ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে। এসব কেমিক্যাল বিস্ফোরকজাতীয় এবং অত্যন্ত দাহ্য পদার্থ হওয়ায় গোডাউন-সংলগ্ন এলাকায় মানুষের বসবাস অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, পুরান ঢাকার প্রায় ২৫ হাজার বর্গ কিলোমিটারে ২০ লাখ মানুষ ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করেন। বাংলাদেশ পেইন্ট ডাইং অ্যান্ড কেমিক্যাল মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, ২০ ধরনের দাহ্য কেমিক্যালের ব্যবসা করেন পুরান ঢাকার প্রায় ১ হাজার ব্যবসায়ী। বিস্ফোরক অধিদফতর ২০ ধরনের দাহ্য কেমিক্যালকে বিপজ্জনক হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। বিস্ফোরক অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, জনবসতির জন্য ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক এমন তরল পদার্থের মধ্য রয়েছে- অ্যাসিটোন, বিউটাইল অ্যাসিটেট/ এন-বিউটাইল অ্যাসিটেট, আইসো-বিউটানল, ডিএল-২৫৭৫ (চামড়া বা অনুরূপ শিল্পে ব্যবহৃত), ইথাইল অ্যাসিটেট, ইথানল।

 হেভি অ্যারোমেটিক, আইসো-প্রোফাইল অ্যালকোহল, মিথানল, বিউটানোন (মিথাইল ইথাইল কিটোন), ৪-মিথাইলপেনটেন-২ ওয়ান, এন-প্রোফাইল অ্যাসিটেট, প্রোপেন-১-অল, ফ্লেক্সো গ্রাভিওর, টলুইন, থিনার-বি, রিডিউসার/রিটার্ডার অর্গানিক কমপোজিট সলভেন্ট অ্যান্ড থিনার, জাইলিন/মিক্সড জাইলিন ও ডাই অ্যাসিটোন অ্যালকোহল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর